রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১২ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২৬)

  • Update Time : সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

আমার মা

আমাদের গরিবের সংসার। ঘি ময়দা ছানা দিয়া জৌলুস পিঠা তৈরি করিবার উপকরণ মায়ের ছিল না। চাউলের গুঁড়া আর গুড় এই মাত্র মায়ের সম্পদ। তাই দিয়া তিনি আমাদের জন্য অমৃত পরিবেশনের চিন্তা করিতেন।

ছোটবেলায় মাকে খুশি করিবার জন্য মাঝে মাঝে চেষ্টা করিতাম। শীতের দিনে সকাল হইলে আমি আর নেহা নদীর ওপারে চলিয়া যাইতাম। সেখানে সরষেক্ষেতের পর সরযেক্ষত চলিয়া গিয়াছে। ফোটা ফোটা হলদে সরষে ফুলের গাছগুলি একের সঙ্গে অপরে মেশামেশি হইয়া দূরের গ্রামে-মেশা আল্লার আসমান তক যাইয়া ঠেকিয়াছে। গন্ধে বাতাস তেলেসমাত। আমরা সেই ক্ষেতের মধ্যে যাইয়া কেবল ঘুরিয়া বেড়াইতাম। সরষে গাছের গোড়া জড়াইয়া আছে দুধালি লতায়। সাদা সাদা সুন্দর ফুল। সেই লতা কুড়াইয়া মাথায় জড়াইতাম। তারই তলায় আস্তে আস্তে পাতা মেলিয়া দাঁড়াইয়া আছে মটরশুঁটি আর খেসারি গাছ। এখনও শিম হয় নাই। মটরশুঁটির সাদা গোলাপিমেশা পরের উপরে সুন্দর লালের ফোঁটা। গ্রাম্য মেয়ের নোলকের মতো। আর খেসারি ফুলগুলি নীল। আমরা ফুল ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া কানে

শুঁজিতাম। তারপর চষাক্ষেত হইতে শামুক কুড়াইয়া কুড়াইয়া তাহা ছিদ্র করিয়া মালা গাঁখিতাম। সেই মালা একটি গলায় পরিতাম আর একটি মাজায় জড়াইতাম। তারপর দুই ভাই চযাক্ষেতের মধ্য দিয়া দিতাম দৌড়। কে আগে যাইতে পারে। আমাদের গলায় শামুকের মালার শব্দে সমস্ত চর ঝম ঝম করিয়া বাজিয়া উঠিত। এইভাবে ভর-দুপুর খেলিয়া বাড়ি ফিরিতাম। এত বেলায় বাড়ি ফিরিলে মা যদি বকে সেইজন্য রাশি রাশি মটরের শাক, সরষে-শাক কুড়াইয়া লইয়া আসিতাম। চরে যখন মটরশুঁটির ক্ষেতে আর খেসারি কলায়ের ক্ষেতে শিম ফলিত, তখন আর আমাদের পায় কে। সকালে কিছু সামান্য খাইয়া চরে যাইতাম। আর সারাদিন সেখানে কাটাইতাম। মটরের শিম খেসারির শিম খাইয়া ক্ষুধার নিবৃত্তি করিতাম। মাঝে মাঝে ছোট ছোট হাঁড়ি লইয়া গিয়া শিমগুলি নাড়ার আগুনে সিদ্ধ করিয়া চাষিদিগকে নিমন্ত্রণে ডাকিতাম। তাহারা খাইয়া আমাদিগকে কতই তারিফ করিত।

ক্ষেতে মই দেওয়ার সময় সেই মই-এর উপর চড়া আমার একটি বড় শখ ছিল। সারাদিন কোনো চাষির ক্ষেতের ঢেলা ভাঙিয়া দিতাম যদি সে দয়া করিয়া মই দেওয়ার সময় আমাকে একটু উঠিতে দেয়। নিজে মইয়ের এক পাশে উঠিতে সাহস পাইতাম না। চাষির মাজা ধরিয়া পিছনে দাঁড়াইতাম। চড় চড় করিয়া আলি ঘুরিয়া যখন মই চলিত আমার সকল অঙ্গে কেমন যেন এক শিহরন জাগিত। বাঁশের চঙের মই-এ চড়ার চাইতে কাঠের ডলনের মইএ চড়ায় আরও আনন্দ ছিল। এই মই চড়ায় আমার এমনই নেশা ছিল যে একবার একজন চাষিকে বলিয়াছিলাম, তুমি যদি আমাকে মইতে চড়াও তবে আমার বাপের কাম করিবে। এই কথা লইয়া বহুদিন পাড়ার ছেলেরা আমাকে খেপাইত।

শহরে যাইয়া যেসব দালানকোঠা দেখিয়াছি তারই অনুকরণে মাঝে মাঝে আমরা মাঠের ঢেলা কুড়াইয়া নকল দালান গড়িতাম। তার অনেকগুলি কুঠরি থাকিত। সেই দালানের মধ্যে মাঠের শুকনো নাড়া পুরিয়া আগুন জ্বালাইয়া দিতাম। আগুনের তাপে দালানের রং ইটের মতো হইত। সেই দালানে কত রাজপুত্র রাজকন্যাকে আনিয়া বসাইতাম। এইভাবে খেলিয়া দিন শেষ হইত। সারাদিন চরে কাটাইয়াছি। মা যে বকিবেন একথা তখন মনে হইত। চর হইতে যত শুকনো ঘুঁটো কুড়াইয়া লাল আলোয়ানে বাঁধিয়া চাষিদের ডিঙিনৌকায় সোয়ার হইয়া বাড়ি ফিরিতাম। মা খুব বকিতেন কিন্তু আলোয়ান খুলিয়া যখন শুকনো ঘুঁটোগুলি দেখাইতাম মায়ের মুখে একটু মৃদু খুশি দেখা যাইত।

বস্তুত সংসারে আমার মায়ের অসুবিধার আর অন্ত ছিল না। বাজান কোনোদিন মায়ের রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করিয়া দিতেন না। অপর বাড়ির মেয়েদের মতো আমার মা বাড়ির বাহির হইয়া এখান-সেখান হইতে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করিতেও যাইতেন না। আমাদের বাড়ির বধূদের আঙিনার চারধারের চারখানা ঘরের ওপারে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। বাড়ির পাশেই তো নদী। সেই নদীতে মা একদিনও স্নান করিতেও যাইতে পারিতেন না। আমাদের বউরা যখন ঘরে আসিল তখন মা তাহাদের সঙ্গে করিয়া লোকজনের বিরলতা বুঝিয়া মাঝে মাঝে নদীতে যাইয়া দুই-এক ডুব দিয়া আসিতেন।

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024