স্বদেশ রায়
দক্ষিন এশিয়ার ছোট দেশগুলোতে গত দশ বছরে ধীরে ধীরে কূটনৈতিক পরির্বতন বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল ও মালদ্বীপের মতো ছোট দেশগুলো এখন আর কেউই শতভাগ তাদের নিকট দুই বড় প্রতিবেশী চায়না বা ভারতের কোন একটার পক্ষ নিয়ে চলছে না। বরং এই দেশগুলো যতই দিন যাচ্ছে ততই স্মার্টলি ভারত ও চায়নাকে ব্যবহার করে নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে যথেষ্ট সক্ষম হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে দক্ষিন এশিয়ার বড় দেশ ভারত ও তার নিকট প্রতিবেশী পূর্ব এশিয়ার বড় দেশ বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় নম্বরের অর্থনীতি চায়নাও পরস্পরে কূটনীতিক বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদেরকে অনেক বেশি মানিয়ে নিয়ে চলছে।
যেমন সম্প্রতি নেপালের সরকারে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। সেখানে চায়না পন্থী কমিউনিস্টরা তাদের সরকারি জোট থেকে ভারতপন্থী কংগ্রেস সহ অনান্যকে হটিয়ে দিয়েছে। সে দেশের সরকারের এ পরিবর্তনে চায়নাকে সঙ্গে সঙ্গেই অনেক বেশি সক্রিয় হতে দেখা গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে শেষ অবধি চায়না নেপালের সবটুকু নিজের করায়ত্ব করার চেষ্টা যে করবে না- তাও অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখনও অবধি যা বোঝা যাচ্ছে তাতে চায়না নেপালের সামরিক খাতে ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখবে।
কারণ তারা জানে নেপালের জনগন ভারতে সরকারি চাকুরি থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনিতে যোগদান সহ সবমিলিয়ে প্রায় ভারতরে নাগরিকের সমান সুযোগ পায়। তাই সেই নেপালে চায়না যদি সবটুকু ভাগ বসাতে যায়- শুধু সরকার তাদের পন্থী বলে, তাহলে সেটা তাদের ভুল হবে। আর শুধুমাত্র তাদের পন্থী একটি কোয়ালিশন সরকারের ওপর ভর করে তারা তাদের পা যথেষ্ট সর্তকতার সঙ্গে ফেলবে। তাছাড়া এটাও সত্য নেপালের তরুণ প্রজম্মের একটি অংশ যেমন মনে করে চায়নার বিনিয়োগ হয়তো তাদের জন্যে কাজের সৃষ্টি করবে। অর্থনীতির পরিবর্তন আনবে। পাশাপাশি অন্য একটি অংশ মনে করে তারা তাদের অর্থনীতির ওই আকারের মধ্যে এত বড় বড় অবকাঠামো বিনিয়োগ ও সামরিক বিনিয়োগ বাড়িয়ে- শেষ অবধি চায়নার ঋনের ফাঁদে না পড়ে যায়। সে দেশের তরুণ প্রজম্মের এই দুইভাগে ভাগ হওয়াকে এখন ভারত ও চায়না যেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখবে, তেমনি তাদের সরকার প্রধান পুষ্প কমল দাহাল (প্রচন্ড) ও ধীরে চলবেন। তিনি ভারত ও চায়নাকে সঙ্গে নিয়েই চলার চেষ্টা করবেন। যে কারণে এ মুহূর্তে অনেকে আশা করছে নেপাল তাদের সীমান্ত বিরোধ সহ অনেক কিছু নিয়ে ভারতের সঙ্গে জোর দর কষাকষিতে যাবে। বাস্তবে তা না ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। বরং প্রচন্ড ভারত থেকে যাতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সেদেশে যায় এবং তাদের বিনিয়োগের গতি অব্যাহত থাকে- এটা পাবার জন্যে ভারতকে যা যা আশ্বাস দেবার দরকার সেগুলো দেবেন।
বাংলাদেশে জানুয়ারি’র নির্বাচন ছিলো একটি জোট ও সে জোটের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। নির্বাচন শেষে বাংলাদেশের এ যাবতকালের সব থেকে শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার তাঁর নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছেন। শেখ হাসিনার দলের জেনারেল সেক্রেটারি বলছেন, ভারত পাশে ছিলো বলে এভাবে নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রকৃত নেতা বা সরকারের মূল ব্যক্তি শেখ হাসিনা কখনই এমনটি বলেননি। আর বলার প্রশ্নও ওঠে না। কারণ, এখানে তাঁর জেনারেল সেক্রেটারি যে বড় দেশগুলো বাংলাদেশের এ ধরনের নির্বাচনের বিপক্ষে ছিলো বলছেন, আর ভারত শতভাগ পাশে ছিলো বলে নির্বাচনটি করা সম্ভব হয়েছে বলছেন- এর কূটনৈতিক বাস্তবতা কম। প্রথমত, বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের মতো চায়নাও বাংলাদেশের সরকারের পাশে ছিলো। চায়না বাংলাদেশের সরকারের পাশে থাকায় সরকারি দল অন্তত ব্যবাসায়ীদের সমর্থন পাবার দিক থেকে বেশি লাভবান হয়েছে। এ লাভটি কম নয়। কারণ, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী শ্রেনী এখন রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর। আর যে বড় দেশগুলো এই নির্বাচনের বিপক্ষে ছিলো বলে বলা হচ্ছে, তাও শতভাগ সঠিক নয়। বড় দেশগুলো বলতে, আমেরিকা, জাপান, ব্রিটেন, ফ্রান্স , জার্মানী ও অস্ট্রেলিয়া। ভারতও এদের সহযোগী। এই দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব যতটা না এদেশের গণতন্ত্রের চরিত্র নিয়ে তার থেকে অনেক বেশি সমুদ্র পথ নিয়ে। কারণ, এই দেশগুলো ভবিষ্যতে যদি কখনও চায়নাকে সামিরকভাবে মোকাবিলা করা লাগে তার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে সমুদ্রই মূল যুদ্ধ ক্ষেত্র। এমনকি চায়না ও ভারতের ল্যান্ড বর্ডারেও বড় যুদ্ধ হবার সম্ভাবনা কম। তাই বাংলাদেশের যেহেতু সমুদ্র আছে সেকারণে বাংলাদেশের সঙ্গে বড় দেশগুলোর একটা বোঝাপড়ার বিষয় আছে। এখানে বাংলাদেশকে ভারত যতই সহযোগিতা করুক না কেন, ওই রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনীতিক ক্ষেত্রে একটা সমঝোতা আনার জন্যে বাংলাদেশের নেতাও যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। যা শুধু একটি বিষয় বিবেচনা করলে বোঝা যায়, বাংলাদেশের নেতা যতই ভারতের দিকে হাত বাড়ান না কেন, তাকে সব সময়ই এক হাতে চায়নাকে ধরে রাখতে হয়েছে। এবং তিনি ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাঁর এই দুই হাতের পারদর্শীতার পরিচয় দিয়ে আসছেন।
অবশ্য নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা বিষয়ে অনেক বড় ফারাক। নেপালের জনগন চায়না ও ভারতের প্রতি প্রায় সমান অংশে দুইভাগে ভাগ। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারত বিরোধীতা বেশি। এটা যতটা না ভারতে কূটনৈতিক ব্যর্থতা বা চায়নার কূটনৈতিক সাফল্য -তার থেকে অনেক বেশি ঐতিহাসিক।ধর্মীয় কারণে যে পুতিগন্ধময় একটা পরিবেশ এখানে প্রায় শত বছর ধরে সৃষ্টি হয়েছে , তা ভারত বাংলাদেশের দুর্দিনে তার পাশে দাঁড়িয়েও যেমন কাটেনি তেমনি এখন যারা বাংলাদেশে এ ধরনের নির্বাচন করতে পারার সবটুকু কৃতিত্ব ভারতের কাঁধে তুলে দিতে চাচ্ছেন -তারাও মূলত বাংলাদেশের এক শ্রেনীর তরুণকে ভারতের বিরুদ্ধে উসকে দিতে সহায়তা করছেন।
তবে এই সব নিয়েও বর্তমানের এই যুদ্ধ, কোভিড উত্তর ও নানা কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে ও নিত্য পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে বাংলাদেশ নেপালের থেকে আরো বেশি দক্ষতার সঙ্গে চায়না ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এগুবে।
নেপাল ও বাংলাদেশের অনেকটা বিপরীত মেরুতে রয়েছে মালদ্বীপ। তাদের নতুন সরকার খুব বেশি নিজেকে চায়নার দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। এর পেছনে যতটা না কূটনীতি তার থেকে বেশি অতীতের ভারতপন্থী সরকারের সেদেশের বিরোধীদের ওপর ( যারা বর্তমানে ক্ষমতায়) নিপীড়ন কাজ করছে কিনা সেটাও একটা বিষয়। তবে মালদ্বীপ সরকারের এ উত্তেজনা কমে যাবে। এবং চায়নাও এ মুহূর্তে ভারত মহাসাগরের ভেতর এই ছোট্ট দ্বীপে এককভাবে গেড়ে বসার চেষ্টা করবে না। তাছাড়া মালদ্বীপের জনগোষ্টির সিংহভাগ মুসলিম হলেও সেখানে ভারতপন্থী বা সমর্থক কম নয়। তাই সব মিলে সে দেশের সরকারের আগেই হয়তো চায়না বাস্তবতায় নেমে আসবে।
মালদ্বীপের পাশেই শ্রীলংকাতে লংকাকান্ড ঘটার পরেও এখন বলা যায় বাস্তবে ওই লংকাকান্ডের পরেও ওপরতলায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে থেকে কিছুকাল আগেও যেমন চায়নার অর্থের কারণে, আই এম এফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে পিছু হটতে হয়েছিলো, শ্রীলংকায় লংকাকান্ডের পরে এবং বাংলাদেশে ২০২২ এর পরে এর বিপরীত ঘটনা ঘটেছে। দুই দেশেই আবার ব্যালান্স অফ পেমেন্ট সহযোগীতায় আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ফিরে এসেছে। তবে এটাও সত্য, আই এম এফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আর আগের মতো শতভাগ অর্থনৈতিক ম্যানেজমেন্টে নাক গলাতে পারবে না । যেহেতু এ দুই দেশের পেছনেই চায়নার অর্থ রয়েছে। তাই ভারতের পাশাপাশি পশ্চিমা দেশ সহ জাপানও দক্ষিন এশিয়ার এই পরিবর্তিত কুটনীতি’র সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই চলবে বলেই ধারনা করা হচ্ছে।
তবে পূ্র্ব এশিয়ার চায়নার সঙ্গে যেমন ভারতের বিরোধ তেমনি প্রায় সম বয়সী বিরোধ দক্ষিন এশিয়ার অপর দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে। পাকিস্তান দীর্ঘদিন যাবত পশ্চিমাদের সঙ্গে ও চায়নার সঙ্গে মিলে চললেও ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ হচ্ছে। দুটি দেশ চার বার যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তান তার এক অংশ হারিয়েছে । আবার দুই দেশই ক্ষুধার রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও নিউক্লিয়ার পাওয়ারের অধিকারী হয়েছে। এ দুটি দেশ পারস্পারিক বিরোধের কারণে এত বড় খাদে দাঁড়িয়ে থাকার পরে কেন যে বাস্তবতায় আসছে না তা একটি বড় প্রশ্ন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীবগান্ধী, নরসিংহ রাও, অটল বিহারী বাজপেয়ী এমনকি নরেন্দে মোদি যেমন সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছেন, তেমনি করেছেন বেনজির ভুট্টো, জেনারেল মোশারফ ও নেওয়াজ শরীফ। কিন্তু বিষয়টা এগোয়নি শেষ অবধি।
তাই দক্ষিন এশিয়ার এই পরিবর্তিত কূটনীতিতে পাকিস্তান ও ভারত সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে বড় দেশের কথা বলা হয় সে দেশগুলোরও পাকিস্তান ঘিরে করাচি বন্দর থেকে আরব সাগর অবধি অনেক স্বার্থ রয়েছে।
তাছাড়া পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী দেশ আফগানিস্তান থেকে ভারত ও তার পশ্চিমা বন্ধুরা একেবারে ছিটকে পড়েছে। দেশটি এখন মোটামুটি চায়নার প্রচ্ছন্ন ছায়ায়। আর তারপরের দেশগুলোর পথ এগিয়ে গেছে রাশিয়ার দিকে। যে রাশিয়ার সীমান্ত ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে ছুঁয়ে আছে। তাই দক্ষিন এশিয়ার পরিবর্তিত কূটনীতিতে আফগানিস্তান ঘিরে ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন রেখে যায়।
লেখক: জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও সারাক্ষণ এবং Present world -এর সম্পাদক
এক্সিলেন্ট