গাই নেই, বাছুর নেই, তবুও রুস্তম দুধ যোগান দেয়। গাই-বাছুর যাদের নেই তারা যোগান দেয় কিনে। কিন্তু রুস্তম কেনেও না দুধ। প্রতিবেশীরা রহস্যটা ধরে ফেলে একদিন। তারা চোখ টেপাটেপি করে, মুচকি হেসে বলাবলি করে নিজেদের মধ্যে, আমাদের রুস্তম ভোজবাজীর খেলা জানে বেশ।
ভোজবাজীই জানে রুস্তম। ভোজবাজীর উপকরণ গামছায় মুখ বাঁধা একটা কলসী শুধু। পাঁচ-সেরি পেতলের কলসীটার মুখ গামছায় বেঁধে নিয়ে সে রোজ কোন এক রাস্তায় গিয়ে বসে। ভোর সাতটা আটটায় দুধের হাঁড়ি নিয়ে বাজারে যায় গাঁয়ের লোক। রুস্তম তাদের লক্ষ্য করে। নাবালক বা হাবাগোবাগোছের লোকই তার পছন্দ। এরকম দেখলেই সে তার কলসী নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ব্যস্ততার ভান করে বলে, দে তো ভাই, দু’সের শিগ্গীর। বাড়ুয্যে বাবুর বাসায় রোজান দিতে হবে।
দুধওয়ালা দু’সের মেপে রুস্তমের মুখ-বাঁধা কলসীতে ঢেলে দেয়।
রুস্তম পয়সার জন্যে কোছ হাতড়াতে হাতড়াতে বলে, পাঁচ আনা পাঁচ আনা দশ আনা।
-কি দশ আনা?
-কি আবার। পাঁচ আনা পাঁচ আনা কত হয়?
-পাঁচ আনা সের কি বলছ তুমি?
-ঠিকই বলেছি। নে, ছ’আনা বের কর। টাকা দেব।
-দু-ও মিয়া। পাঁচ আনা করে কোথায় দেখেছ দুধের সের এই বছর?
আরে, কালও আমি পাঁচ আনা করে কিনেছি যে। –
তুমি বোধহয় গয়লার পানি দেয়া দুধ কিনেছ। – -আরে না না। গেরস্তের দুধ। আমি মিছা কথা বলার মানুষ না, বুঝলি?
-না ভাই, আমি কালও সাত আনা ভাও বেচেছি।
-দিবি না তবে পাঁচ আনা করে?
-না।
-নে, যা। তোর দুধ ফেরত দিয়ে যা। নেব না তোর দুধ। রুস্তম তার মুখবাঁধা কলসী থেকে দুধ ঢালে। দুধওয়ালা চোঙা দিয়ে মেপে দু’সের দুধ ফেরত নেয়। রুস্তম বিরক্তির সাথে বলে, মানুষ অদৃষ্টের ফেরে পড়লে আর মানুষ বলেই গিয়ান করে না কেউ। দুধটা ফিরিয়ে নিয়ে গেলি? যা, বেচে দালান দে গে। খোদা দিন দিয়েছে তোদের। আমারও একদিন ছিল। আমারও গাই-বাছুর ছিল।
রুস্তম অন্যমনস্ক হয়ে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
তার প্রথম দিকের বিরক্তি অভিনয় ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু শেষের দিকের দীর্ঘশ্বাস অন্তর-নিঃসৃত। গাই-বাছুর তার সত্যি ছিল।
“রুস্তম নিজের এলাকায় পালিয়ে আসে। কিন্তু রাখালদের ঢিল খেয়ে থেলে যায় তার পিঠের এক জায়গা”
রুস্তমের বাড়ি বিভক্ত বাঙলার সীমান্তে, দর্শনার কাছাকাছি জয়নগর গ্রামে। তার বাড়ি থেকে সীমান্ত কয়েক শ’ গজ মাত্র দূরে। জমি-জমা তার কিছু নেই। ছিল দুটো ভালো দুধের গাই। দুধ বেচেই সংসার চালাত সে। সংসার বলতে ঘরে-বাইরে তারা দুজন। ছেলে হয়েছিল একটি। আট মাসেরটি হয়ে মারা গেছে। সে আজ সাত বছরের কথা।
ছেলে-পুলে ছিল না বলে তাদের আদর-যত্নের ষোল আনা ভোগ করত গাই- বাছুরগুলো। আদর করে তারা নামও দিয়েছিল গাই দুটোর-চাঁদকপালী আর লাল দুলালী।
সেদিন ভোরবেলা। গাই দুটোকে সরকারী রাস্তার পাশে গোচর দিয়ে সে দুধ যোগান দিতে গিয়েছিল দর্শনায়। কচি বাছুর দুটো ছুটাছুটি করছিল গাই দুটোর আশপাশে। রুস্তম ফিরে এসে দেখে গাই দুটো নেই। বাছুর দুটোও উধাও। সে দৌড়ে যায় সীমান্তে। সীমান্তের কাণ্ড-কারখানা। এখানে গরু খোয়ানো এমন কিছু অপ্রত্যাশিত ব্যাপার নয়। কিন্তু তবুও পশ্ন জাগে রুস্তমের মনে কোথায় গেল? কে নিয়ে গেল? কেমন করে নিয়ে গেল?
আর একবার তার ও রহিমুদ্দির গাই প্রায় চুরি গিয়েছিল আর কি। দুটো ছিঁচকে স্মাগলার সীমান্তে পাড়ি দিচ্ছিল। চারটে গাই খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, যেন তাদেরই ওগুলো। সময়মতো টের পেয়েছিল রুস্তম। হৈ-চৈ ডাক-চীৎকার শুনে গাই ফেলে পালিয়ে যায় স্মাগলার দুটো।
এবারও কি সে রকম কিছু ঘটেছে?
স্মাগলাররা নিয়ে গেলে পাওয়া যেতেও পারে। ওপারে নিরাপদ কোন জায়গায় পৌঁছেই ওরা ছেড়ে দেবে হয়ত। গরু বেচার হ্যাঙ্গাম অনেক।
রুস্তম আশায় আশায় ঘোরে। রোজ চার-পাঁচ মাইল হাঁটে সে সীমান্তের সীমারেখা ধরে। সুযোগ বুঝে ওপারেও চলে যায় মাঝে মাঝে। চোখ মেলে ধরে যতদূর দৃষ্টি যায়। গাই দুটোর নাম ধরে ডেকে কখনো কখনো নিজস্ব ভংগীতে হাঁক দেয়-হাম-বা-1-1, আয়, আয়, আয়। তারপর কান পেতে থাকে। তার গলার আওয়াজ চেনে গাই দুটো। শুনতে পেলে সাড়া দেবে, হাম্বিয়ে উঠবে। কিন্তু কোন সাড়া পায় না রুস্তম।
এদিকে সংসারে আশ্বিনের ভাঁটার টান লাগে। যোগান দেয়া দুধের টাকা তুলে এনেছিল যে কয়টা, ফুরিয়ে যায় তা কয়েক দিনেই। এবার কিছু একটা করা দরকার। ওপারের ওরাই ধরে নিয়ে গেছে আমার গাই। আমি কেন চুপ করে বসে আছি? আমিও ওদেরটা ধরে নিয়ে আসব। নিজে নিজেই বলে রুস্তম।
দাওয়ায় বসে হুঁকো টানছিল সে। রাগে আর উত্তেজনায় হুঁকোটা ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। কোমরে গামছা বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে যায় সে।
জমিলা বাধা দেয়। পেছন থেকে মিনতি জানায়। কিন্তু রুস্তম কান দেয় না বউ-এর কথায়।
সীমানায় এসে সে তাকায় ওপারের দিকে। দূরে কয়েকটা গরু দেখা যায়।
সাড়ে তিন হাত আসমান-দীঘলি হয়ে হেঁটে এতদূর যওয়া নিরাপদ নয়। রুস্তম ফন্দি আঁটে। এক পাঁজা ফনফনে কাঁচা ঘাস ও একটা দড়ি যোগাড় করে সে। ঘাসগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে সে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায়।
বেলা দুপুর। তিনটে রাখাল গাছের ছায়ায় গামছা বিছিয়ে ঘুমুচ্ছে। রুস্তম দুটো গাই-এর খুঁটা তুলে দেয়। তারপর দড়ি ধরে ঘাসের আঁটি টেনে টেনে ফিরে চলে হামাগুড়ি দিয়ে। গাই দুটো তাজা ঘাসের লোভে পিছু নেয় রুস্তমের। কিন্তু কিছুদূর যেতে না যেতেই অদূরে বাঁধা বাছুর দুটো শুরু করে দেয়, হাম্বা, হাম্বা। রাখালগুলো জেগে উঠেই দেখতে পায় রুস্তমকে। চীৎকার আর গাল দিতে দিতে তারা তেড়ে আসে। সেও এবার দু’পায়ে খাড়া হয়ে ছুট দেয়।
রুস্তম নিজের এলাকায় পালিয়ে আসে। কিন্তু রাখালদের ঢিল খেয়ে থেলে যায় তার পিঠের এক জায়গা।
তার রাগ এবার আরো বেড়ে যায়। প্রতিশোধের উপায় খুঁজে বেড়ায় তার ঘা খাওয়া মন।
উপায় একটা বের করে রুস্তম। গামছায় মুখ বাঁধা পাঁচসেরি পেতলের কলসীটা শুধু সম্বল করে সে আবার দুধ যোগান দিতে শুরু করে।
কেনার নাম করে কলসীর মধ্যে দুধ নেয়া আর নানা ছল-ছুঁতোয় সেই দুধ ফেরত দেয়া-এইটুকুই শুধু ভোজবাজীর মন্তর। দুধ ফেরত দেয়ার সময় সে বিরক্তি প্রকাশ করে বটে। কিন্তু মনে মনে খুশী হয়, বলে,-এবার দশ আনা ছ’আনা হয়েছে। ছ’আনাই যথেষ্ট। এরচে ভালো দুধ হিন্দুদের দেব আবার!
“বারান্দায় টেবিলের ওপর খালি একটা দুধের বোতল। বোতলের মুখে চুন্নি। রুস্তম আর দাঁড়াতে পরে না। দুধের কলসী নিয়ে সে ছুটে বেরিয়ে যায়”
প্রথম দিকে জমিলা প্রতিবাদ করে বলত, তোমার এ কাজটা আমার ভালো লাগে না। খোদার কাছে কি জবাব দেবে তুমি?
-রেখে দে তোর জবাব। আমি তো কোনো মুসলমান ভাইকে ঠকাই না। আমি দুধ রোজান দিই হিন্দুবাড়ি। হিন্দুস্থানের ওরাই আমার গাই নিয়ে গেছে না? ওদের জাত- ভাইদের ওপর দিয়েই এর শোধ তুলব আমি।
দর্শনার কেরু কোম্পানীর হিন্দু কর্মচারী সেন, বোস আর বাড়ুর্য্যের বাসায় মুখ বাঁধা কলসীর দুধ যোগান দিয়ে চলে রুস্তম।
দুধ যোগাড়ের জন্য আজ এ রাস্তা কাল সে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হয় তাকে। তা না করলে লোকের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। মাঝে মাঝে তার কেরামতিরও কিছু হের- ফের উনিশ-বিশ করতে হয়। কখনো কলসীতে দুধ নেয়ার পর বলে বসে, তোর দুধ ভারি পাতলা রে। এ দুধ সেনবাবুকে দেয়া চলবে না। ফিরিয়ে নে তোর দুধ। কখনো কোন ছেলে-ছোঁকরা পেলে বলে, কিরে ব্যাটা, উদোম হাঁড়িতে দুধ নিয়ে যাচ্ছিস
কোথা। চারদিকে কলেরা-বসন্ত। আমার মতো কলসীর মুখ বেঁধে নিতে পারিস না। দে, তোর দুধটা ছেঁকে দিই।
এমনি কোন একটা ছুঁতোয় একবার তার মুখ বাঁধা কলসীটায় দুধ ফেলতে পারলেই হল, ব্যস!
কেরামতির হের-ফের করেও ছ’মাসের বেশি টেকে না এ ফন্দি। লোকে বুঝে ফেলে। রুস্তমের কলসী-ফেরত দুধ বাজারে বেচতে গিয়ে নয়াপাড়ার করম আলী পঁচিশ টাকা জরিমানা দিয়েছে।
রুস্তম নতুন পথ ধরে। এবার আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা নয়, কলসীর মুখ বাঁধাও নয়। গুঁড়ো দুধের দৌলতে তার দুধ যোগানের কাজ একই ভাবে চলছে। প্রতিবেশী একজনের কাছ থেকে সে রোজ দেড় সের দুধ নেয়। গুঁড়ো দুধ-গোলা তিন সের পানির সাথে মেশায় সেই দেড় সের খাঁটি দুধ। বুঝবার জো নেই সহজে। আর বুঝলেই-বা কি! ছাড়িয়ে দেবে? দিক না। দু’মাসের করে বাকি আছে দুধের দাম। সামান্য কেরানি সব। দু’মাসের বকেয়া শোধ করে অন্য দুধওয়ালা ঠিক করবে? উহু। রুস্তম দু’হাতের বুড়ো আঙ্গুল নাড়ে।
একদিন বোসবাবুর বাসায় দুধ দিতে যায় রুস্তম।
-ওঁয়া, ওয়া!
শিশুর কান্না। রুস্তম চমকে ওঠে। পুরানা স্মৃতির তারে কে যেন টোকা দিয়ে যায়। দোলনার মধ্যে একটি শিশু। ওঁয়া, ওয়া করছে। খিদে পেলে যেমন করত তারটি।
-ওঁয়া, ওয়া।
ঘরে কেউ নেই। শিশুর মা পুকুর ঘাটে বা আর কোথাও গেছে হয়তো।
-ওঁয়া, ওঁয়া।
শিশুটি কাঁদছে আর হাত-পা নাড়ছে। ছোট্ট হাত-পা। কচি কচি মুখ-চোখ-কান।
সেই একই রকম সব কিছু।
রুস্তম দোলনার পাশে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে। তার স্মৃতির তারে এবার কে যেন ঘন ঘন
ছড় টেনে চলেছে।
বারান্দায় টেবিলের ওপর খালি একটা দুধের বোতল। বোতলের মুখে চুন্নি। রুস্তম আর দাঁড়াতে পরে না। দুধের কলসী নিয়ে সে ছুটে বেরিয়ে যায়।
-ওঁয়া, ওঁয়া।
মানব-শিশুর এ কান্না রুস্তমের বুকের মধ্যে যেন বাসা বেঁধেছে।
অনেকদিন পরে আজ আবার রাস্তার তে-মাথায় গিয়ে দাঁড়ায় রুস্তম। তার কলসী খালি। কলসীর মুখে গামছা নেই।
৩৮/৫-ই জাহাঙ্গীর রোড (পূর্ব) করাচী
জুলাই, ১৯৫৯
Leave a Reply