বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৩ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৩৫)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৪, ১১.০৩ এএম
রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি
আমার নানাবাড়ি ছিল আমাদের বাড়ি গোবিন্দপুর হইতে আট মাইল দূরে তাম্বুলখানা গ্রামে। এত দূরের গ্রাম হইতে নববধূটি হইয়া কি করিয়া মা আমাদের বাড়ি আসিয়াছিলেন, কে সেই নববধূটিকে প্রথম বরণ করিয়া ঘরে লইয়াছিলেন, কে সেই বনজঙ্গলে ঘেরা দেশের মেয়েটির খবর আমাদের এত দূরের দেশে প্রথম আনিয়াছিলেন এসব খবর এখন আর জানিবার উপায় নাই। আজ আবছা আবছা মনে পড়িতেছে, আমার এক দুর-সম্পর্কের মামা সোয়ারি বেহারা সঙ্গে করিয়া মাকে নিতে আসিতেন। মায়ের বেতের ঝাঁপিতে একখানা মাত্র বেগুনি রঙের বেনারসি শাড়ি ছিল। সেই শাড়িখানা পরিয়া মা সোয়ারিতে যাইয়া বসিতেন। সোয়ারির চারিধারে কাপড় দিয়া ঘিরিয়া দেওয়া হইত। মায়ের আয়না, চিরুনি, তেলের শিশি প্রভৃতি টুকিটাকি জিনিসগুলি সুন্দর একটি বেতের সাজিতে ভরিয়া সোয়ারির বাঁশের সঙ্গে ঝুলাইয়া রাখা হইত।
মা রওয়ানা হইবার আগে এ-বাড়ি ও-বাড়ি হইতে গ্রাম্য বধুরা মা’র সঙ্গে দেখা করিতে আসিত। বাপের বাড়ি যাওয়ার আনন্দে মা যেন ছোট্ট খুকিটি হইয়া পড়িতেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে একথা সেকথায় দেরি হইলে সোয়ারি-বেহারারা তাড়া লাগাইত। সেই তাড়া মা’র হাসিখুশি মুখখানিতে আরও হাসিখুশি মাখাইত। সোয়ারির বাঁশে সালাম করিয়া মা সোয়ারিতে উঠিতেন। তারপর বেহারারা সোয়ারি কাঁধে লইয়া রওয়ানা হইত। আমি আর ওফাজদ্দী মামু সোয়ারির পাছে পাছে যাইতাম। গোবিন্দপুরের গ্রাম ছাড়াইয়া শোভারামপুরের গ্রাম। মধ্যে ছোট গাড়। বাঁশের সাঁকোতে সেই গাহ্ পার হইয়া নদীর তীর দিয়া পথ। গাঙ্ তো নয়, পল্লীবাসীদের খেলাইবার একটি ঝুমঝুমি।
এর কোথাও সরু জলধারা এক হাঁটুর উপরে গভীর নয়। গ্রামের উলঙ্গ ছেলেমেয়েরা সেখানে কেহ মাছ ধরিতেছে, কেহ ঝুপুরি খেলিতেছে। গাঙের মাঝে মাঝে খানিক ছড়াইয়া গিয়া কুম হইয়াছে। সেখানে গভীর জল। আমাদের গ্রাম মুসলমান-প্রধান বলিয়া নদীতে মেয়েরা স্নান করিতে আসে না। এ-নদীর দুই পাশে হিন্দুপাড়া। সেখান হইতে দল বাঁধিয়া বধূরা নদীতে জল লইতে আসে। নদীর ঘাটে বসিয়া কেহ স্নান করে, কেহ কাপড় ধোয়, সখীতে সখীতে হাসাহাসি করিয়া এ ওর গায়ে কলসীসুদ্ধ পানি ঢালিয়া দেয়। কেহ ইচ্ছা করিয়া পথে আছাড় খাইয়া পড়ে। আর সব বধূরা হাসিয়া খুন হয়। নদীও যেন ওদেরই মতো হাসি-মুখরা মেয়ে। তাই ওদের বুকে পাইয়া আপনার জলধারা নাচাইয়া কূলে কূলে ঢেউ তুলিয়া ওদের ক্ষণিকের ক্রীড়া-কৌতুককে আরও সুন্দর করিয়া তোলে। কত রঙের শাড়িই না পরিয়া আসে বউরা। সমস্ত নদীতটে যেন আকাশের খণ্ড খণ্ড মেঘেরা আসিয়া ভিড় করিয়াছে।
আজকালের মেয়েরা পোশাক-পরিচ্ছদে রঙের অত বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। পুরুষের অঙ্গাভরণ হইতে তো কবেই রঙের বৈচিত্র্য চলিয়া গিয়াছে। আগেকার দিনে গ্রামের পুরুষেরা বড় বেশি জামাকাপড় পরিত না; কিন্তু কাঁধের গামছায়, গায়ের আলোয়ানে, পরনের কাপড়ে কত রংই না খেলা করিত। মেয়েদের শাড়ির রঙের রকমারির তো কথাই ছিল না। সাত আকাশের যত বং তাহাদের শাড়িতে সোয়ার হইয়া সমস্ত গ্রামে ঘুরিত ফিরিত।
সেই ছোট গাঙের পথ পারাইয়া আসিতাম গোয়াল চামটের রাস্তায়। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি বড় বড় ঝাউগাছ। দূর হইতে সেই ঝাউগাছে বাতাসের শোঁসানি শুনিয়া বুকের মধ্যে যেন কেমন করিয়া উঠিত। সেখানে সোয়ারি বেহারারা খানিকটা জিড়াইয়া লইত। তারপর ডোমরাকান্দির পথ। দু’ধারে কত জঙ্গল। মাঝে মাঝে চার-পাঁচখানা বাড়ি। সেই বাড়িগুলি হইতে বধুরা আমার মায়ের সোয়ারির দিকে চাহিয়া থাকে। কেহ কেহ বেহারাদিগকে বলে, একটু জিড়াইয়া তামুক খাইয়া যাও। এক দেশের মেয়ে আর এক দেশের মেয়ের সঙ্গে মিতালি করিতে চায়। হয়তো নিজেদের একঘেয়ে জীবনের মধ্যে একটু বৈচিত্র্য আনিতে প্রয়াস পায়। বেহারারা কথা শোনে না। সামনের রাস্তা ধরিয়া মায়ের সোয়ারি নাচিয়া নাচিয়া যায়।

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024