শেষরাত্রে বাঘ আসিয়া নানাবাড়ির পূবধারের জঙ্গলে তর্জন-গর্জন করিতে লাগিল। সে কি যেমন-তেমন শব্দ। ভয়ে আমি মায়ের আঁচল টানিয়া ধরি। নানা-নানি উঠিয়া প্রদীপ জ্বালাইয়া বসিয়া রহিলেন। বাঘ জঙ্গল ছাড়িয়া নানাবাড়ির উঠানে আসিয়া গর্জন করিতে লাগিল। সেই গর্জনে নানাবাড়ির ঘরগুলি কাঁপিতে লাগিল। নানার একটি পোষা কুকুর ছিল। বাড়িতে চোর-ডাকাত আসিলে সে রাগিয়া যাইয়া তাহাদের ঘাড়ে পড়িত। আজ এই বিপদের সময় প্রভুভক্ত কুকুরটি চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না। সে শব্দ করিয়া বাঘের উপর যাইয়া পড়িল। সে কি ভীষণ গর্জন। বাঘ একবার কুকুরটিকে ছাড়িয়া যায় আবার দ্বিগুণ গর্জন করিয়া তাহাকে আসিয়া ধরে। প্রায় দশ মিনিট বাঘে-কুকুরে লড়াই চলিল। তারপর কুকুরটির শব্দ ধীরে ধীরে কমিয়া আসিতে লাগিল। বাঘের গর্জন আরও বাড়িতে লাগিল। তারপর আর কুকুরের ডাক শোনা গেল না।
ভোর হইবার প্রায় এক ঘণ্টা পরে নানার সঙ্গে আমরা ঘরের দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিলাম। তখন বাঘের গায়ের চক্করের মতো থাবা থাবা রৌদ্র গাছের ফাঁক দিয়া নানার উঠানে আসিয়া পড়িয়াছে। উঠানে আসিয়া নানি কাঁদিয়া উঠিলেন, তাঁর এত আদরের পোষা কুকুরটির জন্য। সমস্ত উঠান ভরিয়া ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়িয়া আছে। নানির পোষা কুকুরটি যেন রাঙা আখরে বিদায়পত্র লিখিয়া গিয়াছে।
কিছুক্ষণ পরে বাজান আসিলেন। আমার পিতাকে কোনোদিন শ্বশুরবাড়ি রাত্র যাপন করিতে দেখি নাই। খুব ভোরে রাত্র থাকিতে তিনি বাড়ি হইতে রওয়ানা হইতেন আবার ফিরিয়া যাইয়া স্কুলের কাজে যোগ দিতেন। যা কিছু খাবার আছে খাইয়া বাজান চলিয়া গেলেন। বলিয়া গেলেন, আর তিনদিন পরে মাকে লইয়া যাইবার জন্য-আফাজদ্দীন আসিবে। নানি কত অনুনয়-বিনয় করিলেন, নানা কতরকম বুঝাইলেন, “এই তো সেদিন মাত্র আসিয়াছে রাঙাছুটু। এখনও ভালো দুইটা কিছু তৈরি করিয়া মেয়েকে খাওয়াইতে পারিলাম না। আর দিনদশেক পরে রাঙাছুটুকে নিতে আসিবেন।” বাজান কোনো কথাই শুনিলেন না। বাড়িতে রান্না করিয়া দিবার লোক নাই। তাহা ছাড়া ছেলেকে ফরিদপুরের স্কুলে ভর্তি করিয়া দিতে হইবে। এখানে থাকিলে পড়াশুনা হইবে না। নানা বেচারা আর কি করিবেন? বাজানের কথায়ই সম্মত হইলেন। মাটিতে বড় বড় জুতায় পা ফেলিয়া বাজান চলিয়া গেলেন।
Leave a Reply