শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৪১ অপরাহ্ন

সাকিব আল-হাসানঃ মাগুরার টাইগার যেভাবে বিশ্ব ক্রিকেটের শীর্ষে পৌঁছালেন

  • Update Time : শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৯.০৭ পিএম
সাকিব আল-হাসান: ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই সেরা অল-রাউন্ডার। ফাইল ফটোঃ ২৫ জানুয়ারি, ২০১৪।

সাকিব আল-হাসান যে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে সফল প্লেয়ার, তা নিয়ে কোন দ্বিমত থাকার কথা না। তিনি গত ১৮ বছর ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্বমানের প্লেয়ার।

এই “সোনালী অধ্যায়” এখন শেষের পথে।

সাকিব আল-হাসান বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) জানান, অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে দলে নেয়া হলে সেটাই হবে তাঁর শেষ টেস্ট। অর্থাৎ, অক্টোবরে মিরপুরের শের-এ-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকেই তিনি বিদায় নেবেন।

টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাঁর শেষ খেলা হয়ে গেছে বলেই তিনি মনে করেন। তবে আগামী বছর পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত এক দিনের আন্তর্জাতিক (ওডিআই) খেলতে চান তিনি।

সাকিব আল-হাসান আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছেন, এই ঘোষণা হয়তো অপ্রত্যাশিত ছিল না। উনিশ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করে ৩৭ বছর বয়সে অবসর নেয়াটা স্বাভাবিক সময়ে চাঞ্চল্যকর খবর হতো না।

কিন্তু তিনি স্বাভাবিক সময়ে তাঁর ব্যাট এবং প্যাড আলমারিতে তোলার সিদ্ধান্ত নেননি।

সাকিব ৭ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর ঠিক সাত মাস পর এক ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতন হলে তাঁর ক্রিকেট ভাগ্য আর রাজনীতি একাকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নতুন সভাপতি ফারুক আহমেদ রাজনীতির বিষয়টি তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ রেখেছেন বলেই মনে হচ্ছে। এমনকি যখন সাকিবের নাম ঢাকায় এক হত্যা মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হলো, তখনও বোর্ড সাকিবকে একজন ক্রিকেটের হিসেবে তাঁর যোগ্যতা যাচাই করে দলে বহাল রাখে।

ম্প্রতি রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে সাকিব আল-হাসান বল করছেন, দৌড়ানর জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন স্বাগতিক দলের বাবর আজম। ফটোঃ ৩১ অগাস্ট, ২০২৪।

কিন্তু সাকিব নিজেও কিছুটা দ্বিধার মধ্যে আছেন বলেই মনে হচ্ছে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে নিরাপদে খেলতে পারবেন কি না, বা সিরিজ শেষে দেশ থেকে বের হতে পারবেন কি না, এসব বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

“আমি যেন গিয়ে খেলতে পারি এবং নিরাপদ অনুভব করি। যখন দেশের বাইরে আসার দরকার হবে, দেশের বাইরে আসতেও যেন আমার কোনো সমস্যা না হয়,” ভারতের কানপুরে দ্বিতীয় টেস্টের আগে সংবাদ সম্মেলনে সাকিব বলেন।

“বোর্ড খেয়াল করছে। বিষয়গুলোর সঙ্গে যারা জড়িত, তাঁরা দেখছেন। তাঁরা হয়তো আমাকে একটা সিদ্ধান্ত দেবেন, যেটার ভিত্তিতে আমি দেশে গিয়ে খুব ভালোভাবে খেলে অন্তত টেস্ট ফরম্যাটটা ছাড়তে পারব।”

তিন ফরম্যাটের রাজা

সাকিব আল-হাসান ২০ বছরে পা দেয়ার আগেই বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের জন্য নির্বাচিত হন। তাঁর আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টির মাধ্যমে। পরের বছর ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক।

তাঁর প্রতিভার একটি জোরাল আভাস পাওয়া যায় ২০০৮ সালে, যখন তিনি চট্টগ্রামে নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে মাত্র ৩৬ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট নেন। বাংলাদেশ দলের সিলেক্টররা বুঝতে পারেন তাদের হাতে কোন মাপের একজন প্লেয়ার এসেছে।

এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ (ওডিআই)-এ সেরা অল-রাউন্ডারদের অন্যতম সাকিব আল-হাসান ২০২৫ সালে পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত এই ফরম্যাটে খেলতে চান। ফাইল ফটোঃ ১৩ অক্টোবর, ২০২৩।

জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে অভিষেকের পর ১৮ বছর পার হয়েছে এবং সাকিব আল-হাসান বিশ্বের সেরা প্লেয়ারদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসি প্লেয়ারদের যে র‍্যাঙ্কিং করে, তা থেকে সাকিবের অবস্থান বোঝা যায়। আইসিসির বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় অল-রাউন্ডার হিসেবে সাকিব বিশ্বসেরা।

অল-রাউন্ডারদের মধ্যে সাকিব হচ্ছেন একমাত্র প্লেয়ার, যিনি এই মুহূর্তে (২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪) ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই আইসিসি র‍্যাঙ্কিং-এ প্রথম পাঁচজনের মধ্যে রয়েছেন – টেস্টে ৩ নম্বর, ওডিয়াই-এ ২ নম্বর এবং টি-টোয়েন্টিতে চার নম্বর।

সব ফরম্যাটেই এই বাঁ-হাতি ব্যাটার এবং স্লো বাঁ-হাতি স্পিনার কোন না কোন সময় র‍্যাঙ্কিং-এ ১ নম্বরে ছিলেন।

অর্থাৎ, সাকিব ক্রিকেটের সকল ফরম্যাটেই তুখোড় এবং বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বমানের ক্রিকেটার হিসেবে স্বীকৃত। অল-রাউন্ডার হিসেবে তাঁর পারফরম্যান্স অনেক সময় ইমরান খান বা শন পলকের মত অতীতের ‘জায়ান্টদের’ সাথে তুলনা করা হয়।

বাংলাদেশি ক্রিকেটের ‘অ্যাকিলিস’

ক্রীড়া সাংবাদিক দেব চৌধুরী সাকিবকে প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসের কিংবদন্তী যোদ্ধা অ্যাকিলিস-এর সাথে তুলনা করেন।

“আমার কাছে, সাকিব হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অ্যাকিলিস, সর্বকালের সর্বসেরা,” বলছেন ঢাকার স্পোর্টস পোর্টাল ‘অল-রাউন্ডার’ এর সম্পাদক দেব চৌধুরী।

“অ্যাকিলিসের মত, সাকিব কাওকে ভয় পায়না এবং ক্রিকেট মাঠে তিনি কোন ছাড় দেন না,” তিনি ভিওএ বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন।

লন্ডনের ওভাল মাঠে ২০১৯ সালের আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার এইডেন মারক্রামের (যিনি ছবিতে নেই) উইকেট নেয়ার পর মুহূর্তে সাকিব আল-হাসান। ফাইল ফটোঃ ২ জুন, ২০১৯।

সাকিবের জন্ম ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা মাগুরায়। জাতীয় যুব দলের জন্য নির্বাচিত হবার আগে তিনি গ্রাম্য ক্রিকেটে নাম করেন।

আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর থেকে সাকিব তাঁর খেলা উন্নত করার জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন এবং তার পুরষ্কার তিনি মাঠের ভেতরে এবং বাইরে দু’জাগাতেই পেয়েছেন।

টেস্ট ক্রিকেটে সাকিব প্রায় ৫,০০০ রান করেছেন এবং ১৩৩টি উইকেট দখল করেছেন; এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ২৪৭টি, রান করেছেন ৭,০০০ এর বেশি এবং উইকেট নিয়েছেন ৩১৭; আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সাকিবের খাতায় আছে ২,৩০০ রান এবং ১৪০ উইকেট।

“সাকিবের সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে তিনি নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারেন,” বলছেন দেব চৌধুরী। “কখন কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে, সেটা তিনি খুব ভালভাবে বোঝেন।”

তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করার জন্য চৌধুরী ২০১৯ সালে সাকিবের একটি পদক্ষেপের কথা বলেন। ইন্ডিয়ান প্রেমিয়ার লীগ (আইপিএল)-এ খেলার সময় সাকিব তাঁর নিজস্ব প্রশিক্ষক ভারতে নিয়ে যান, যাতে তিনি অতিরিক্ত অনুশীলন করে ক্রিকেট বিশ্বকাপ-এর জন্য প্রস্তুত হতে পারেন। সে বছর বিশ্বকাপ আইপিএল শেষ হবার সাথে সাথে শুরু হয়েছিল।

সেবছর সাকিব প্রথম রাউন্ডে নয় ম্যাচে ৬০৬ রান আর ১০ উইকেট তুলে বিশ্বকাপ ইতিহাস সৃষ্টি করেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশ সেমি-ফাইনাল পর্যায়ে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে সাকিবের মোট রান হয় টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ।

সাকিবের পিছনে বিতর্ক

তবে মাঠে সফলতা সত্ত্বেও, বিতর্ক সাকিবকে তাড়া করে বেরিয়েছে।

তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ক্ষতিকর ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালে যখন আইসিসি তাঁকে দু’বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলে যে ম্যাচফিক্সিং-এর জন্য বুকিরা যখন তাঁর সাথে যোগাযোগ করে, তিনি আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী সেটা রিপোর্ট করেননি।

সাকিব আল-হাসান অক্টোবরে ঢাকায় দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে সিরিজ শেষে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার আশা করছেন। ফটোঃ ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।

তাঁকে অন্যান্য অপরাধ, যেমন লাথি দিয়ে স্টাম্প ফেলে দেয়াসহ আম্পায়ারদের প্রতি অবমাননাকর ব্যবহারের জন্য স্বল্প মেয়াদের নিষেধাজ্ঞা এবং আর্থিক জরিমানার মত শাস্তি দেয়া হয়েছে।

“এগুলো ছিল তাঁর দৃষ্টিতে অন্যায় বা অযোগ্যতার প্রতিবাদ, আর আংশিকভাবে কর্তৃপক্ষের প্রতি চ্যালেঞ্জ দেয়া,” বলছেন চৌধুরী। “খেলার মাঠে সাকিবের একটি দাম্ভিক বা অহংকারী দিক আছে, কিন্তু মাঠে ফল আদায়ে জন্য তাঁর সেই দাম্ভিকতার প্রয়োজন আছে।”

মাঠের ভেতর সাকিবের সাফল্য তাঁকে মাঠের বাইরে প্রচুর সম্পদ এনে দিয়েছে। যদিও তাঁর সম্পদের পুরো চিত্র সবার জানা নেই, তারপরও এটা বলা যায় যে সাকিব আল-হাসান অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ‘ব্যান্ড।’

চৌধুরী বলছেন, বাণিজ্যিক সামগ্রীর বিজ্ঞাপন করার আগে খোঁজ-খবর না নেয়ার একটা প্রবণতা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আছে। যার ফলে তারা প্রায় এমন সামগ্রী বা সেবার প্রচারণায় অংশ নেন, যেগুলো পরে বিতর্কিত হয়ে পড়ে।

“সাকিবের বেলায় আমরা দেখতে পাই যে, বাণিজ্যিক প্রচারণা বা বিজ্ঞাপনের সাথে সম্পৃক্ততা তাঁর খেলায় কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি, বা তার জন্য দেশের ক্রিকেট প্রেমীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তায় ঘাটতি হয় নি,” চৌধুরী বলেন।

যেসব সেলেব্রিটির মাঝে অসাধারণ প্রতিভা আর বিতর্কের মিশ্রণ দেখা যায়, তাদের মতই সাকিবের উপর সব সময় মিডিয়ার কড়া নজর ছিল।

“বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তিনি একটি বিরল চরিত্র – আপনি তাঁকে পছন্দ করতে পারেন বা অপছন্দ করতে পারেন, কিন্তু আপনি তাঁকে উপেক্ষা করতে পারেন না,” বললেন দেব চৌধুরী।

ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024