বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০১ পূর্বাহ্ন

জাতিসংঘের তদন্ত কি আন্দোলনকারীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে?

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৪, ৭.০৩ পিএম
জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস (ওএইচসিএইচআর) গত মাসে এক প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানায়, নিরাপত্তারক্ষীরা ‘আন্দোলন পরিস্থিতি মোকাবিলায় অপয়োজনীয় এবং অসম বল প্রয়োগ করেছে- এমন শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে৷'

বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট গণ-আন্দোলনের ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং দল৷ তাদের এই তদন্ত আন্দোলনের হতাহতের ঘটনার ন্যায় বিচার নিশ্চিতে কতটা সহযোগিতা করবে?

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম৷ বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানরত জাতিসংঘের হিউম্যন রাইটস অফিসের এই দলটি আন্দোলনের সময়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের প্রমাণাদি সংগ্রহ, দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করবে৷

গত জুলাই মাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলনটি খুব দ্রতই সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়৷ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা ওই আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ আন্দোলন হয়ে ওঠে৷ এ সময় দেশজুড়ে অনেক আন্দোলনকারী নিহত হন, আহতও হন কয়েক হাজার মানুষ৷ পুলিশ বাহিনীর গুলিতে আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী অনেক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন, বাংলাদেশ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও রয়েছে এমন অভিযোগ৷

আন্দোলনের এক পর্যায়ে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ এমন অবস্থায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন৷

জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস (ওএইচসিএইচআর) গত মাসে এক প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানায়, নিরাপত্তারক্ষীরা ‘আন্দোলন পরিস্থিতি মোকাবিলায় অপয়োজনীয় এবং অসম বল প্রয়োগ করেছে- এমন শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে৷’

সংস্থাটি আরো জানায়, ‘‘লঙ্ঘনের (মানবাধিকার) এমন অভিযোগের মধ্যে রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক গ্রেপ্তার এবং আটক, গুম, নির্যাতন, খারাপ আচরণ এবং বাকস্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা প্রদান৷”

জাতিসংঘের অনুসন্ধান এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

মারবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী সারা হোসেন জাতিসংঘের এই তদন্তের তাৎপর্যের কথা উল্লেখ করেন৷ তিনি জানান, বাংলাদেশে ব্যাপকমাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিষয়ে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের ওএইচসিএইচআর কোনো প্রতিবেদন তৈরি করছে৷

ডয়চে ভেলেকে এই আইনজীবী বলেন, অনুসন্ধানের সময় কাঠামোটি নির্যাতনে দুটি অভিযোগই তুলে ধরতে পারবে৷ একটি হলো, আন্দোলনের সময়ে চলা নির্যাতনের আর অপরটি হলো সাবেক আওয়ামী সরকারের সদসদ্যের উপর প্রতিহিংসার অভিযোগ৷

সারা হোসেনের মতে, এই প্রতিবেদনন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকারদের ক্ষতিপূরণের জন্য প্রযোজনীয় তদন্তের একটি ধারা তৈরি করবে৷

এদিকে জাতিসংঘের এই তদন্তটিকে জটিল বলে মনে করছেন দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং ওয়াশিংটনের উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারের মাইকেল কুগেলম্যান৷

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘দেশটি যেই ট্রমার মধ্য দিয়ে গিয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, এটি গুরুত্বপুণ যে, জনগণ জানে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার একটি প্রক্রিয়া জারি আছে৷ এবং বিশেষ করে এই কারণে যে, প্রায়ই রাষ্ট্রীয় পর্যাযের অপরাধের জবাবদিহতা ছিল না৷

তদন্তের চ্যালেঞ্জ

তদন্ত পরিচালানা করতে গিয়ে জাতিসংঘের দলটি নির্যাতনে শিকার ব্যক্তি, ডাক্তার এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছে৷ তবে জাতিসংঘ জানায়, তারা কোনো ‘অপরাধ বিষয়ক তদন্ত করছে না’ এবং তারা জাতীয় পর্যায়ের কোনো বিচার প্রক্রিয়ার সাথে নয় বরং স্বাধীনভাবে কাজ করছে৷

সারা হোসেন এবং কুগেলম্যানও এই সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন৷ তাদের মতে, এই তদন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের পুরো পরিসরটি প্রকাশ না-ও করতে পারে৷

আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, তারা (জাতিসংঘের দল) কোনো চূড়ান্ত ফলাফলে পৌঁছাতে পারবে না৷ কারণ, অপরাধ বিষয়ক তদন্তের জন্য যেই মানের প্রমাণাদি প্রয়োজন, তা তারা ব্যবহার করছে না৷

কুগেলম্যান সতর্ক করে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হয়তে জাদিসংঘের দলটিকে সগযোগিতা করতে পারে, কিন্তু তার আগের সরকার এবং এর সমর্থকেরা এই বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে স্বচ্ছ না-ও হতে পারে৷”

কুগেলম্যান অবশ্য এই বিষয়ে জাতিসংঘের আইনি কর্তৃত্বের ঘাটতির কারণে এর প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়তে পারে বলেও মন্তব্য করেন৷

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘শেখ হাসিনার বিষয়েও একটি জটিল পরিস্থিতি রয়েছে৷ তদন্তের জন্য তার সাথে যোগাযোগের সুযোগ নতুন দিল্লি দেবে কি না সে বিষয়টি পরিস্কার নয়৷ তাছাড়া, তিনি সহযোগিতা করবেন কিনা সেটিও পরিস্কার নয়৷ কারণ, ভারতের শেখ হাসিনা সরকারের প্রশাসনের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক ছিল৷”

তদন্ত নিয়ে সন্দিহান নির্যাতনের শিকার পরিবারেরা

ডয়চে ভেলেকে নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবার জানায়, তারা জাতিসংঘের দলটি সাথে যোগাযোগে রয়েছেন৷

তাদের একজন মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত৷ দীপ্তর ভাই মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ আন্দোলনের সময় ১৮ জুলাই  গুলিতে নিহত হন৷ নিহত হওয়ার আগে আন্দোলনকারীদের পানি সরবরাহ করছিলেন মুগ্ধ৷ দীপ্ত জানান, তার ভাইয়ের নিহত হওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘের দলটিকে তিনি কিছু তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন৷

ডয়চে ভেলেকে দীপ্ত বলেন, ‘‘জাতিসংঘের এই দলটির বিষয়ে আমি খুব বেশি আশাবাদী নই, কারণ, তারা অপরাধের তদন্ত করছে না৷ তারা শুধুমাত্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো তদন্ত করছে৷ আলাদাভাবে অপরাধের ঘটনাগুলো নিয়ে তারা তদন্ত করছে না৷ আমার মনে হয়, গণ-আন্দোলনের সময়ে যেই পরিসরে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার পুরোটা এখনো তারা পায়নি৷”

আন্দোলন চলার সময়ে ৪ আগস্ট গুলিতে নিহত হন ১৭ বছরের গোলাম নাফিজ৷ নিহতের বাবা গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, আইনজীবীর মাধ্যমে জাতিসংঘের দলের সাথে তার যোগাযোগ হয়েছে৷

তিনি বলেন, ‘‘আমরা চাই জাতিসংঘের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার হোক৷ আমরা আশা করি, এ বিষয়ে তারা একটি পরিপূর্ণ প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবে৷”

বিচার নিশ্চিতে সমন্বিত পদক্ষেপ চায় পরিবারগুলো

রাহমান এবং দীপ্তর চাওয়া, এসব ঘটনায় নির্দিষ্ট সন্দেভাজনদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হোক৷ তাদের মতে, বেনামী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা প্রায়ই আলোর মুখ দেখে না৷ অপরাধীদের চিহ্নিত করতে তারা জাতিসংঘ এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানান৷

ডয়চে ভেলেকে দীপ্ত বলেন, ‘‘আমরা আশা করেছিলাম, অন্তর্বতী সরকার প্রমাণগুলো সুরক্ষিত করবে, যেন প্রক্রিয়াটি নষ্ট হয়ে না যায়৷ কিন্তু এটি হয়নি৷”

ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এখনো কোনো মামলা করেননি কিন্তু দীপ্তর আশা, সিসিটিভি ফুটেজ ব্যবহার করে জাতিসংঘের তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা যাবে৷ এ বিষয়ে জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বেনামাী সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করতে চাই না৷”

উল্লেখ্য, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং দলের তদন্তে উঠে আসা মূল বিষয়গুলো নিয়ে একটি মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করবে ওএইচসিএইচআর৷ প্রতিবেদনে কিছু পরামর্শও প্রদান করবে তারা৷

ডিডাব্লিউ ডটকম

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024