মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১২ অপরাহ্ন

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ১৫ তম কিস্তি )

  • Update Time : শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪, ১২.০০ পিএম

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।


দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়


হেরম্ব খুশী হয়ে বলল, ‘তুমি তো বেশ বলতে পার আনন্দ?’ ‘

আমি বলতে পারি ছাই। এসব বাবার কথা।’
‘তোমার বাবা বুঝি খুব আত্মচিন্তা করেন?’
‘দিনরাত। বাবার আত্মচিন্তার কামাই নেই। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আজ বোধ হয় মন একটু বিচলিত হয়েছিল, এসেই আসনে বসেছেন। কখন উঠবেন তার ঠিক নেই। এক একদিন সারারাত আসনে বলেই কাটিয়ে দেন।’
মন্দিরের মধ্যে মালতী শুনতে পাবে বলে আনন্দ হেরম্বের দিকে ঝুঁকে পড়ল।
‘এই জন্য মা এত ঝগড়া করে। বলে বাড়ি বসে ধ্যান করা কেন, বনে গেলেই হয়। বাবা সত্যি সত্যি দিনের পর দিন যেন কি রকম হয়ে যাচ্ছেন। এত কম কথা বলেন যে, মনে হয় বোবাই বুঝি হবেন।’
হেরম্ব একথা জানে। অনাথ চিরদিন স্বল্পভাষী। সেরকম স্বল্পভাষী নয়, বেশি কথা কইলে দুর্বলতা ধরা পড়ে যাবে বলে যারা চুপ করে থাকে। নিজেকে প্রকাশ করতে অনাথের ভাল লাগে না। তার কম কথা বলার কারণ তাই।
মন্দিরের মধ্যে পঞ্চপ্রদীপ নেড়ে টুংটাং ঘণ্টা বাজিয়ে মালতী এদিকে আরতি আরম্ভ করে দিয়েছিল। হেরম্ব বলল, ‘প্রণামী দেবার ভক্ত কই আনন্দ?’
‘তারা সকালে আসে! দু’মাইল হেঁটে রাত করে কে এতদূর আসবে! বিকেলে আমাদের একটি পয়সা রোজগার নেই। আজ আপনি আছেন আপনি যদি কিছু দেন।’
‘তুমি আমার কাছে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছ!’
‘আমি আদায় করব কেন? পুণ্য অর্জনের জন্য আপনি নিজেই দেবেন। আমি শুধু আপনাকে উপায়টা বাতলে দিলাম।’ আনন্দ হাসল। মালতীর ঘণ্টা এই সময় নীরব হওয়ায় আবার হেরম্বের দিকে ঝুঁকে বলল, ‘তাই বলে মা প্রণাম করতে ডাকলে প্রণামী দিয়ে বসবেন না যেন সত্যি সত্যি। মা
তাহ’লে ভয়ানক রেগে যাবে।’
‘মাকে তুমি খুব ভয় কর নাকি আনন্দ?’
‘না, মাকে ভয় করি না। মা’র রাগকে ভয় করি?’
হেরম্ব এক টিপ নস্য নিল। সহজ আলাপের মধ্যে তার আত্মগ্লানি কমে গেছে।
‘আমাকে? আমাকে তুমি ভয় কর না আনন্দ?’
‘আপনাকে? আপনাকে আমি চিনি না, আপনার রাগ কি রকম জানি না। কাজেই বলতে পারলাম না।’
‘আমাকে তুমি চেনো না আনন্দ! আমি তোমার বন্ধু যে!’
আনন্দ অতিমাত্রায় বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ব্যস! শোন কথা! আপনি আমার বন্ধু হলেন কখন?’
‘একটু আগে তুমি নিজেই বলেছ। মালতী-বৌদি সাক্ষী আছে।’
আনন্দ সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘ভুল করে বলেছিলাম। আমি ছেলেমানুষ, আমার কথা ধরবেন না। কখন কি বলি-না-বলি ঠিক আছে কিছু?’
‘এরকম অবস্থায় তোমার তবে কিছু না বলাই ভাল, আনন্দ।’
‘কিছু বলছিও না আমি। কি বলেছি? চুপ করে বসে আছি। আপনার যদি মনে হয়ে থাকে আমি বেশী কথা বলছি, আপনার ভুল মনে হয়েছে জানবেন। ওই দেখুন চাঁদ উঠেছে।’
আনন্দ মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর হেরম্ব তাকায় তার মুখের দিকে। তার অবাধ্য বিশ্লেষণ-প্রিয় মন সঙ্গে সঙ্গে বুঝবার চেষ্টা করে তেজী আলোর চেয়ে জ্যোৎস্নার মতো মৃদু আলোতে মানুষের মুখ আরও বেশী সুন্দর হয়ে ওঠে কেন। আলো অথবা মানুষের চোখ, কোথায় এ
ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়?
হেরম্বের ধারণা ছিল কাব্যকে, বিশেষ করে চাঁদের আলোর কাব্যকে সে বহুকাল পূর্বেই কাটিয়ে উঠেছে। জ্যোৎস্নার একটি মাত্র গুণের মর্যাদাই তার কাছে আছে, যে এ আলো নিষ্প্রভ, এ আলোতে চোখ জ্বলে না অথচ, আজ শুধু আনন্দের মুখে এসে পড়েছে বলেই তার মতো সিনিকের কাছেও চাঁদের আলো জগতের আর সব আলোর মধ্যে বিশিষ্ট হয়ে উঠল।
হেরম্বের বিশ্লেষণ-প্রবৃত্তি হঠাৎ একটা অভূতপূর্ব সত্য আবিষ্কার করে তাকে নিদারুণ আঘাত করে। কবির খাতা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও যে কবিতা নেই, কবির জীবনে পর্যন্ত নয়, তার এই জ্ঞান পুরোনো। কিন্তু এই জ্ঞান আজও যে তার অভ্যাস হয়ে যায়নি, আজ হঠাৎ সেটা বোঝা গেছে। কাব্যকে অসুস্থ নার্ভের টঙ্কার বলে জেনেও আজ পর্যন্ত তার হৃদয়ের কাব্যপিপাসা অব্যাহত রয়ে গেছে, প্রকৃতির সঙ্গে তার কল্পনার যোগসূত্রটি আজও ছিড়ে যায়নি। রোমান্সে আজও তার অন্ধবিশ্বাস, আকুল উচ্ছ্বসিত হৃদয়াবেগ আজও তার কাছে হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ পরিচয়, জ্যোৎস্না তার চোখের প্রিয়তম আলো। হৃদয়ের অন্ধ সত্য এতকাল তার মস্তিষ্কের নিশ্চিত সত্যের সঙ্গে লড়াই করেছে। তার ফলে, জীবনে কোন দিকে তার সামঞ্জস্য থাকেনি, একধার থেকে সে কেবল করে এসেছে ভুল। দুটি বিরুদ্ধ সত্যের একটিকে সজ্ঞানে আর একটিকে অজ্ঞাতসারে একসঙ্গে মর্যাদা দিয়ে এসে জীবনটা তার ভরে উঠেছে শুধু মিথ্যাতে। তার প্রকৃতির যে রহস্ত, যে দুর্বোধ্যতা সম্মোহনশক্তির মতো মেয়েদের আকর্ষণ করেছে, সে তবে এই? রূঢ় বেদনা ও লজ্জার সঙ্গে হেরম্ব নিজেকে এই প্রশ্ন করে।
মিথ্যার প্রকাণ্ড একটা স্তূপ ছাড়া সে আর কিছুই নয়, নিজের কাছে এই জবাব সে পায়।
আনন্দের মুখ তার চোখের সামনে থেকে মুছে যায়। আত্মোপলব্ধির প্রথম প্রবল আঘাতে তার দেখবার অথবা শুনবার ক্ষমতা অসাড় হয়ে থাকে। এ সহজ কথা নয়। অন্তরের একটা পুরোনো শবগন্ধি পচা অন্ধকার আলোয় ভেসে গেল, একদা নিরবচ্ছিন্ন দুঃস্বপ্নের রাত্রি দিন হয়ে উঠল। এবং তা অতি অকস্মাৎ। এরকম সাংঘাতিক মুহূর্ত হেরম্বের জীবনে আর আসেনি। এতগুলি বছর ধরে তার মধ্যে দু’জন হেরম্ব গাঢ় অন্ধকারে যুদ্ধ করেছে, আজ আনন্দের মুখেলাগা চাঁদের আলোয় তারা দৃশ্যমান হয়ে ওঠায় দেখা গেছে শত্রুতা করে পরস্পরকে দু’জনেই তারা ব্যর্থ করে দিয়েছে। হেরম্বের পরিচয়, ওদের লড়াই। আর কিছু নয়। ফুলের বেঁচে থাকবার চেষ্টার সঙ্গে কীটের ধ্বংসপিপাসার দ্বন্দ্ব, এই রূপকটাই ছিল এতকালের হেরম্ব।
সমারোহের সঙ্গে দিনের পর দিন নিজের এই অস্তিত্বহীন অস্তিত্বকে সে বয়ে বেড়িয়েছে। চকমকির মতো নিজের সঙ্গে নিজেকে ঠুকে চারিদিকে ছড়িয়ে বেড়িয়েছে আগুন। কড়িকাঠের সঙ্গে দড়ি বেঁধে গলায় ফাঁস লাগিয়ে সে-ই উমাকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। সে খুনী!
হেরম্ব নিঝুম হয়ে বসে থাকে। জীবনের এই প্রথম ও শেষ প্রকৃত আত্মচেতনাকে বুঝেও আরও ভাল করে বুঝাবার চেষ্টায় জালটানা পচা পুকুরের উত্থিত বুদবুদের মতো অসংখ্য প্রশ্ন, অন্তহীন স্মৃতি তার মনে ভেসে ওঠে।
আনন্দ ছ’বার তার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলে তবে সে তার কথা শুনতে পায়।
‘কি ভাবছি? ভাবছি এক মজার কথা, আনন্দ।’
‘কি মজার কথা?’
‘আমি অন্যায় করে এতদিন যত লোককে কষ্ট দিয়েছি, তুমি আমাকে তার উপযুক্ত
শাস্তি দিলে।’
এই হেঁয়ালিটি নিয়ে আনন্দ পরিহাস করল না।
‘বুঝতে পারলাম না যে। বুঝিয়ে বলুন।’
‘তুমি বুঝবে না আনন্দ।’
‘বুঝব। আমি কি করেছি, আমি তা বুঝব। যত বোকা ভাবেন আমি
তত বোকা নই।’
হেরম্ব বিষণ্ণ হাসি হেসে বলল, ‘তোমার বুদ্ধির দোষ দিইনি। কথাটা বুঝিয়ে বলবার মতো নয়। আমার এমন খারাপ লাগছে আনন্দ।’

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024