রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৫ অপরাহ্ন

চা শ্রমিকদের জীবন: যৎসামান্য বেতনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম

  • Update Time : শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৪, ১২.৪১ পিএম
চা বাগানের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এখন মাত্র ১৭০ টাকা৷ তাও ঠিকমত পান না তারা

সমীর কুমার দে

তাদের অনেকের দিন কেটেছে একবেলা পান্তা খেয়ে। কারো কারো একবেলার আহারও জোটেনি এতদিন৷ অবশেষে মিলেছে এক সপ্তাহের বেতন। এখনও বাকি ১২ সপ্তাহের বেতন।”আমরা অনেক কষ্টে থাকি, যা টাকা পাই সেটা দিয়ে কোনোমতে দিন পার করি। সেটাও যখন পাই না, তখন চলবো কিভাবে? আমাদের কি পেট নেই? না খেয়ে থাকবো?” ডয়চে ভেলেকে কথাগুলো বলছিলেন মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ফুলতলা চা বাগানের শ্রমিক গায়েত্রী বুনার্জি।

ফুলতলা চা বাগানের প্রায় দেড় হাজার শ্রমিকের কায়ক্লেশে বয়ে চলা জীবনের অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি৷

দুর্গা পূজার আগে অন্তত বোনাস আর কিছুটা বেতন পেয়ে আপাতত একটু নিশ্চিন্ত তিনি। তবে দ্রুত বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবি থেকে তিনি সরেননি৷ সরার আসলে উপায়ও নেই, দিনের পর দিন বেতন না পেলে তারা চলবেন কী করে?

ফুলতলা চা বাগানে তিন মাস বেতন বকেয়া রেখে শ্রমিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই গত ২৮ আগস্ট বাগান ৮ অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধ করে দেয় মালিক পক্ষ। মালিকদের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ নামেন শ্রমিকরা। পরে জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বাগান চালু রাখা হয়। এখন শ্রমিকরা আবার নিয়মিত কাজ করেন। দ্য নিউ সিলেট টি এস্টেটস লিমিটেড নামে এই বাগানটির মালিক মো. রফিক থাকেন লন্ডনে।

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা যখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না, তখন ইউএনও’র নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়। সেখানে এসি ল্যান্ড, ওসিসহ সবাই ছিলেন। আমরা বলেছি, বাগান চলবে, মালিককে বেতন দিতে হবে। আমরা পুজোর আগে বোনাস ও বেতনের একটা অংশ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলাম। কর্তৃপক্ষ আমাদের কথা শুনেছে। আশা করি, দ্রুতই বাকি বেতনও হয়ে যাবে।”

ফুলতলা চা বাগানের প্রায় দেড় হাজার শ্রমিকের কায়ক্লেশে বয়ে চলা জীবনের অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি

এক সপ্তাহের বেতন পাওয়ার পর বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি রবি বুনার্জি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কর্তৃপক্ষ যখন আমাদের সঙ্গে কথা না বলে বেতন বকেয়া রেখে বাগান বন্ধ করে দিলো, তখন আমরা বারবার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কাউকে পাইনি। ওই সময়ই আমাদের ১২ সপ্তাহের বেতন বকেয়া ছিল। শেষ পর্যন্ত যে পুজোর আগে এক সপ্তাহের বেতন আর বোনাসটা দিয়েছে, তাতেই আমরা খুশি। সত্যি দাদা, আমরা খুবই কষ্টে ছিলাম।”

ফুলতলা বাগানের ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) শিহাব উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমাদের মালিক লন্ডনে থাকেন। করোনার আগে তিনি নিয়মিত আসতেন। এখন উনি মাঝেমধ্যে আসেন। আসলে আমরা ব্যাংক থেকে টাকা পাচ্ছি না। ফলে সংকটে পড়েছি। তারপরও গত মঙ্গলবার প্রায় সোয়া কোটি টাকার বোনাস দেওয়া হয়েছে। একজন শ্রমিক ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। এরপর বুধবার এক সপ্তাহের বেতন দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রায় ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এখন বাগানে প্রায় ৯-১০ কোটি টাকা বকেয়া আছে।”

হঠাৎ করে এমন সংকট দেখা দেয়ার কারণ জানতে চাইলে শিহাব উদ্দিন বলেন, “উৎপাদন খরচ আর বিক্রির সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছে না। প্রতি মাসেই লস দিতে হচ্ছে। চায়ের দাম না বাড়ালে এখন তো আমরা সংকটে পড়েছি, কয়েকদিন পর অন্যরাও সংকটে পড়বেন। আবার ব্যাংকগুলো টাকা দিচ্ছে না। ফলে বাগান চালানো মুশকিল হয়ে গেছে।”

তবে শিহাব উদ্দিনের এই দাবির সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নিপেন পাল। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “চা বাগানের মালিকরা একশ’ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বাগানে নিয়ে যায় সামান্যই। বাকি টাকা অন্য বাবসায় বিনিয়োগ করে। ফলে চা বিক্রির টাকা ব্যাংকের ঋণ দিতেই চলে যায়। বঞ্চিত হন শ্রমিকরা। মালিকরা সব সময় শ্রমিকদের বঞ্চিত করে লাভের চেষ্টা করেন। আমরা কিন্তু মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসককে স্মারক লিপি দিয়ে বলেছি, মালিক যদি শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারেন, তাহলে তাদের লিজ বাতিল করুন। কারণ, এই সম্পত্তির মালিক তো সরকার।”

শুধু মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ফুলতলা চা বাগান নয়, প্রায়ই কোন না কোন চা বাগানে শ্রমিকদের মজুরী বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকরা আন্দোলন করেন, এরপর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এই মুহুর্তে ফুলতলা চা বাগান ছাড়াও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ন্যাশনাল টি কোম্পানির চা-বাগানে ২০ দিন ধরে মজুরি পাচ্ছেন না শ্রমিকেরা। আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের বোনাস দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আশা করি বেতনও হয়ে যাবে।”

জানা গেছে, মজুরি না পাওয়ায় অনেক কষ্টে দিনযাপন করতে হচ্ছে শ্রমিকদের। মজুরির দাবিতে চা-বাগানের শ্রমিকেরা পরপর দুই দিন কর্মবিরতি পালন করে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করছেন। মানবন্ধনে শ্রমিক নারদ পাসী বলেন, “ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) মালিকানাধীন পাত্রখোলা, মদনমোহনপুর, চাম্পারায়, বাঘাছড়া, পদ্মছড়া চা-বাগানের শ্রমিকেরা ২০ দিন ধরে বেতন-ভাতা, রেশন ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। কত কষ্ট করে প্রতিদিন শ্রমিকেরা কাজ করে যাচ্ছেন, কিন্তু মজুরি বন্ধ করে রাখা হয়েছে।” মানবন্ধনে চা-শ্রমিক সবিতা বাউরী বলেন, “ঘরে কোনো খাবার নেই, মজুরি বন্ধ দুই সপ্তাহের ওপরে। হাতে টাকাও নেই, পরিবারের লোকজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। আমরা খুবই কষ্ট করে জীবন চালাচ্ছি।”

শুধু মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ফুলতলা চা বাগান নয়, প্রায়ই কোনো না কোনো চা বাগানে শ্রমিকদের মজুরি বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকরা আন্দোলন করেন, এরপর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এই মুহুর্তে ফুলতলা চা বাগান ছাড়াও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ন্যাশনাল টি কোম্পানির চা-বাগানে ২০ দিন ধরে মজুরি পাচ্ছেন না শ্রমিকেরা। আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের বোনাস দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আশা করি বেতনও হয়ে যাবে।”

মজুরি না পাওয়ায় অনেক কষ্টে দিনযাপন করতে হচ্ছে শ্রমিকদের। মজুরির দাবিতে চা-বাগানের শ্রমিকেরা পরপর দুই দিন কর্মবিরতি পালন করে মানববন্ধন ও প্রতিবাদসভা করেছেন। মানবন্ধনে শ্রমিক নারদ পাসী বলেন, “ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি)-র মালিকানাধীন পাত্রখোলা, মদনমোহনপুর, চাম্পারায়, বাঘাছড়া, পদ্মছড়া চা-বাগানের শ্রমিকেরা ২০ দিন ধরে বেতন-ভাতা, রেশন ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। কত কষ্ট করে প্রতিদিন শ্রমিকেরা কাজ করে যাচ্ছেন, কিন্তু মজুরি বন্ধ করে রাখা হয়েছে।” মানবন্ধনে চা-শ্রমিক সবিতা বাউরী বলেন, “ঘরে কোনো খাবার নেই, মজুরি বন্ধ দুই সপ্তাহের ওপরে। হাতে টাকাও নেই, পরিবারের লোকজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। আমরা খুবই কষ্ট করে জীবন চালাচ্ছি।”

বাগানেই সীমাবদ্ধ শ্রমিকদের জীবন

ভোরবেলাতেই ঘুম থেকে উঠতে হয় চা শ্রমিকদের। একমুঠ মুড়ি আর এক কাপ চা খেয়ে কাজে নেমে পড়েন শ্রমিকরা। কাঠফাটা রোদে দিনভর সংগ্রহ করেন চা পাতা। দুপুরে এক ফাঁকে চা পাতার চাটনি মেখে খান ভাত, কখনো সঙ্গে থাকে মুড়ি কিংবা চানাচুর। এভাবেই কাটে চা শ্রমিকের জীবন। বৃষ্টিতে ভিজে, খালি পায়ে, জোঁক আর বিষাক্ত সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে চা বাগানকে আঁকড়ে জীবন পার করছেন তারা। সবুজ কুঁড়িবেষ্টিত চা বাগানের সীমানাতেই আটকে আছে তাদের জীবন।

বংশ পরম্পরায় যে জমিতে চা শ্রমিকরা বসবাস করেন, সেই জমির ওপর কখনোই মেলে না অধিকার। তাই মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ধরে রাখতে হলে পরিবারের কাউকে না কাউকে বাগানে কাজ করতেই হয়। দিনশেষে ২৩ কেজি পাতা তুললেই তবে পূরণ হয় মাথাপিছু লক্ষ্যমাত্রা। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেই তবে ‘হাজিরা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। গাছ ছাঁটার সময় সারা দিনে অন্তত ২৫০টা চা গাছ ছাঁটতে হয়। কীটনাশক ছিঁটানোর বেলায় সারা দিনে অন্তত ১ একর জমিতে কীটনাশক ছিঁটানোর লক্ষ্যমাত্রার বোঝা কাঁধে নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। প্রত্যেক বছর শ্রমিক দিবস এলে ঘটা করে পালন করা হয় দিনটি। কিন্তু চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের জীবনচক্র আটকে ফেলেছেন চা বাগানের গণ্ডির মধ্যেই।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নিপেন পাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, “শ্রমিকদের যে সুবিধা দেওয়ার কথা, তার যদি ৮০ ভাগও শ্রমিকরা পেতেন, তাহলে শ্রমিকদের জীবন বদলে যেতো। এখন ৫০ ভাগ সুবিধাও পান না শ্রমিকরা। শ্রমিকদের জীবন বদলে দেওয়ার জন্য আমরা সংগ্রাম করে যাচ্ছি।”

হবিগঞ্জের দেউন্দি চা বাগানের বলরাম সাঁওতাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, “পৃথিবীর কোথাও এমন মজুরিতে কাজ করা শ্রমিক আছে বলে মনে হয় না। ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুকে পাত্তা দেওয়া যাবে না। মাথায় ছই (ছাতা) আর পেছনে ঝাঁকি নিয়ে বাগানে যেতে হবে। কোনো কিছুই আমাদের পেটে ভাত দেবে না, কুঁড়ি তুললেই তবে ভাত জুটবে। বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে একজন শ্রমিকের মজুরি হিসাব করলে কোনোভাবেই মেলে না।”

আগে শ্রমিকরা ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন। ২০২৩ সালের আগস্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অনুগ্রহে’ তাদের দৈনিক মজুরি ৫০ টাকা বাড়ে। ফলে তাদের দৈনিক মজুরি দাঁড়ায় ১৭০ টাকায়। মজুরি নির্ধারণ নিয়ে যখন চা শ্রমিকদের আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর শেখ হাসিনা ৫০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেন।

এর আগে স্থানীয় প্রশাসন ও শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের চা শ্রমিক নেতাদের বৈঠকের পর ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা দৈনিক মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকদের একটি অংশ তাতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও বেশিরভাগ শ্রমিক তাতে রাজি হননি। পরে ৫০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। সর্বশেষ ২০২০ সালে যখন চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাগান মালিকদের সংগঠন চা সংসদ মজুরি নিয়ে চুক্তি করেছিল, সেই সময় মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।

প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ ভারতের বাংলাদেশ অংশে প্রথম বাণিজ্যিক-ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয় সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে, ১৮৫৪ সালে। বাংলাদেশ চা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬৭টি। এর বড় অংশটি সিলেট, হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার এলাকায় অবস্থিত। এসব বাগানে এক লাখ ৪০ হাজারের মতো শ্রমিক রয়েছে।

ডিডাব্লিউ ডটকম

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024