শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৭ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৪৭)

  • Update Time : বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

নানি মাকে ধরিয়া সোয়ারিতে উঠাইয়া দেন। আমি আর আফাজদ্দীন সোয়ারির পাছে পাছে। পাড়ার মেয়েরা, নানা, নানি, সবাই সঙ্গে সঙ্গে।

গ্রামের হালট ধরিয়া সোয়ারি চলিতেছে। সামনে ছদনের বাঁশঝাড়, মোমিন মোল্লার ছোনের ঘর-তারপর মোকিমের বাড়ি। পথের দুই পাশে দুইটি তালগাছে বাতাস শোঁ শোঁ করিয়া ডাকিতেছে। সেই শব্দ যেন করাত দিয়া সকলের বুকে আঘাত করিতেছে। এখানে আসিয়া নানা ইঙ্গিত করিয়া সকলকে থামাইলেন। আস্তে আস্তে সোয়ারি চলিতে লাগিল। সোয়ারির কাপড় তুলিয়া মা একদৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন। তারপর যখন গাঁয়ের মোড় ঘুরিয়া সোয়ারি গাছের আড়ালে পড়িল, মা-বাপের গ্রাম আর দেখা যায় না, মা সোয়ারির আবরণ ছাড়িয়া দিলেন। একটি বিয়োগান্ত কাহিনীর যেন যবনিকাপাত হইল।

এরপরে বহুবার মায়ের সঙ্গে নানাবাড়ি আসিয়াছি। বর্ষাকালে আসিয়াছি নৌকা করিয়া। বউঘাটা পার হইয়া গাছবাইড়ার চক। এপার হইতে ওপার দেখা যায় না। শুধু ধানক্ষেত। শুকনার দিনে কোনো পথিক এই চক পাড়ি দিতে ভয় পায়। যদি পিপাসা পায় বুকের ছাতি ফাটিয়া মারা যাইবে। পথে কোথাও একটি গাছ নাই। সেই গাছবাইড়ার চক পার হইলে ভাটপাড়া। তারপর একখানা চক পাড়ি দিলে তাম্বুলখানা, আমাদের বাড়ি হইতে দিনমানের পথ। সকালে রওয়ানা দিয়া সন্ধ্যায় আসিয়া পৌঁছা যায়।

নানাবাড়িতে আসিয়া তাল খাইয়াছি। সেই তালের আঁটি নানি ছাই-এর গাদায় পুঁতিয়া রাখিয়াছেন। তাহার মধ্যে শাঁস হইলে দা দিয়া কাটিয়া সেই শাঁস লইয়া নানা আমাদের বাড়ি আসিয়াছেন। নানাবাড়িতে আসিয়া ঢ্যাপ (শাপলা) কুড়াইয়াছি। সেই ঢ্যাপ নানি ছাই দিয়া ডলিয়া শুকাইয়া রাখিয়াছেন। নতুন ঢ্যাপের বীজে খই হয় না। বারবার নেহারে ভিজাইয়া রৌদ্রে শুকাইয়া দুই-তিনমাস পরে তাহা দিয়া খই ভাজা যায়। শীতকালে সেই ঢ্যাপের খই করিয়া নতুন গুড় দিয়া মোয়া বাঁধিয়া নানি নানাকে দিয়া আমাদের বাড়ি পাঠাইয়াছেন। একমাত্র নানাবাড়িতে যাইয়া হাট হইতে আখ কিনিয়া আনিয়াছিলাম। আখের ডগা (মাথা) নানি বাড়ির পালানে পুঁতিয়া দিয়াছিলেন। বর্ষাকালে সেই গাছে বড় বড় আখ হইল। বুড়ো মানুষ নানা। তবু অত দূরের পথে দুই-তিনখানা আখ কাঁধে করিয়া নানা আমাদের বাড়ি আসিয়াছিলেন। এসব ছোটখাটো জিনিসের মধ্যে কতখানি যে মমতা মাখানো ছিল তখন বুঝিবার বয়স হয় নাই। এখন ভাবিয়া চোখে জল আসে। মানস নয়নে যেন দেখিতে পাই সেই সুদূর জঙ্গল-ঘেরা তাম্বুলখানা গ্রাম হইতে নানা দুই-তিনখানা বড় বড় আখ কাঁধে করিয়া আমাদের গোবিন্দপুর গ্রামে আসিতেছেন। পথশ্রমে ক্লান্ত হইয়া হয়তো কোনো গাছের তলায় বসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন, আর মনে মনে নিজের মেয়েটির কথা-ছোট ছোট নাতিদের কথা চিন্তা করিতেছেন। এখন আর তাঁর পথশ্রমকে পথশ্রম বলিয়া মনে হইতেছে না। যত তাড়াতাড়ি পারেন আবার পথে চলিয়াছেন। নানাকে আসিতে দেখিয়াই আমরা তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়াছি। “নানা। কি আনিয়াছেন। কি আনিয়াছেন?” নানা কাঁধ হইতে বড় বড় গেণ্ডারি আখগুলি আমাদের হাতে তুলিয়া দিয়াছেন। কত আনন্দ করিয়াই না সেই আখগুলি খাইয়াছি।

 

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024