শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৪৫ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২৮)

  • Update Time : বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

আমার মা

শীতের মৌসুমে কুম্ভকারেরা হাঁড়িপাতিল লইয়া আমাদের গ্রামে বেচিতে আসিত। চাষী-বধুরা চিটাধানের সঙ্গে কিছু আসল ধান মিশাইয়া সেই হাঁড়িপাতিলের বিনিময় করিত। তাহারা ভাবিত ধানের সঙ্গে চিটা মিশাইয়া কুম্ভকারকে ঠকাইতেছি। কুম্ভকার কিন্তু ঠকিত না। সে ধানের ভালো-মন্দ দেখিয়া তাহার হাঁড়িপাতিলের দাম কমাইত বাড়াইত। মা এই কুম্ভকারদের নিকট হইতে সারা বৎসরের ব্যবহারের যোগ্য হাঁড়িপাতিল কিনিয়া রাখিতেন। তখনকার দিনে এইসব হাঁড়িপাতিলেই রান্নাবান্নার কাজ হইত। মা সেই হাঁড়িপাতিলগুলি আমাদের ঘরের মাচার উপর সুন্দর করিয়া সাজাইয়া রাখিতেন। কতবার আমি ডাল রান্নার জন্য মায়ের উপর রাগ করিয়া এই হাঁড়িপাতিল সমস্ত ভাঙিয়া চূণ-বিচূর্ণ করিয়া দিয়াছি। মা ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিয়াছেন।

প্রতিবেশীরা ছুটিয়া আসিয়া মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজিয়া পান নাই। তখন নদীর তীরে বসিয়া বসিয়া কত কাঁদিয়াছি। কেন মাকে গালাগালি দিলাম। কেন মায়ের হাঁড়িপাতিল ভাঙিলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিতাম, মাকে আর কষ্ট দিব না। মায়ের কোনো জিনিস আর নষ্ট করিব না। কিন্তু মায়ের কাছে আসিয়া লজ্জায় এসব কথা বলিতে পারিতাম না। মা কি ছেলের অন্তর বুঝিতেন। তারপর সারাদিন ও-বাড়ি সে-বাড়ি ঘুরিয়া গাছের কাঁচা পেয়ারা আর যেদিনের যে ফল

চিবাইয়া সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরিয়াছি। মায়ের রাগ তখন পড়িয়াছে। হাতমুখ ধোয়াইয়া আঁচল দিয়া মুছিয়া মা খাইতে দিয়াছেন। এসব অপরাধের জন্য বাজান আমাকে বকাঝকা করিলেও মারধর করিতেন না। আমাদের ভালো খাইতে দিতে পারেন না এই চিন্তায় তিনি হয়তো মনে মনে ক্ষতবিক্ষত হইতেন। হাট হইতে যেদিন বাজান ইলিশ মাছ কিনিয়া আনিতেন, সেদিন আমাদের বাড়িতে আনন্দের উৎসব পড়িয়া যাইত। এ-বাড়ির ও-বাড়ির মেয়েরা মাছটি নাড়িয়া-চাড়িয়া তাহার দাম জিজ্ঞাসা করিয়া যাইত। আমার তখন খুব গর্ব বোধ হইত।

আমরা মাকে ঘিরিয়া বসিয়া মাছ কোটা হইতে রান্না শেষ পর্যন্ত দেখিতাম। রান্না যখন হয়-হয় তখন সরার ঢাকনি হইতে যে সুবাস বাহির হইত, তাহাতে জিহ্বায় পানি আসিত। আমি, আমার পিতা আর ভাইরা সকলে মিলিয়া খাইতে বসিতাম। মা সামনে ভাতের থালা দিয়া তরকারি বাড়িতে বসিতেন। সেই সময়টুকুকে যুগান্তর বলিয়া মনে হইত।

মাছের দাম যখন আট আনার মতো মাঙ্গা হইত তখন আমরা মাত্র আব টুকরো করিয়া মাছ খাইতাম। আমাদের খাওয়া শেষ হইলে মা খাইতে বসিতেন। নিজের জন্য মা এক টুকরা মাছও রাখিতেন না। কাঁটাভরা মাছের লেজটা, যা ছেলেদের খাইতে নিষেধ, তাই লইয়া মা খাইতেন। যেদিন তরকারির ঝোল থাকিত না, মা কাঁচামরিচ ও লবণ দিয়া ভাত খাইতেন। মা যে কি খায় তাহা আমরা অথবা বাজান কেহই লক্ষ করিতাম না।

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024