বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪১ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৪৯)

  • Update Time : শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

সেই ছেঁচা হাত লইয়াই নানি মায়ের জন্য পিঠা তৈরি করিয়া আমাদের খাওয়াইলেন, মাকে খাওয়াইলেন, নানি কিছুই খাইলেন না। পরদিন হাতের ব্যাথায় নানির ঘোর জ্বর হইল। সেই জ্বরে তিন-চারদিন নানি কত কষ্ট পাইলেন কিন্তু সেজন্য একটুও আহা-উহু করিলেন না। আমরা কয়েকদিন পরে চলিয়া যাইব। আমাদিগকে যে নানি এটা-ওটা তৈরি করিয়া খাওয়াইতে পারিতেছেন না, ইহাই নানির সবচাইতে দুঃখ। মা কেবল নানির কাছটিতে বসিয়া থাকেন। নানি বলেন, “নারে রাঙাছুটু। তুই আর কয়দিনই বা আছিস। যা, পাড়ায় বেড়াইয়া আয়-ফেলিদের বাড়ি যা-গরীবুল্লা মাতবরের মেয়েকে দেখিয়া আয়।” মা কথা শুনেন না। নানির কাছটিতেই বসিয়া থাকেন। মা বোধহয় বুঝিতে পারিয়াছিলেন, এই অসুখ হইতে নানি আর সারিয়া উঠিবেন না। শেষ দিনে নানি আর কথা বলিতে পারিলেন না। কেবল চাহিয়া চাহিয়া মাকে দেখিতে লাগিলেন। আর দুটি চোখ হইতে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরিতে লাগিল। হয়তো বুঝিয়াছিলেন, নানি চলিয়া গেলে এই অভাগিনী মেয়েটিকে আদর করিবার আর কেহ থাকিবে না।

তখন বনের মাথায় রৌদ্র মাখাইয়া দিন-শেষের সূর্য অস্তপারের দিকে পা বাড়াইয়াছে। গাছের শাখায় পাখিগুলির গান নীরব হইয়া আসিতেছে। এমন সময় নানি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। ঝিনুকে করিয়া মা পানি লইয়া নানির মুখে দিতে গেলেন। পানি গড়াইয়া পড়িয়া গেল। চিৎকার করিয়া মা কাঁদিয়া উঠিলেন: “আমার এত আদরের মা আর ঘুম হইতে জাগিবে না। রাঙাছুটুর খবর লইতে আর এ-গাঁও হইতে ভিখারিণীদের কেহ গোবিন্দপুর পাঠাইবে না। আর কোনোদিন এ-গাঁও হইতে ঢ্যাপের মোয়া গোবিন্দপুর যাইবে না। মা। তুমি একবার চাহিয়া দেখ, তোমার যত্নের বুনানো সেই পুঁতির মালা এখনও আমি গলায় পরিয়া আছি। কেমন মানাইয়াছে আর একবার বলিয়া যাও।”

আমার মায়ের কান্দনে পাড়া-প্রতিবেশীরা মাকে বুঝাইতে আসিয়া নিজেরাই কাঁদিয়া বুক ভাসাইল। আজ ভাবিয়া বড়ই দুঃখ লাগে বিনা চিকিৎসায় আমার নানি মারা গেলেন। এখন সেপ্টিক হইলে কতরকমের ওষুধে তাহার নিরাময় করা যায়। তখনকার দিনে কি সামান্য অসুখে মানুষকে মৃত্যুবরণ করিতে হইত।

নানির ফাতেহা শেষ হইলে আমরা দেশে ফিরিলাম। আজ আর সোয়ারির সঙ্গে সঙ্গে মোকিমের বাড়ি পর্যন্ত নানি আসিলেন না। শুধু সেই তালগাছটা অবধি আসিয়া নানা চোখের পানি মুছিলেন।

নানি মরিয়া গেলে নানার একার সংসার চলে না। কে তাঁকে রাঁধিয়া দেয়? কে তার বারোমাসের বারো ফসলের তদ্বির-তালাশি করে? নানা নিজে হাল কৃষাণী করিতেন না। যা জমিজমা ছিল তাই বর্গা দিয়া যে ফসল পাইতেন একা আর কত খাইবেন? নানার সংসার বড়ই অগুছালো হইয়া পড়িল। পাড়া-পড়শির কথামতো একটি বিধবা মেয়েকে নানা নিকা করিয়া ঘরে আনিলেন।

প্রায় পাঁচ-ছয় মাস এই বিধবাটি নানার সংসার করিয়াছিল। তারপর নানার জমানো সমস্ত টাকা-পয়সা লইয়া একদিন গভীর রাত্রিকালে ঘরে আগুন দিয়া মেয়েটি পালাইয়া যায়। নানা একেবারে সর্বস্বান্ত হইলেন। এই খবর ভিখারিদের মারফত পাইয়া মা কত কাঁদিলেন।

 

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024