রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৩ অপরাহ্ন

দ্রৌপদির বস্ত্রহরণ আর অর্ধনর সৃষ্টির পথ তৈরি

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪, ৮.০০ এএম

স্বদেশ রায়

মহাভারতের নায়ক কে এ এক জটিল প্রশ্ন। দৃশ্যত মনে হয় গান্ডীব হাতে অর্জুন যুদ্ধ জিতেছিলেন, বীর শ্রেষ্ঠ তিনি- তাই তিনিই মহাভারতের নায়ক। আবার যদি বলা হয়, দ্রৌপদির শ্লীলতাহানী না হলে কুরুক্ষেত্র হতো না, যুদ্ধ তো দ্রৌপদিই চেয়েছিলেন বা তার অপমানের ভার পৃথিবী বহন করতে পারেনি বলেই ক্ষত্রিয় কুল (বীরকূল) ধ্বংস হয়েছিলো- তখন স্বাভাবিকই প্রশ্ন আসবে দ্রৌপদি অর্থাৎ অগ্নি থেকে উত্থিত কন্যাই মহাভারতের নায়ক।

আবার সব ঘটনাকে যিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন, অনেক সময় নিয়ামক হয়েছেন -সেই যাদবকূলপতি কৃষ্ণ কি নায়ক নন?  গান্ধারী যখন কৃষ্ণকে অভিশাপ দেন, অর্জুনকে নয়- তখন ধরে নেয়া যেতে পারে কুরুক্ষেত্রের মূল ব্যক্তিটি কৃষ্ণ।

মহাভারতের এই তিন চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্ব মিমাংসা করা আসলেই অনেক কঠিন কাজ। যতবার মহাভারত পড়েছি ততবার মনে হয়েছে আসলে এই তিন চরিত্রের ক্রমঅনুসারে কাকে কোথায় রাখা যায়। অর্জুন কে তৃতীয় অবস্থানে রাখা যায়, কিন্তু কৃষ্ণ ও দ্রৌপদির মধ্যে কাকে আগে ও কাকে পরে রাখা উচিত এ নিয়ে বার বার প্রশ্ন আসে।

যদিও এ এক অতি জটিল প্রশ্ন। যার সমাধান করার জ্ঞান আর যাই হোক আমার মতো ব্যক্তির থাকার কথা নয়। এবং নেই, তাও জানি। তারপরে এমন একটি সরল হিসাব রেখা সামনে আসে। দ্রৌপদি যেহেতু অগ্নি থেকে উত্থিতা- তাহলে দ্রৌপদি ভূমি ( যেহেতু ভূমির সৃষ্টি অগ্নি থেকে) তাই সে ভূমি রাজ্য হতে পারে বা পৃথিবী হতে পারে। এই দ্রৌপদিকেই বস্ত্রহীনা হতে হয়েছিলো দুঃশাসনের হাতে।  সেই দুঃশাসনের অবসানেই তো কুরুক্ষেত্র। সে কুরুক্ষেত্রে যেমন অর্জুন আছে, অভিমূন্য আছে, কর্ণ আছে তেমনি বিচক্ষণ বীর হিসেবে কৃষ্ণও আছে, যে যুদ্ধ করেনি কিন্তু যুদ্ধকে চালিত করেছিলো। কিন্তু সকল ঘটনার মূলেই তো দ্রৌপদির অপমান। অর্থাৎ ভূমির অপমান।

এই অপমান থেকে সৃষ্ট আগুনই কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মূল চালিকা শক্তি। এখানেই মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বিশেষত্ব। যে যুদ্ধ আসলে রাজ্য জয়ের জন্যে হয়নি। বাস্তবে ভূমির অপমান মুক্ত করার জন্যে হয়েছিলো।

আধুনিক যুগে এসেও দেখা যায় যখন কোন রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রকে দখল করে তখন সে যুদ্ধকে সাধারণ যুদ্ধ বা বেশিক্ষেত্রে আগ্রাসন বলে। আর যখন কোন এক বা একাধিক বীরের নেতৃত্বে সে দেশের সন্তানরা অস্ত্র ধরে হোক, আর রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর নন্দিনির মতো প্রাণকে অস্ত্রে রূপান্তারিত করে হোক- ভূমিকে অপমান থেকে মুক্ত করে তখন সে যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ,  মুক্তিসংগ্রাম বা স্বাধীনতাযুদ্ধ বলে পার্থক্য রেখা শুধু নয়- সম্মান রেখাও টেনে দেয়া হয়।

মহাভারতের অলিন্দে দাঁড়িয়ে দেখা যায় ভূমি কখন অপমানিত হয়? ভূমি অপমানিত হবার প্রথম সুযোগ পায় যখন রাজা বা রাষ্ট্রপরিচালক অন্ধ হন।

রাজা কখন অন্ধ হন? মহাভারতের আলোতে দেখলে দেখা যায়, রাজা ধৃতরাষ্ট্র দৃষ্টিশক্তি হীন হলেও যখন দ্রৌপদিকে বস্ত্রহীনা করা হচ্ছে তখন তার জ্ঞান চক্ষুও অন্ধ হয়ে গেছে। এই অন্ধত্বের মূলে রয়েছে তার আপন সন্তান ও সহযোগীদের প্রতি অন্ধত্ব এবং ক্ষমতার প্রতি অন্ধত্ব। সে অন্ধত্ব’র মধ্যে ভয়াবহ হিংস্রতাও আছে। যে হিংস্রতায় বীরের শিক্ষক দ্রোনাচার্যকেও যেমন স্তব্দ হতে বাধ্য করছে- তেমনি ওই ভূমির বা সমাজের জ্ঞানী বা প্রাজ্ঞ বা স্বাধীন মতপ্রকাশকারীর প্রতীক “বিদুর”কেও স্তব্দ করতে বাধ্য করছে।

দ্রৌপদি বা ভূমির শ্লীলতা হারানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে ধর্ম ও বীর মিলে। যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র আর অর্জুন, ভীম সকলে বীর। অথচ ধর্ম তখন পাশা খেলার নেশায় মত্ত। আসলে একটা ভূমিতে এ এক বড় প্রশ্ন? ধর্ম অর্থ তো সত্য। তাহলে একটা ভূমিতে সত্য কখন নেশায় মত্ত হয়?  বাস্তবে রাজা অন্ধ হলে বা রাজ্যে অন্ধত্ব নেমে এলে তখন কি সত্যও নেশায় মত্ত হয়? এই সত্য পাঁচ হাজার বছর আগে মহাকাব্যে এলেও যুগে যুগে বয়ে চলেছে- বার বার বিভিন্ন ভূমিতে সত্য নেশায় মত্ত হয়েছে। এমনকি ব্যক্তি জীবনের সত্যও ক্ষমতা থেকে পাশা বিভিন্ন নেশার পেছনে ছোটে বার বার। তার নেশাও যে তার নিজের ভেতরের দ্রৌপদিকে বস্ত্রহীনা করে- নেশামত্ত সে বুঝতে পারে না। আর বীরত্ব তো সব সময়ই সত্যর থেকে কম ক্ষমতাশালী। সে বুঝতেই পারে না অন্ধত্ব আর নেশাগ্রস্ততার ভয়াবহ বাসরকে।

তাই রাজা যখন অন্ধ হয়, সত্য যখন নেশাগ্রস্থ হয়, বীর যখন নেশা ও অন্ধত্বের অধীনে চলে যায়- তখন স্তব্ধ হয়ে যায় বীরস্রষ্টা, নিশ্চুপ করানো হয় জ্ঞান ও মুক্ত বাক্যকে। তখন দ্রৌপদি তাই সে ভূমি হোক আর জম্মভূমি হোক বা সৃষ্টির দ্বার নারী হোক -সে হয় অপমানিতা, বস্ত্রহীনা।

এই অপমানের শেষ যদি কুরুক্ষেত্র দিয়ে করার চেষ্টা করা হয় তাহলে তার পরিনাম কি শুভ?  মহাভারতের আলোতে সেখানে তো কোন শুভ সকাল দেখা যায় না। বরং দেখা যায় লাশের স্তুপ, বিধবার কান্না  আর দিনের আলোতে শিয়ালের চলাচল। বাঘের ডাককে ঢেকে দেয় দলবাধা শিয়ালের ডাকে।

আর ভবিষ্যতে কি সত্য হয় না গান্ধারি যে অভিশাপ দিয়েছিলো কুরুক্ষেত্রের পরিকল্পনাকারী কৃষ্ণকে- সেই অভিশাপের প্রতিটি অক্ষর। কালীপ্রসন্ন সিংহের ও রাজশেখর বসুর অনুদিত মহাভারতের থেকেও অতি সহজ ভাষায় গান্ধারীর এই অভিশাপকে প্রকাশ করেছেন গজেন্দ্র কুমার মিত্র তার “পাঞ্চজন্য” নাম দিয়ে মহাভারতের এক সংক্ষিপ্ত উপন্যাস আদলের অনুবাদে- সেখানে গান্ধারী কৃষ্ণকে যে অভিশাপ দেন তার কয়েক লাইন এমনই “ বাসুদেব, তোমার কীর্তি দেখতে এসেছো এই শ্মশানভূমে? দেখে তৃপ্তি লাভ করেছো তো? এই দৃশ্যই তো তোমার ঈস্পিত ছিলো- তাই না! মানব জগতের শ্রেষ্ঠ পুস্পরাশি দলিত মথিত গলিত হবার দৃশ্য। …… উচ্চবংশের কূলনারীরা বারনারীর মতো সকলের দৃশ্য হয়েছেন, অচিরেই ইতরজনের ভোগ্যাও হবেন। …… অনার্য, নিষাদ, পিশাচ প্রভৃতির ঔরষে যে বর্ণসংকর সৃষ্টি হবে- অনাগত সেই অর্ধনরদের উপরই ভারতভূমির গৌরবরক্ষার ভার ন্যস্ত করলে তুমি। সাধু!সাধু!”

বাস্তবে যুগে যুগে এই দ্রৌপদির বস্ত্র হরণ আর অর্ধনরদের উত্থান -এটাই কি পৃথিবীর নিয়তি?  পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যসদেব তার মহাকাব্য’র চরিত্রদের নিয়ে যে পৃথিবীর ছবি এঁকেছিলেন সেখান থেকে পৃথিবীর বর্তমান সভ্যতা কতটুকু বের হয়ে আসতে পেরেছে?

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024