শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:১৫ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২৫)

  • Update Time : রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

আমার মা

সেমুই পিঠা যদি বানাইতে হইত আগের রাতেই মা আটা তৈরি করিয়া রাখিতেন। মায়ের শব্দ পাইয়া আমি আসিয়া মায়ের পাশে বসিতাম। মার পরনে থাকিত দুইখানা ডুমা। একখানা পরিতেন অপরখানা গায়ে জড়াইতেন। উদল গায়ে আমি শীতে ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতে থাকিতাম। মা আর একখানি ডুমা আনিয়া আমার গায়ে জড়াইয়া দিতেন। মা আটাগুলিকে দুইহাতে ছানিয়া ছোট ছোট গুলি বানাইতেন। সেই গুলিগুলিকে পিড়ির উপর ডলিয়া মা ছোট ছোট দড়ির মতো করিতেন। আমি অপটু হাতে মাকে এরূপ দু’একটি দড়ি পাকাইয়া দিতাম। তারপর সেই দড়িগুলিকে একটি একটি করিয়া পিঁড়ির এক কোণে রাখিয়া হাতের তেলো দিয়া ঘষা দিতেন। মায়ের হাতের কি কৌশলে একটি একটি করিয়া টুকরো সিমাই পিড়ির নিচে মাদুরের উপর পড়িত। চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে আমার আশ মিটিত না। মায়ের হাতের ঘষায় ঘষায় টুন টুন করিয়া হাতের চুড়িগুলি বাজিত। আমি মনে মনে ভাবিতাম আমার মা কত কিই না জানে! রুটি পিঠা বানাইবার সময় মায়ের দুইখানা হাত আরও সুন্দর করিয়া ঘুরিত।

সবচাইতে আশ্চর্য হইতাম যেদিন মা ভাপা পিঠা বানাইতেন। এই পিঠা এক বছর আগে খাইয়াছি। কি করিয়া মা তৈরি করিয়াছিলেন ভালোমতো মনে নাই। শুধু পিঠার স্বাদ মনে আছে। এই পিঠা বানানোর আনুপূর্বিক সবকিছু জানিবার জন্য তাই শেষরাত্রে মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে উঠিয়া আসিতাম। মা চুলায় জ্বাল ধরাইয়া প্রথমে হাঁড়িতে পানি ভরিয়া জ্বাল দিতেন। হাঁড়ির মুখে ভাঙা সরার কান্দাটি আগের দিনেই কাদা দিয়া পরিপাটি করিয়া আটকাইয়া রাখা হইয়াছিল। জ্বাল দিতে দিতে যখন হাঁড়ির পানি টগবগ করিয়া ফুটিতে থাকিত, তখন মা চালের গুঁড়ার সঙ্গে কিছু গরম পানি মিশাইয়া চালুনের মধ্যে পরিপাটি করিয়া চালিতেন। এ যেন মায়ের সুন্দর হাতের মমতা পাইয়া গুড়িগুলি ঈষৎ বড় হইয়া চালুনের ফাঁক দিয়া গলিয়া পড়িত। ইহার আগেই নতুন খেজুরে গুড়ের পাটালি কাটিয়া কাটিয়া টুকরো করিয়া রাখা হইয়াছিল। ছোট ছোট সরার মধ্যে মা এক পরত সেই গুঁড়িগুলি ভরিতেন; তার উপরে নিপুণ হাতে পাটালির কয়েকটি টুকরো সাজাইয়া উপরে নারকেল কোরা ছড়াইয়া আবার চাউলের গুঁড়ি ভরিতেন। তার উপরে আরও একবার পাটালির টুকরো ও নারকেল কোরা ভরিয়া আরও গুঁড়ি লইয়া উপরে সাজাইয়া দিয়া হাতের নখের সাহায্যে একটু একটু করিয়া টিপিয়া দিতেন। সেই সরাটিকে ভেজা ন্যাকড়া দিয়া জড়াইয়া উনুনের উপরে হাঁড়ির ভিতর হইতে কান্দা ভাঙা দিয়া যেখানে গরম পানির ভাপ আসিতেছিল সেইখানে সরাটি উপুড় করিয়া বসাইয়া কি কৌশলে সরার পিঠে একটি টোকা দিয়া সরাটি তুলিয়া আনিতেন। তারপর ন্যাকড়ার বাকি অংশটা দিয়া পিঠাটি ভালোমতো জড়াইয়া আর একটা বড় সরা দিয়া ঢাকিয়া দিতেন।

এইসব কাজ মা কত যে পরিপাটি করিয়া করিতেন। মা যেন তাঁর স্নেহের সন্তানদের জন্য একটি মহাকাব্য রচনা করিতেছিলেন। মা যেন কোনো নিপুণ ভাস্কর। কত যত্ন লইয়া কত মমতা লইয়া কত আয়েশ আরাম ত্যাগ করিয়া মা তাঁর সৃষ্টিকার্যে মশগুল রহিতেন। মনে মনে আমি কেবল মায়ের তারিফ করিতাম। মা আমার কত কি জানে। মায়ের হাতের যাদুর স্পর্শ পাইয়াই চাউলের গুড়িগুলি এমন মিষ্টি পিঠা হইয়া নবজন্ম লাভ করিবে। প্রত্যেক শিল্পীই তো তাই করে। যা কিছু আছে তাই লইয়া নাড়িয়া-চাড়িয়া আপন মনের মাধুরীর নবজন্ম দেয়। আমি হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকিতাম। কখন পিঠা হইবে। কখন খাইতে পাইব। মা কিন্তু আমার আগ্রহের দিকে খেয়ালও করে না। পরমনিধি সাঁই দরদির সৃষ্টিকার্যে তাড়াহুড়া নাই।

যখন প্রথম পিঠাটি হইল সেটি খাইতে মানা। কেন মানা কেউ জানে না। সেজন্য কেউ প্রশ্নও করে না। প্রথম পিঠাটি খাইতে মানা এই তো যথেষ্ট। হয়তো কোনো দূর অতীতকালে, হাজার হাজার বৎসর আগেই হয়তো কারও ছেলেটি প্রথম পিঠাটি খাইতে হাত পোড়াইয়া ফেলিয়াছিল; সেই হইতে নিষেধ হইল প্রথম পিঠাটি বানাইয়া কেহ খাইবে না। তাহাকে দ্বিতীয় পিঠাটির জন্য অপেক্ষা করিতে হইবে। শিল্পী তাঁর সৃষ্টিকার্যের মধ্যে যেটি সব-চাইতে ভালো সেটিকেই তো রসিকসমাজের সমালোচনার জন্য দিবেন। দ্বিতীয় পিঠাটি খোলায় দিয়া মা মিঞাভাইকে ডাকিতেন। কি মিষ্টি করিয়াই ডাকিতেন, “মফি আয়রে পিঠা হইয়াছে।” দ্বিতীয় পিঠাটি নামাইয়া ভাঙিয়া মা আমাদিগকে খাইতে দিতেন। পিঠা বানাইতে বানাইতে বারবার আমাদের মুখের দিকে চাহিতেন। মায়ের মুখেচোখে কি অপূর্ব তৃপ্তি।

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024