বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৩৭)

  • Update Time : শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৪, ১১.০৩ এএম

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

কতরকম খাবার করিয়া রাখিয়াছেন নানি। তিলে-পাটালি সেই কবে শীতকালে করিয়া রাখিয়াছিলেন। বাতাসে গলিয়া যায় তাই মুড়ির কোলার মধ্যে ভরিয়া রাখিয়াছেন। ঢ্যাপের মোয়া, নারকেলের লাডু, ঘরের গরুর ঘন-আওটা দুধ, পাকা সিন্দুরে-গাছের আমের গোলা। নানি মার মুখে তুলিয়া দিতে যান। মা আমাকে দেখিয়া লজ্জা পান। নানির হাতখানা আমার মুখের দিকে বাঁকাইয়া ধরেন। মা যেন আজ এতটুকু হইয়া গিয়াছেন। আমার চাইতেও ছোট। ছোট বলিয়াই কি এত আদর করিতে হয়? আমরাও তো ছোট-আমাদের কে এমন করিয়া আদর করে।
খাইতে খাইতে ও-বাড়ি হইতে তাহেরের মা আসিল, ফেলি আসিল, মোকিমের বউ আসিল। ও রাঙাছুটু। কেমন আছিস? এই আসিলি বুঝি? আমি ভুলি দেখিয়াই বুঝিয়াছি তুই আসিতেছিস। তারপর কত কথা-কত হাসি-কত তামাশা। সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। ও-বাড়ির তাহের আসিল-তাহেরের ভাই গেদা আসিল। এখনই যাইব বাঁশঝাড় হইতে ছিপ কাটিতে। তল্লা-বাঁশের ফাঁপ দিয়া বাঁশি বানাইব। মামাবাড়ির সমস্ত রহস্য রাত আসিয়া তাহার অন্ধকারের পাখায় ঢাকিয়া ফেলিল। এখন আর বনে যাওয়া হইবে না। গেদা, তুই খুব ভোরে উঠিস। গরীবুল্লা মাতবরের ছেলে নিহাকেও ডাক দিয়া আনিস।
সারাদিন হাঁটায় শ্রান্ত ক্লান্ত হইয়া দুই চোখ ঘুমে জুড়াইয়া আসে। নানি তাড়াতাড়ি খাওয়াইয়া বিছানায় শোওয়াইয়া দেন। মা’র সঙ্গে নানি কিন্তু গল্প করিতেই থাকেন। কি গল্পেই পাইয়াছে তাঁদের দুইজনকে। আমি ঘুমাইতে ঘুমাইতে শুনি। “হ্যাঁরে। সেখানে কি তোকে খুব কাজ করিতে হয়?” মা উত্তর করেন, “না, মা। একার সংসার, কতটুকুই বা কাজ। করিয়া ফেলিয়াই বসিয়া বসিয়া গল্প করি!” “হ্যাঁরে। পেট ভরিয়া তো খাইতে পাস? এটা-ওটা ভালো খাবার বাড়িতে হইলে নিজে খাস তো?” মা উত্তর করেন, “মা। তোমার হইয়াছে কি আজ? পেট ভরিয়া খাই না, তবে এত মোটা হইয়া আসিলাম কেমন করিয়া? সেখানে ধান চাউলের ছড়াছড়ি। শ্বাশুড়ি নাই ননদি নাই। যা রান্দিবাড়ি ওদের খাওয়াইয়াই নিজে খাই।” নানি বিশ্বাস করেন না। “কই মোটা হইয়া আসিয়াছিস? তোর সমস্ত গা যে শুকনা কাঠের মতো দেখিতে হইয়াছে।”
শুইয়া শুইয়া ভাবি, মা আমার কি মিথ্যাবাদী। একদিনও তো মাকে ভালো মাছখানা খাইতে দেখিলাম না। পিঠা বানাইলে আমরা খাইয়া থুইয়া ঠাণ্ডা দুই-এক টুকরা অবশিষ্ট যা থাকে তা-ই তো মা খায়। মিথ্যা বলিলেও মাকে আজ বড় ভালো লাগিল। শত হইলেও সেটা আমাদের বাড়ি। আমাদের বাড়ির নিন্দার কথা কি এখানে বলা উচিত হইবে?
ভোর না হইতেই ঘুম ভাঙিয়া যায়। সামনের বনে কতরকমের পাখি ডাকিতেছে। আমরা নদীর দেশের লোক। আমাদের ওখানে তো এসব পাখি ডাকে না। কতরকমের সুর করিয়া ডাহুক ডাকিতেছে, কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক কোড়া ডাকিতেছে, কুয়া-কুয়া-কুয়া। মাঝে মাঝে কাঠঠোকরা গাছের ডালে ঠোকর মারিতেছে। কোনো পাখি ডাকিতেছে, কির-রর রি-রি, কানাকুয়া ডাকিতেছে টুব, টুব, টুব। আমার যেন কেমন ভয় ভয় লাগে। ঘরের বেড়া দিয়া সূর্যের আলো আসিতেছে। নানা উঠিয়া ভোরের আজান দিলেন। কালকের কথামতো গেদা আসিয়া উঠানে দাঁড়াইয়াছে, “ও জসী।”

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024