রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৫ অপরাহ্ন

ঢাকা ও নিকটবর্তী এলাকার ১০টি ঐতিহাসিক মন্দির

  • Update Time : শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৪, ৭.৩৬ পিএম
ঢাকেশ্বরী মন্দির (ছবি: উইকিপিডিয়া)

জনাকীর্ণ নগরী ঢাকার শত বছরের ইতিহাসের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এর আনাচে-কানাচে এখনও টিকে থাকা মন্দিরগুলো। তীর্থস্থানগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতিফলন। একই সঙ্গে স্থাপনাগুলো তৎকালীন সময়ের স্থাপত্যশৈলীর নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অধিকাংশগুলোতে এখনও পালিত হয় ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠান। চলুন, ঢাকা ও নিকটবর্তী এলাকার এমনি ১০টি মন্দির সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

ঢাকা ও আশেপাশের এলাকার ১০টি প্রাচীন মন্দির

.ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির

রাজধানীর পলাশীতে অবস্থিত বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বৃহত্তম এই উপাসনালয়টি ঢাকার প্রথম হিন্দু মন্দির। এর গোড়াপত্তন হয় সেন রাজবংশের সম্রাট বল্লাল সেনের হাতে ১২শ শতকে।

কথিত আছে যে, বল্লাল সেনের জন্ম হয় বুড়িগঙ্গার এক জঙ্গলে। সেখানে বেড়ে ওঠার সময় একদা তিনি এক দুর্গা মূর্তি পান। তার বিশ্বাস ছিল যে, জঙ্গলের যাবতীয় বিপদ থেকে তাকে রক্ষার পেছনে রয়েছে এই দেবী। পরবর্তীতে রাজ ক্ষমতায় বসার পর বল্লাল সেন এই স্থানে একটি মন্দির স্থাপন করেন। বনের ভেতর আবৃত অবস্থায় ছিল বলে এই দেবীকে ডাকা হতো ‘ঢাকেশ্বরী’ তথা ‘ঢাকা ঈশ্বরী’। অতঃপর মন্দিরটিও এই নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে।

কয়েকটি মন্দির ও সৌধের সমন্বয়ে গঠিত ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মূল ভবনগুলোর রঙ লাল ও উজ্জ্বল হলুদাভ। এখানকার চারটি শিব মন্দিরের প্রত্যেকটি একই নকশায় গড়া।

প্রতি বছর রাজধানীর দুর্গা পূজার সব থেকে বড় আয়োজনটি হয় এখানে। এছাড়া জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রাও শুরু হয় এই মন্দির প্রাঙ্গণ থেকেই।

গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে সিএনজি অটো, রিকশা বা পাবলিক বাসে করে সরাসরি আসা যায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে।

জয় কালী মন্দির

পুরান ঢাকার ঠাটারি বাজার এবং ওয়ারীর ঠিক মাঝামাঝি ২৪ নম্বর জয় কালী মন্দির সড়কটির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এই মন্দির।

প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো এই উপাসনালয়টি তৈরি হয় ১০০১ বঙ্গাব্দে তৎকালীন নবাব তুলসী নারায়ণ ঘোষ এবং নব নারায়ণ ঘোষের তত্ত্বাবধানে।

মন্দিরের মোজাইক করা মেঝে আর টালি করা দেয়ালে খচিত রয়েছে হিন্দু দেব-দেবীর ছবি। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে দেখা যায় স্টেইনলেস স্টিলে তৈরি ঐশ্বরিক প্রতীক ‘ওম’। পুরো স্থাপনাটি মূলত একটি বর্গাকার কাঠামো, যার কলামগুলো আপাদমস্তক যথেষ্ট ভারী ও পুরু উপাদান দিয়ে গড়া। আর উপরের দেয়ালগুলো করা হয়েছে খিলান আকৃতির।

গুলিস্তান বাস-স্টপেজ থেকে এই তীর্থস্থানটি ১৫ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ।

রমনা কালী মন্দির

বাংলা একাডেমির বিপরীতে ও ঢাকার রমনা পার্কের বহির্ভাগে অবস্থিত গোটা মন্দির কমপ্লেক্সের আয়তন প্রায় ২ দশমিক ২৫ একর।

জনশ্রুতি অনুসারে, আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে গোপালগিরি নামের এক সন্ন্যাসী ঢাকায় সাধন-ভজনের একটি আখড়া গড়ে তোলেন। এই আখড়াতেই আরও ২০০ বছর পর আরেক বড় সাধু হরিচরণ গিরি নির্মাণ করেন মূল রমনা কালীমন্দির।

সেই থেকে মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। মন্দিরের সামনে বড় দিঘিটি একসময় দর্শনার্থী ও উপাসকদের সাঁতার কাটার জন্য বেশ জনপ্রিয় ছিল। প্রধান অনুষ্ঠান কালী পূজা হলেও এখানে দুর্গাপূজাও বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয়।

গুলিস্তান থেকে বাসে করে মৎস্য ভবন পর্যন্ত এসে অথবা রিকশা যোগে গুলিস্তান থেকে সরাসরি যাওয়া যায় রমনা কালীবাড়িতে।

রমনা কালী মন্দির (ছবি: উইকিপিডিয়া)

সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির

১৪৪১ সালে স্থাপিত এই মন্দির থেকেই মূলত উৎপত্তি হয়েছে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী নামক জায়গাটির। ধারণা করা হয়, চাঁদ রায় নামের এক ব্যক্তি এর প্রতিষ্ঠাতা।

মন্দিরের প্রধান আকর্ষণ কালী মূর্তি এবং উঠানের রক্তচন্দন গাছ। পুরো মন্দিরটি লম্বা লম্বা কলামে সুসজ্জিত।

এখানকার প্রধান উৎসবের মৌসুম শারদীয় দুর্গাপূজা, যা মহা উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়।

গুলিস্তান থেকে লোকাল বাসে মগবাজারের মৌচাক পর্যন্ত এসে সেখান থেকে পায়ে হেঁটেই চলে আসা যায় ১৪ সিদ্ধেশ্বরী লেনে। এছাড়া সিএনজি অটো কিংবা রিকশাযোগেও সরাসরি মন্দিরে আসা যায়।

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন

ভারতের বেলুড় মঠ নামে পরিচিত রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা হচ্ছে পুরান ঢাকার টিকাটুলিতে অবস্থিত এই মঠ ও মিশন। গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র আধঘণ্টার পায়ে হাঁটা দূরত্বের এই ধর্মীয় স্থানটি গড়ে উঠেছিল রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আন্দোলনকে উৎসর্গ করে। ১৯১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রামকৃষ্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশনের তৎকালীন সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী প্রেমানন্দ।

মন্দিরটিতে প্রায় ৬০০ লোকের জায়গা হয়। ৫ প্রবেশপথের ষড়ভুজাকৃতির মন্দির ঘরটিকে শুধু পিছন দিক বাদ দিয়ে বাকি সব দিক থেকে দেখা যায়। প্রধান চূড়াটিকে ঘিরে রয়েছে ৬টি সংলগ্ন ছোট ছোট চূড়া।

এখানকার প্রধান অনুষ্ঠানগুলো হলো দুর্গা পূজা, শ্রী সারদা দেবীর জন্মদিন, স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন ও শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মদিন।

খেলারাম দাতার মন্দির

ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এই বিগ্রহ মন্দির বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। এর প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে সুষ্পষ্ট কোনো তথ্য নেই, তবে প্রত্নতত্ত্ব বিশারদদের মতে এর নির্মাণশৈলী ১৯ শতকের শেষ বা ২০ শতকের শুরুর সময়কার।

কিংবদন্তি অনুসারে, তৎকালীন সময়ে নবাবগঞ্জের দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দার ছিলেন খেলারাম। তিনি ধনীদের ডাকাতি করে তা গরীবদের দান করতেন। ইছামতি নদীতে ডাকাতি করে ডাকাতির ধনসম্পদ তিনি নদী থেকে সুড়ঙ্গপথে তার বাড়িতে নিয়ে আসতেন। অনেকের ধারণা, পূজা-অর্চনার জন্য নিজের বানানো মন্দিরটিতে তিনি ডাকাতির মালামাল লুকিয়ে রাখতেন।

মন্দিরের নকশায় গৌড়ীয় বা বঙ্গীয় রীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপীয় ধারা। সমগ্র কমপ্লেক্সের শুধু দোতলাটি টিকে আছে। নিচতলার কক্ষগুলোর অধিকাংশই মাটিতে ঢাকা।

গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে নবাবগঞ্জগামী বাসে উঠে কলাকোপায় নেমে বান্দুরার পথে কিছু দূর এগোলেই পড়বে খেলারাম দাতার বাড়ি।

শ্রী শ্রী বুড়া শিবধাম

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত এই স্থাপনাটি ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন, বড় ও সুন্দর মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম। রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উত্তরে অবস্থিত এই শিবধামের জন্যই এলাকার নাম হয়েছে শিববাড়ী ৷

১৯১২ সালের ঝড়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পর বর্ধমানের তৎকালীন রাজা স্যার বিজয় চাঁদ মন্দিরটি সংস্কার করেন। উঁচু লাল রঙের চূড়াবিশিষ্ট মন্দিরটির সর্বত্রে অপরূপ নকশার কাজ।

এখানে বছরব্যাপী শিবরাত্রি ও নানা ধরনের ধর্মীয় উৎসব হয়ে থাকে। গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে ১৫ মিনিট পায়ে হাঁটা দূরত্বে রয়েছে এই শিবধাম।

লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির

১০৫৬ বঙ্গাব্দে দেবী লক্ষ্মীকে উৎসর্গ করে নির্মিত হয় এই হিন্দু মন্দিরটি। ঢাকার নবাবপুরে অবস্থিত এই স্থাপনা জুড়ে রয়েছে হিন্দু পুরাণের নানা কাহিনীর খোদাইকৃত সজ্জা। দোতলা মন্দিরের সীমানার ভেতর রয়েছে একটি ব্যক্তিগত বাড়ি। চূড়াবিহীন প্রাচীন এই মন্দিরের পুরোটাই প্লাস্টার দিয়ে তৈরি। টালি করা দেয়াল জুড়ে দেব-দেবীদের ছবি। মন্দিরের মূর্তিগুলোর মূল উপাদান মার্বেল পাথর যেগুলো আনা হয়েছে জয়পুর থেকে।

গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি হওয়ায় পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায় লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরে।

ধামরাই জগন্নাথ রথ

ঢাকার ধামরাই উপজেলায় অবস্থিত এই রথ মন্দিরটি দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। আষাঢ় মাসে এখানে অনুষ্ঠিত রথযাত্রাটি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।

ধামরাই জগন্নাথ রথ (ছবি: উইকিপিডিয়া)

১৬৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই জগন্নাথ মন্দিরের একদম শুরুতে রথ তৈরি হতো বাঁশ দিয়ে। ১৯৩৩ সালে পুনর্নির্মাণের পর তিনতলা বিশিষ্ট রথের উচ্চতা ছিল ৬০ ফুট এবং চওড়া ৪৫ ফুট। রথের ৩২টি অতিকায় চাকার সবগুলোই ছিল কাঠের।

২০১০ সালে সংস্কারের পর বর্তমানে রথটির আকৃতি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ২৭ ফুট, আর চাকার সংখ্যা ১৫টি। আমূল পরিবর্তনের পর তিনতলার রথটি সুশোভিত করা হয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি দিয়ে।

গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে ধামরাইগামী বাসে উঠে ঢুলিভিটা বাসস্ট্যান্ড নেমে সেখান থেকে স্থানীয় পরিবহনে করে সরাসরি রথ মন্দির পর্যন্ত যাওয়া যায়।

স্বামীবাগ ইসকন মন্দির

মন্দিরটির প্রাচীন নাম শ্রীশ্রী রাধা গোবিন্দ মন্দির, যেটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৯ সালে। শ্রীরুদ্র ত্রিদণ্ডী ত্রিপুরলিঙ্গ স্বামীর তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই মন্দিরের আরও একটি নাম স্বামীবাগ আশ্রম। ২০০০ সালে আশ্রমের তাৎকালীন সেবায়েত শ্রী যশোদা নন্দন আচার্য আশ্রমের দায়িত্ব বাংলাদেশ ইসকনের কাছে সমর্পণ করেন। সেই থেকে গেন্ডারিয়ার ৭৯ স্বামীবাগ রোডে আশ্রমটির যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।

এই ইসকন মন্দির থেকে প্রতি বছর মহা সমারোহে শুরু হয় জগন্নাথের রথযাত্রা, যার সমাপ্তি ঘটে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে গিয়ে।

গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি হওয়ায় পায়ে হেঁটে আধঘণ্টায় বা রিকশায় ১৫ মিনিটেই মন্দিরে পৌঁছা যায়।

পরিশিষ্ট

ঢাকা ও নিকটবর্তী এলাকার ঐতিহাসিক মন্দিরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো ঢাকেশ্বরী মন্দির। পুরনো ঢাকা ও তার আশেপাশের বিস্তৃত জায়গা জুড়ে আছে জয় কালী মন্দির, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন, লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির, স্বামীবাগ ইসকন মন্দির, এবং শ্রী শ্রী বুড়া শিবধাম। রাজধানীর প্রাণ কেন্দ্রের প্রধান দুটি ধর্মীয় স্থাপনা রমনা কালীবাড়ি ও সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। আর জেলা সদর থেকে কিছু দূরেই রয়েছে ধামরাই জগন্নাথ রথ এবং খেলারাম দাতার মন্দির। ধর্মীয়, স্থাপত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে সর্বাঙ্গীনভাবে এই তীর্থস্থানগুলো বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিচায়ক।

ইউএনবি নিউজ

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024