জিনিসের দাম কেন বাড়ে? এর উত্তরও খুব একটা কঠিন নয়, যখন বন্যা হয় বা যখন বন্যা হয় না, যখন খরা হয় বা যখন খরা হয় না, যখন ভোট আসে বা যখন ভোট আসে না, যখন চাহিদা থাকে, কিন্তু জোগান থাকে না, যখন জোগান থাকে, কিন্তু….এক কথায় কারণের অভাব নেই। খালি কোন সময় কোন কারণটি দিতে হবে, সেটা ঠিক করাটাই আসল কথা।
জিনিসের দাম নিয়ে সংবাদমাধ্যম কখন ও কেন সোচ্চার হয়? এই প্রশ্নের জবাব আগের দুইটি প্রশ্নের মতো সহজ নয়, বরং খুব গোলমেলে। এর কোনো সহজবোধ্য জবাব আমার কাছে নেই। আগে দেখতাম, জিনিসের দাম একটু বাড়লেই খবরের কাগজ ও টিভিতে খবর করা হতো। কিন্তু এখন দাম বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে, খবর আর হয় না। হয়ত সংবাদমাধ্যম অনেক বড় বড় বিষয় নিয়ে চিন্তিত। যুদ্ধবিগ্রহ, উৎসব, মেলা, ক্রিকেট, ফুটবল, ভোট, তখন আবার এই দামের প্রসঙ্গ তুলে সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার দরকারটা কী? না হলে তো বলতে হয়, সাধারণ মানুষ আর জিনিসের দাম নিয়ে ভাবিত নয়, তারা যে দাম হয়, তা দিয়েই জিনিস কিনে বা না কিনে খুশি মনে ঘরে ফিরছে। তাই মানুষের ক্ষোভ না থাকায় সংবাদমাধ্যমেরও হেলদোল নেই। কিন্তু এখানে বাস্তবের ছবিটা মিলছে না। বাজারে গেলেই তো মানুষের ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে। অথচ, সংবাদমাধ্যম নীরব।
দামের হিসাব
এইসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে একবার বাজারের দিকে চোখ ফেরানো যাক। দিল্লির বাজার দিয়েই শুরু করি। রাজধানীতে আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে, পেঁয়াজ ৮০ টাকা, টমেটো ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, ক্যাপসিকাম ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, বিনস ২১০ টাকা, গাজর ১১০ টাকা, করলা ১৬০ টাকা, বিট ১১০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা, শশা ৯০ টাকা কেজি দরে। তিনশ থেকে চারশ গ্রাম ওজনের ফুলকপি একশ টাকা, বাঁধাকপি ৭৫ টাকা কেজি।
সর্ষের তেল কিনতে গেলে ছ্যাঁকা লাগছে। কিছুদিন আগেও এক লিটারের বোতল পাওয়া যেত ১০৯ টাকায়, এখন তা ১৬০ থেকে ১৭৫ টাকা। শুধু সর্ষে নয়, অন্য সব তেলের দাম বেড়েছে।
মুসুর ডালের দাম ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা এবং মুগ ডালের এক কেজির প্যাকেটের দাম ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। ২০০ গ্রাম পনিরের দাম ৯১ টাকা। এক কেজি খাসির মাংস ৭৫০ টাকা কেজি, কাটা রুই ছয়শ টাকা, মুরগির মাংস ৩০০ টাকা কেজি।
কলকাতার বাজারে কেবল আলুর দাম তুলনায় কম। ৩৫ টাকা কেজি। বাকি জিনিসের দাম মোটামুটি একই।
গত কয়েক মাস ধরে এই দাম হয় বেড়েই চলেছে, নয়ত একই জায়গায় আছে। কমার কোনো নামগন্ধ নেই।
কৃষক কত পায়?
সংসদে যখন বিতর্ক হয়, তখন মনে হবে অন্নদাতা কৃষকের জন্য সকলের রাতের ঘুম উড়ে গেছে। বাস্তব অবস্থাটা কি? এই যে এত চড়া দামে জিনিস বিক্রি হচ্ছে, তার কতটা কৃষক পাচ্ছে?
মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ চাযীদের কথা ধরা যাক। গতবছর সরকার সেখানে পেঁয়াজ কিনেছিল ১৬ টাকা ৯৩ পয়সা দামে, এবার তারা করছে ২৯ টাকা ৩০ পয়সা দামে। মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোট আসছে, ফলে পেঁয়াজ চাষীদের স্বার্থ দেখাটা সরকারের পক্ষে জরুরি। সরকার সেই পেঁয়াজ বিক্রি করছে ৩৫টাকা কেজি দরে। এটা তো সরকারি হিসাব। বেসরকারি সংস্থা তখনই পেঁয়াজ কিনে গুদামজাত করে যখন তার দাম কম হয়। যদি তর্কের খাতিয়ে ধরেও নেয়া যায়, তারা ২৯ টাকা ৫০ পয়সা দরেই পেঁয়াজ কিনছে, সেই পেঁয়াজ দিল্লির ক্রেতাকে কিনতে হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি দরে। তাহলে এই প্রতি কেজিতে এই ৫০ টাকা ৫০ পয়সা যাচ্ছে কোথায়? এর উত্তরও কঠিন নয়। উৎপাদক ও ক্রেতার মাঝখানে থাকা ব্যবয়াসীদের কাছে। জিনিসের দাম যত বাড়ে, তাদের লাভও পাল্লা দিয়ে বাড়ে। যত দুঃখের কাহিনি সব উৎপাদক ও ক্রেতার। ফলে বৃষ্টি হোক বা না হোক, রোদ উঠুক বা না উঠুক, ব্যবসায়ীদের সবসময়ই বসন্ত।
এখন তো বড় বড় সংস্থা সব এই ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। তারা কোল্ড চেইন তৈরি করছে। দিল্লিতে যে কৃষক আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে দাবি করা হয়েছিল, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য সরকারকে আইনি করতে হবে। অর্থাৎ, তার কম দামে কেউ কিনতে পারবে না। কৃষকদের আশঙ্কা ছিল, ধীরে ধীরে সরকার ফসল কম সংগ্রহ করবে, ব্যবসায়ীরা তার সুবিধাটা নেবে। যখন ফসল ওঠার কথা, তখন তারা কোল্ড স্টোরেজ থেকে মাল বাজারে ছেড়ে দাম কমাবে। কম দামে কৃষকের কাছ থেকে জিনিস কিনবে, পরে অনেক বেশি দামে বিক্রি করবে। কোল্ড স্টোরেজে যে জিনিস রাখা যায়, তার দাম এই বড় কোম্পানিগুলিই নিয়ন্ত্রণ করবে বলে কৃষকদের আশঙ্কা ছিল। সেজন্যই তারা ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্যের আইনি গ্যারান্টি চেয়েছিল। অন্নদাতাদের এই দাবি মানার ক্ষেত্রে সরকারের খুব একটা উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না।
সরকারি স্তরে মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
ক্রেতা সুরক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রাইস মনিটরিং ডিভিশন(পিএমডি) আছে। তারা নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের খুচরো ও পাইকারি দামের উপর নজর রাখে। তারা যে সব বিষয়ের দামের উপর প্রতিদিন নজর রাখে তার মধ্যে আছে, চাল, ডাল তেল, চিনি, গুড়, দুধ, আলু, পেঁয়াজ, টমেটো, নুন।
মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ৫৫০টি বাজার থেকে প্রতিদিন তথ্য সংগ্রহ করা হয়। রাজ্যের অসামরিক সরবরাহ দপ্তরের কাছ থেকে তথ্য নেয়া হয়। ফুড কর্পোরেশন ও নাফেডের মতো কেন্দ্রীয় সংস্থার মাধ্যমে তা যাচাই করা হয়।
গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় খাদ্য ও ক্রেতাসুরক্ষা মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল দাবি করেছেন, সরকার গত কয়েক বছর ধরে প্রো-অ্যাকটিভ পদক্ষেপ নেয়ায় মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে। সরকার নতুন ১৪০টি মূল্য নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খুলেছে। তিনি দাবি করেছিলেন, যখনই জিনিসের দাম বাড়ে, সরকার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয় ও তা নিয়ন্ত্রণে আসে।
তা-ও দাম বাড়ে
কিন্তু তারপরেও দেখা যাচ্ছে, দাম বাড়ে, বেড়েই চলে। সরকারি তন্ত্র নিজের জায়গায় থাকে। হয়ত, কিছু সরকারি জায়গা থেকে কম দামে পেঁয়াজ বা টমেটো বিক্রি করা হয়। তা তো বিন্দুতে সিন্ধু। বাজারের দাম কমে না। বাড়ে। বৃষ্টি হলে বাড়ে, না হলে বাড়ে….।
ডিডাব্লিউ ডটকম
Leave a Reply