রেজাই রাব্বী
চলচ্চিত্র বা সিনেমা হলো বহুমাত্রিক বিনোদন মাধ্যম। অনান্যভাষার সিনেমার মতো বাংলা সিনেমার রয়েছে প্রাচীন ও গৌরবময় ইতিহাস। চিত্তবিনোদনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ‘চলচ্চিত্র বা সিনেমাকে বলা হয় ‘সপ্তম শিল্প’।’মুখ ও মুখোশ’ ছবির মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলদেশ) এর চলচ্চিত্র শিল্পের জন্ম হয়েছিল। এরপর একে একে নির্মিত হতে থাকে পরিচ্ছন্ন ও সমাজ সচেতনতামূলক বাংলা সিনেমা।
কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এই সিনেমাকে নিয়ে যায় বাংলাদেশে গ্রামীণ পটভূমি ও ফোক তথা লোকজ গল্প নির্ভর ছায়াছবি। তৎকালীন সময়ে অসাধারণ রূপকতায় লোককাহিনী ফুটিয়ে তুলতেন নির্মাতারা। নিজস্ব জীবন, ভাষা ও বয়ানরীতির মধ্য থেকে জন্মানো ও বেড়ে ওঠা লোককাহিনীর পরিচয় ও জীবনচর্চাকে প্রতিফলিত করে যখন চলচ্চিত্রায়িত হয়, তখন তা জনপদের একটা বড় অংশকে প্রভাবিত করে।
জনপ্রিয় পুঁথি ওপালা সাহিত্যের রুপবানের কাহিনীকে ১৯৬৫ সালে বড় পর্দায় নিয়ে এসে লোককাহিনী নির্ভর সিনেমারও দুরন্ত সূচনা করেন রুপবানের পরিচালক সালাহউদ্দিন। গ্রামগণ্ঞ্জের পালা বা লোককাহিনীতে নির্মিত ‘রূপবান’ ছবি। এটি ছিল বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম লোককাহিনীনির্ভর ও ‘সুপারহিট’চলচ্চিত্র। অভিনেত্রী সুজাতা এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন।এক বছর টানা বিভিন্ন সিনেমাহলে ‘রূপবান’ ছবি চলেছিল। হয়েছিলো ব্লকবাস্টার।
পাকিস্তান আমলে বাংলা ছবির ব্লকবাস্টার সাফল্যে তখন নতুন করে বাংলা ছবি নির্মাণের জোয়ার এসেছিলো। ‘রূপবান’ লোককাহিনী নির্ভর ছবি হওয়াতে এ ধরণের ছবি নির্মিত হতে থাকে পরের বছরগুলোতে।
এরপর একে একে লোককাহিনিভিত্তিক সিনেমা ঢল নামে। নির্মিত হয় রহিম বাদশাহ ও রুপবান, আবার বনবাসে রুপবান, গুনাইবিবি, বেহুলা, জরিনা সুন্দরী প্রভৃতি লোকপ্রিয় সিনেমা।কুষ্টিয়ার মেয়ে তন্দ্রা মজুমদার রুপবান সিনেমায় সুজাতা নামে আত্মপ্রকাশ করে নাম ভুমিকায় অভিনয় করেন এবং রাতারাতি তারকা খ্যাতি লাভ করেন ।
১৯৬৭ সালে ‘কাঞ্চনমালা’ ও ১৯৬৮ সালে মুক্তি পায় ‘সাত ভাই চম্পা’। ১৯৬৯ সাল থেকে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত মুক্তি পায় ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’, ‘কুচবরণ কন্যা’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘রূপবানের রূপকথা’, ‘পারুলের সংসার’, ‘গাজী কালু চম্পাবতী’, ‘পাতালপুরীর রাজকন্যা’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘মলুয়া’, ‘আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী’।
এভাবেই কেটে গেছে ৬৭ বছর বা প্রায় ৭ দশক। এই ৭ দশকে আমাদের চলচ্চিত্রের বহু উত্থান পতন এর মধ্যে আজকে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে । কালের বিবর্তনে লোকজ ধারার ছবির সেই জয়জয়কার এখন থেমে গেছে। কালক্রমে লোকজ ধারার ছবি লুপ্তপ্রায়। ক্যাবল টিভি, মোবাইল, ল্যাপটপের হাওয়ায় পাল্টে গেছে দর্শকদের রুচি।
সাম্প্রতিক কালে আধুনিক চলচ্চিত্রশিল্পে ভিনদেশী চলচ্চিত্রের নকল করার প্রতিযোগিতার সময়ে আমাজন প্রাইম, নেটফ্লিক্স, জি-ফাইভ, হইচই-এর মতো ওটিটি প্লাটফর্মগুলোর কনটেন্ট এবং তামিল, মালায়ালাম, তেলেগু, কোরিয়ান, তুর্কি, জাপানি, চাইনিজ সিনেমা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ থেকে পরিত্রান পেতে সিনেমা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ত্রুটিপূর্ণ চলচ্চিত্রের বিচার বিশ্লেষণে নির্মাণ শৈলীর বৈচিত্র্যতা, গ্রামীণ মানুষের জীবনীগাথা লোককাহিনীর প্রভাব অনুসন্ধান এবং গবেষণার মাধ্যমে নির্মাণে গুরুত্ব দেয়া।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম এন্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারম্যান এস এম ইমরান হোসেন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূল কারন হচ্ছে মানুষ এই গল্পগুলো আগে থেকেই জানে। যার ফলে কীভাবে গল্পটি সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা হলো সেটি দেখবার একটি আকর্ষন বা আকাঙ্খা বোধ করে দর্শকরা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের একটি বড় অংশের মানুষ গ্রামে বাস করে। তারা তাদের পটভূমিতে রচিত এবং তাদের জীবনের গল্পই সিনেমায় দেখতে বেশি পছন্দ করে। আরেকটি অন্যতম কারন হচ্ছে এসব লোককাহিনী নিয়ে নির্মিত সিনেমার গান এবং এর সুর মানুষকে অনেক বেশি নাড়া দিয়ে যায়।
হালের আধুনিক সিনেমা গুলো জনপ্রিয় না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, এখনকার অনেক সিনেমার গল্প খুবই জোড়াতালি দিয়ে বানানো। এগুলোর চিত্রনাট্য খুব দক্ষতার সাথে সাজানো থাকে না। দর্শক যদি আগেই বুঝে যায় কী ঘটবে তাহলে দুই তিন ঘন্টা সময় নষ্ট করার কোন মানে থাকেনা। এর বাইরে অতি-অভিনয় তো রয়েছেই। মনে রাখতে হবে উঁচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার না করতে পারলে আকর্ষন ধরে রাখা কঠিন।
আমাদের মূল ধারার সিনেমার টেকনিক্যাল কোয়ালিটি এবং সেগুলোর যেখানে নির্মিত করা হচ্ছে সেগুলোর আধুনিকায়ন দরকার। সিনেমার উন্নতি করতে হলে এর সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট ঠিক করতে হবে। ভালো সিনেমা বানাতে হবে। ভালো পরিবেশক লাগবে। উন্নত হল তৈরি করতে হবে। তরুন পরিচালকদের কাজের সুযোগ না তৈরি করতে পারলে ভালো কিছু হবে না। তাদের কাছে নতুন এবং ইউনিক গল্প আছে, ভালো আইডিয়া আছে। সেগুলোকে সহায়তা করতে হবে।
Leave a Reply