সেকান্দার আলী
বর্তমানে ‘সমর্থক’ ধারণাটাই যেন পাল্টে দিচ্ছেন কতিপয় সমর্থক। সমর্থনকে তারা নিয়ে গেছেন বাণিজ্যিক পর্যায়ে।
ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল যেবার ঢাকায় এলো প্রথম দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে, সেই ২০০৩ সালের কথা- সেই দলের সঙ্গে এসেছিল সমর্থকগোষ্ঠী ‘বার্মি আর্মি’। টেস্ট ক্রিকেটের একনিষ্ঠ সমর্থক তারা। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে খুব আনন্দ নিয়ে টেস্ট ম্যাচ উপভোগ করতে দেখা গেছে ইংলিশ ক্রিকেটের এলিট সমর্থকদের। বাংলাদেশের মানুষ সেবারই বার্মি আর্মি সম্পর্কে ভালো ধারণা পায়। বার্মি আর্মি প্রিয় দলের খেলা দেখতে বিদেশে যান নিজেদের টাকা খরচ করে।
বাংলাদেশে বেঙ্গল টাইগার্স ও ক্রিকেটার্স সাপোর্টার্স ফোরামও সেরকমই সমর্থকদের গোষ্ঠী। সমাজের ‘সুশিক্ষিত’ ক্রিকেট অনুরাগীরাই ওই দুই সংগঠনের সদস্য। তারাও নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ দলকে সমর্থন দেন। অথচ বর্তমানে ‘সমর্থক’ ধারণাটাই যেন পাল্টে দিচ্ছেন কতিপয় সমর্থক। সমর্থনকে তারা নিয়ে গেছেন বাণিজ্যিক পর্যায়ে। কিন্তু ‘ভাড়া করা’ সমর্থক দিয়ে আর যা-ই হোক, ক্রিকেটের তো বিশেষ কোনো লাভ হতে পারে না। উল্টো বিদেশের মাটিতে অনেক ক্ষেত্রে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষন্ন করছেন তারা।
টাইগার মিলন, টাইগার শোয়েব, টাইগার রবি নামে পরিচিত এ ধরনের কিছু সমর্থক বিদেশ ভ্রমণে সদা ব্যস্ত। শ্রীহীন পোশাকে বিজ্ঞাপনের লোগো লাগিয়ে, গ্যালারিতে জাতীয় পাতাকা দুলিয়ে বা হাঁকডাক দিয়ে তারা হয়ে গেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মুখ। মানুষ তাদের মুখটাই দেখতে পায়, মুখোশ নয়। সমর্থক মুখের অন্তরালে চলে উপার্জন। চলে বিনা পুঁজিতে লাভজনক বাণিজ্য। অথচ একটা সময় কত নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেটভক্তকেই দেখেছে ক্রিকেট-বিশ্ব। পাকিস্তানের চৌধুরী আব্দুল জলিল তথা জলিল চাচা, মোহাম্মদ বশির বা বশির চাচার নাম বিশ্ব জুড়ে পরিচিত। শ্রীলঙ্কার আঙ্কেল পার্সির কথাও ক্রিকেটানুরাগীদের মনে থাকার কথা। দেশ-বিদেশে নিজের দেশের খেলায় উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে তাকে। কিন্তু হাল আমলে অসংখ্য ভাড়াটে সমর্থক এসেছে উপমহাদেশের ক্রিকেটে।
ভারতের সুধীর কুমার গৌতম ভালোবাসা থেকে ক্রিকেট সমর্থক হয়েছেন। শচীন টেন্ডুলকারের খেলায় মুগ্ধ সুধীর এখন ভারতের ক্রিকেট সমর্থকদের দূত। এই সুধিরই ক্রিকেট সমর্থন করে বিদেশ সফর করছেন নিয়মিত। তার দেখাদেখি বাংলাদেশেও কিম্ভুতকিমাকার পোশাক পরা কিছু সমর্থকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। টাইগার মিলন ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনিই প্রথম বাঘের পোশাকে স্পন্সরের লোগো ব্যবহার করেছেন। তার দেখাদেখি গাড়ির মেকানিক থেকে শোয়েব আলিরও গ্যালারির ‘টাইগার’ হয়ে ওঠা। শোয়েবের বাজার বিশাল। ইউটিব, ফেসবুকে ভিডিও দিয়ে এখন উপার্জন করেন তিনি। ক্রিকেটারদের মাধ্যমে জোগাড় করেন স্পন্সর। বিদেশে গেলে ফ্রি থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে উপহারও পান। এমন লাভজনক ব্যবসা ছেড়ে কেউ কি গাড়ি ঠিক করার কাজে ফিরে যেতে চাইবে? শোয়েবও পুরোনো পেশায় নেই। জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটারের মাধ্যমে সেভেন রিংস সিমেন্টের স্পন্সরশিপে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান তিনি। শোয়েব এখন গাড়ির মালিক! অথচ একটা সময় একটি টিকিটের জন্য স্টেডিয়ামের সামনে অপেক্ষা করতে দেখা যেতো তাকে।
পেশাদার সাংবাদিকদের অনেকেই যেখানে ভারত, শ্রীলঙ্কা, বড়জোর আরব আমিরাতে ক্রিকেট কাভার করে ক্যারিয়ার শেষ করে দিচ্ছেন, সেখানে টাইগার শোয়েব ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড ঘুরে ফেলেছেন।
বাংলাদেশের সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক শামীম চৌধুরী মনে করেন, এ ধরনের সমর্থক দেশের জন্য, ক্রিকেটের জন্য উপকারী নয়। তিনি বলেন,‘‘টাইগার সমর্থকরা বিদেশে গিয়ে নানা জটিলতা তৈরি করছে। ২০১৩ সালে শোয়েব জিম্বাবুয়েতে গেলে তাকে ইমিগ্রেশনে আটকে রাখা হয়। বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন। তারা যেভাবে স্পন্সর লোগো বুকে লাগিয়ে স্টেডিয়ামে যাচ্ছে তাতে ক্রিকেটের বিজ্ঞাপনের বাজার নষ্ট হচ্ছে। কারণ, একজন ‘টাইগার’কে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে কোম্পানি প্রচার নেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের টাইগারদের ঠেকাতে আইসিসি এবার বৈশ্বিক ইভেন্টে প্রবেশাধিকার দেয়নি। আইসিসি লোক নিয়োগ করেছিল গ্যালারিতে স্পন্সর লোগো নিয়ে কেউ আছে কিনা খুজেঁ বের করতে। বিসিবিরও এদিকটায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। না হলে ভবিষ্যতে আরো খারাপ কিছু হতে পারে।’’
মো. রবিউল ইসলাম তথা টাইগার রবির আত্মপ্রকাশ কয়েক বছর আগে। সম্প্রতি ভারত সরকার তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হয়।সমর্থক টাইগাররা বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে এত উদগ্রীব যে, যে কোনো মূল্যে ভেন্যুতে যাওয়া চাই-ই চাই তাদের।
শামীম চৌধুরী এ ব্যাপারে বলেন,‘‘আমরা পাকিস্তানের আব্দুল জলিল, মোহাম্মদ বশির চাচাকে দেখেছি। ভারতের সুধীরকে দেখছি। উনারা কিন্তু কোনো স্পন্সর নিয়ে মাঠে ঢোকেন না। তাঁরা আয়োজক দেশের ক্ষতি করছেন না। তারা ব্যক্তিগত স্পন্সর নিয়ে খেলা দেখতে যান। বাংলাদেশে সমর্থনটা বাণিজ্যিক হয়ে গেছে।’’
এবার যেমন দেশে ভারতের ভ্রমণ ভিসা বন্ধ থাকায় মলিদ্বীপে গিয়ে ভিসা নিয়ে ভারতে এসেছেন তিনি। এসে এমন কাণ্ড বাঁধিয়েছেন যে বাধ্য হয়ে তাকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে ভারত সরকার৷
এই ‘টাইগারদের’ দৌড়াত্ম নিয়ে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান বলেন, ‘‘এটা অত্যন্ত দু:খজনক। ফ্যান ফলোয়ার থাকবে, দলকে সমর্থন দেবে- খুবই স্বাভাবিক। ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার সমর্থকরা বিশ্বকাপে যায়, দলকে সমর্থন দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে যারা একক সমর্থক, তাদের ঠিক সমর্থক বলা যায় না। ভিসা পাওয়া বা বিশেষ সুবিধার জন্য তাদেরকে বিসিবি বা ক্রিকেটারদের সহযোগিতা করা উচিত না। গ্রুপ করে ফ্যানরা যাবে তাদের মতো করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এককভাবে যাচ্ছে- কেউ বাঘ সেজে, কেউ হরিণ সেজে। বুকের মধ্যে বিজ্ঞাপন। সবকিছু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিজ্ঞাপনের প্রচার করে লাভবান হওয়া। যখন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ফেলে, তখন ওই দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এবার যেটা কানপুরে হয়েছে। এখানে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আপনি তাদের হয়তো আটকাতে পারবেন না, কারণ, তারা নিজেদের ব্যবস্থায় যায়। এক্ষেত্রে বিসিবি, ক্রীড়া সংগঠনের কোনো সহযোগিতা করা ঠিক হবে না।’’
পাকিস্তানের জলিল চাচা ছোট বয়স থেকেই ছিলেন ক্রিকেটের পাঁড় সমর্থক। ১৯৬৯ সালে ইংল্যান্ড দলের পাকিস্তান সফরের খেলা প্রথম দেখেন স্টেডিয়ামে গিয়ে। ১৯৯৬ সালে শারজাহ স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলেশিয়া কাপের সময় পাকিস্তানের সমর্থকের মুখ হয়ে উঠেন তিনি। জাতীয় দলের জার্সি পরে, হাতে দেশের পতাকা, মুখে উত্তেজক গান- এভাবেই নজর কাড়েন তিনি। আরব আমিরাতে চাকরি করার সুবাদে শারজায় খেলাগুলো দেখতেন নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে। জলিলকে পরে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) চাকরি দিয়ে অফিসিয়াল সমর্থক বানায়। পিসিবির টাকায় ক্রিকেট বিশ্ব ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি। শিকাগো চাচা বা বশির চাচা বেশ বিত্তবান। ভালোলাগা থেকে বিশ্ব ঘুরে ঘুরে ক্রিকেট খেলা দেখেন। পাকিস্তানের এই দুই শিক্ষিত ও মার্জিত সমর্থকের কোনো কর্মকাণ্ড দেশের সুনামহানি করেনি। এই যে সুধীর নিজের দোকান ফেলে দেশে দেশে ঘুরে ঘুরে ভারতকে সমর্থন দেন, সেখানে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকলেও বিদেশের মাটিতে ভারতের মাথা নত করার অপবাদ নেই। সুধীর, শোয়েবদের দেখাদেখি শ্রীলঙ্কায়ও নতুন সমর্থক গড়ে উঠেছে। এই সমর্থকদের না আছে শিক্ষা, না আছে মার্জিত আচরণ। তারা হয়ে উঠেছেন ভাড়াটে ক্রিকেট সমর্থক!
বাংলাদেশের ‘একক সমর্থক’দের প্রসঙ্গে খেলবেই বাংলাদেশ- এর প্রতিষ্ঠাতা কাজী সাবির বলেন,‘‘আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই না সমর্থন বন্ধ হোক। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ব্রাজিলেও একক সমর্থক আছে। তারা দেশও দেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কথা হচ্ছে তাদের কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হলে ক্ষতির কারণ। হাজার হাজার দর্শকের মাঝে এক-দুজন টাইগার থাকে। তাদেরকে টিভিতে দেখায়। দর্শক সরাসরি দেখে। অবশ্যই এই সমর্থকদের আচরণ জানতে হবে। কারণ, তাদের দেখে পুরো একটা জাতিকে কল্পনা করবে যে দেশে খেলা হচ্ছে সে দেশের মানুষ। এখন তাদের আচরণ কে শেখাবে, বিসিবি,না তারা নিজেরাই শিখবে? মোট কথা, তাদেরকে ঠিকঠাক আচরণ জানতে হবে।’’
বাংলাদেশি ‘টাইগার’দের’ নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সিইও নিজামউদ্দিন চৌধুরী বলেন,‘‘তারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভিসা নেয় এবং বিদেশে যায়। যারা স্পন্সর দেয়, তারা হয়তো এতকিছু ভাবে না। কিন্তু এখন দেখছি কিছু সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।” রবি চেন্নাই টেস্টের সময় স্থানীয় মানুষের বিরুদ্ধে টিভি সাক্ষাৎকারে কটু মন্তব্য করে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন। অভিযোগ করেছিলেন ভারতের সমর্থকরা তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে। অথচ পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে উল্টো তথ্য।আসলে গ্যালারিতে দর্শক আর গেটে নিরাপত্তাকর্মীদরে সঙ্গে অসদাচরণ করেছেন বাংলাদেশি এ সমর্থক। কানপুর টেস্টের প্রথম দিনও দর্শক কর্তৃক শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন তিনি। অথচ স্থানীয় হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বেরিয়ে এসেছে ছোঁয়াচে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত তিনি। পানিশূন্যতায় দুর্বল হয়ে পড়ায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। মেডিক্যাল ভিসায় ভারতে আসা রবি ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের ব্যক্তিগত সহকারী।
ইংল্যান্ড দলের সঙ্গে বার্মি আর্মি এখন আর দেখা যায় না। বেঙ্গল টাইগার্স বা ক্রিকেটার্স সাপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনও আর বিদেশ ভ্রমণে মরিয়া হয়ে থাকে না। চাকরি বা ব্যবসার ফাঁকে তারা বিদেশে খেলা দেখতে যান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে যেতে দেখা যায় তাকে। সেখানে সব সিরিজ, সব টুর্নামেন্ট এবং সব দেশে যাওয়া শোয়েব কত টাকার মালিক? দেশের আয়কর বিভাগ খোঁজ নিলে বেরিয়ে আসতে পারে অন্য কিছু।
ডিডাব্লিউ ডটকম
Leave a Reply