সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৫ অপরাহ্ন

দার্জিলিংয়ের টংলু ও সান্দাকফু যাওয়ার উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ

  • Update Time : রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৪, ৫.২৪ পিএম
দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা (ছবি: উইকিপিডিয়া)

পিলে চমকানো উচ্চতায় মেঘ ছুঁয়ে যাওয়া পাহাড় ভ্রমণের মাঝে কেবল দুঃসাহসিকতা নয়, থাকে অজানাকে নতুন করে জানার হাতছানি। উঁচু-নিচু দুর্গম পথ পদব্রজে ভ্রমণের আনন্দ আশেপাশের বীথিকার রাজ্য দু’চোখ ভরে দেখার অনুভূতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। রোমাঞ্চ আরও একধাপ বেড়ে যায় যখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় তুষারপাত। নিদেনপক্ষে বাংলাদেশি ট্রেকারদের জন্য তা নিতান্তই এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। দার্জিলিংয়ের টংলু হয়ে সান্দাকফু অভিমুখের যাত্রাপথটি তেমনই এক গন্তব্য। অতিক্রম করা যথেষ্ট সহজ হওয়ার কারণে ট্রেকারদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে এই ট্রেকিং পথটি। চলুন, জনপ্রিয় পর্যটন স্থানটিতে ভ্রমণ সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

দার্জিলিং

পূর্ব হিমালয়ে অবস্থিত ভারতের উত্তরাঞ্চলের শহর দার্জিলিং, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার গড় উচ্চতা ৬ হাজার ৭০৯ ফুট। এর উত্তরে সিকিম এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে বাংলাদেশ। মেঘমুক্ত দিনে উত্তর দিগন্ত জুড়ে দেখা যায় বিশ্বের তৃতীয়-সর্বোচ্চ পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘা।

হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই শহরে প্রায় সারা বছরই থাকে শীতের মৌসুম। মেঘে ঢাকা নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য, চা-বাগান ও ঐতিহাসিক রেলওয়ের জন্য দার্জিলিং বিশ্বজুড়ে একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। এর প্রধান আকর্ষণ বাতাসিয়া লুপ, দার্জিলিং টয় ট্রেন ও নান্দনিক পাহাড়ি রাস্তাগুলো। কাঞ্চনজঙ্ঘার অনুপম দৃশ্যের পাশাপাশি টাইগার হিলের সূর্যোদয় বিশ্ব পরিব্রাজকদের কাছে টানে এক অমোঘ আকষর্ণে।

টংলু

দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত ছোট্ট একটি ট্রাঞ্জিট শহর মানেভঞ্জন, যেখান থেকে সান্দাকফু চূড়ায় যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটি গ্রাম পড়ে। এগুলোরই একটি হচ্ছে টংলু, মানেভঞ্জন থেকে যার দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। ১০ হাজার ১৩০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই ছোট্ট গ্রামটিই যাত্রা বিরতির জন্য ট্রেকারদের প্রিয় স্থান। সমতলে যখন গ্রীষ্মের উষ্ণতা, তখনও ভারত ও নেপাল সীমান্তবর্তী এই নিরিবিলি গ্রামে থাকে কনকনে শীত। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকেও চোখে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার রাজকীয় দৃশ্য।

এছাড়া কাছেই রয়েছে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক। মানেভঞ্জন থেকে গাড়ি করে গেলে মেঘমা পর্যন্ত যেয়ে তারপর সেখান থেকে ২ কিলোমিটার ট্রেকিং করে টংলুতে পৌঁছা যায়।

সান্দাকফু

ভারত ও নেপালের সীমান্তে অবস্থিত সিঙ্গালিলা রিজের একটি পর্বতশৃঙ্গের নাম সান্দাকফু বা সান্দাকপুর যার উচ্চতা ১১ হাজার ৯৩০ ফুট। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এই সর্বোচ্চ স্থানটিতে আরোহণ করতে হলে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের একদম শেষ প্রান্তে যেতে হয়।

এখানে রয়েছে কয়েকটি হোটেল ও ছোট্ট একটি গ্রাম, যেখান থেকে বিশ্বের পাঁচটি সর্বোচ্চ পবর্তশৃঙ্গের মধ্যে চারটিই চোখে পড়ে। সেগুলো হলো- এভারেস্ট, কাঞ্চচনজঙ্ঘা, লোটসে, এবং মাকালু শৃঙ্গ।

দার্জিলিং (ছবি: উইকিপিডিয়া)

দার্জিলিংয়ের মানেভঞ্জন থেকে টংলু হয়ে সান্দাকফু

সান্দাকফু ট্রেকিং রুটের শুরুর স্থানটি হচ্ছে মানেভঞ্জন। দার্জিলিং থেকে এর দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। এই পথে গাড়িরও ব্যবস্থা আছে, তবে এর সৌন্দর্য্যকে প্রাণভরে উপভোগ করতে হলে অবশ্যই পায়ে হেঁটে যাওয়া উচিত। সান্দাকফু ছাড়িয়ে আরও সাড়ে ১২ কিলোমিটার পর পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত চূড়া ফালুট। সান্দাকফু থেকে ফালুট ট্রেকিং রুটটি সব থেকে সহজ, আর তাই এটি বিশ্ব জুড়ে নতুন ট্রেকারদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে বিবেচিত।

যাত্রা শুরুর সময় গাইড-পোর্টার সব মানেভঞ্জনে পাওয়া যাবে। সেখান থেকে সান্দাকফু পর্যন্ত যেতে মোট ৪ দিন সময় লাগে।

পুরো যাত্রাপথটি হচ্ছে-

মানেভঞ্জন → চিত্রি → মেঘমা → টংলু বা টুম্লিং → গৈরিবাস → কালিপোখরি → সান্দাকফু

এরপর পুরনো পথে না যেয়ে শ্রীখোলা হয়ে রিম্বিক ঘুরে দার্জিলিং ফিরে আসা যায়।

ভ্রমণের সেরা সময়

পরিষ্কার আবহাওয়া পাওয়ার জন্যে সর্বোত্তম সময় হচ্ছে অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস। এ সময় কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ চারপাশের দিগন্ত জোড়া বীথিকা ভালোভাবে দেখা যায়। তবে তুষারপাত দেখতে হলে জানুয়ারি থেকে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত যে, এই ঠান্ডা আবহাওয়াটি খুব একটা অনুকূল নয়।

অপরদিকে, রডোডেন্ড্রন বাগান দেখার জন্য এপ্রিল বা মে মাসে ভ্রমণ পরিকল্পনা করা উচিত। বর্ষা মৌসুমে দার্জিলিংয়ে পাহাড় ধস হয় বিধায় এই সময়টা এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম।

দার্জিলিঙের চা বাগান (ছবি: উইকিপিডিয়া)

বাংলাদেশ থেকে দার্জিলিং যাওয়ার জন্য ভারতের পর্যটন ভিসা

এই ভ্রমণের জন্য সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে ভারতের পর্যটন ভিসা নেওয়া। এই ভিসায় সর্বোচ্চ ৯০ দিন ভারতে থাকার অনুমতি পাওয়া যায়। এর জন্য ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র বা আইভিএসি বরাবর আবেদন করতে হবে।

অনলাইন আবেদনের লিংক: https://indianvisa-bangladesh.nic.in/visa/Registration

পূরণকৃত আবেদন ফর্মের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক দরকারি কাগজপত্র সংযুক্ত করে আইভিএসিতে জমা দিতে হবে।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

·  জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা জন্ম নিবন্ধনপত্র

·  সদ্য তোলা (সর্বোচ্চ ৩ মাসের পুরনো হতে পারে) রঙিন ছবি: আকার ২”/২” (৩৫০x৩৫০ পিক্সেল)

·  নতুন ও পুরনো সকল পাসপোর্ট: পাসপোর্টে ভিসার আবেদন জমা দেওয়ার তারিখ থেকে পরবর্তী ন্যূনতম ৬ মাসের মেয়াদ থাকতে হবে। পাসপোর্টে কমপক্ষে ২টি ফাঁকা পৃষ্ঠা থাকতে হবে। মূল পাসপোর্টের সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে ২য় ও ৩য় পৃষ্ঠার ফটোকপি থাকবে।

·  সর্বশেষ (৬ মাসের বেশি পুরনো হওয়া যাবে না) ইউটিলিটি বিল (বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানির বিল)

·  আন্তর্জাতিক ভ্রমণ কার্ড হিসেবে নিম্নের যে কোনোটি সংযুক্ত করা যেতে পারে-

o এসবিআই ট্র্যাভেল কার্ড

o বিগত ৩ মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট

o চলতি বছরে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড এন্ডোর্সমেন্ট: ১৫০ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ

·  পেশার নথিপত্র: নিয়োগকর্তার কাছ থেকে শংসাপত্র। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড ও অবসরপ্রাপ্তদের জন্য অবসরের কাগজপত্র।

·  ভিসা প্রক্রিয়াকরণ ফি ৮০০ টাকা।

প্লেনের টিকেট ও হোটেল বুকিং

দার্জিলিংয়ের সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দরটি হলো বাগডোগরা, যেখানে দিল্লী ও কলকাতা থেকে বিমান নিয়মিত যাওয়া-আসা করে। sharetrip.com এবং goindigo.in সাইটগুলোর মাধ্যমে ঢাকা-বাগডোগরা ফ্লাইট বুকিং দেওয়া যাবে। বাগডোগরা থেকে সরাসরি দার্জিলিং যাওয়ার ট্যাক্সি রয়েছে।দার্জিলিংয়ে থাকার ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে অনলাইনে হোটেল বুকিং করা যেতে পারে। booking.com, hotels.com, expedia.com পোর্টালগুলোর মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন মানের হোটেল বুক দেওয়া যাবে। তবে উদ্দেশ্য যদি শুধুমাত্র সান্দাকফু ভ্রমণ হয়, সেক্ষেত্রে দার্জিলিং যেয়ে ট্রেকিং রুটে যাত্রা বিরতি বা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।

টংলু বা টুম্লিং (ছবি: উইকিপিডিয়া)

দার্জিলিং, টংলু ও সান্দাকফু ভ্রমণে যাবতীয় খরচ

প্লেন ভাড়ার জন্য বাজেট রাখতে হবে ১০ হাজার ৯৫০ থেকে ২৩ হাজার ৯০০ টাকা। বাগডোগরা থেকে সরাসরি মানেভঞ্জন পর্যন্ত গাড়ি আছে। বড় গাড়িতে ভাড়া পড়তে পারে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা আর ছোটগাড়ি ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা।

মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য রয়েছে ল্যান্ডরোভার। এগুলোতে যাতায়াত বাবদ খরচ হবে ২ হাজার টাকা।

তবে থাকাসহ যাতায়াতের জন্য পুরো রিজার্ভ করে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে রাত্রি যাপনের জন্য প্রথম রাতের জন্য যোগ হবে ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ সর্বমোট ৩ হাজার টাকা। দ্বিতীয় রাত থেকে প্রতি রাতের জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা করে যোগ হবে। অর্থাৎ দুই রাতের জন্য থাকা ও যাতায়াত বাবদ মোট খরচ ৪ হাজার ৫০০ টাকা।

অবশ্য টংলুতে থাকার জন্যে হোমস্টে আছে, যেগুলোতে থাকা-খাওয়া সহ জনপ্রতি খরচ হবে ১ হাজার ২০০ রুপি বা ১ হাজার ৭১১ টাকা (১ রুপি = ১ দশমিক ৪৩ বাংলাদেশি টাকা)।

ভ্রমণকালীন কিছু সতর্কতা

ট্রেকিং অভিজ্ঞতাকে উপভোগ্য, ঝামেলাবিহীন এবং নিরাপদ করার স্বার্থে কিছু সরঞ্জাম সঙ্গে নেওয়া আবশ্যক। সেগুলো হলো:-

·  ভিসার পাতাসহ পাসপোর্টের ফটোকপি: ২ থেকে ৫ টি

·  পাসপোর্ট সাইজের ছবি: ৪ টি

·  শক্ত গ্রিপের ট্রেকিং বুট; সঙ্গে ঊলের মোজা: ইতোমধ্যে ৫ থেকে ৬ দিন ব্যবহার করা হয়েছে এমন বুট

·  মোটা হাতমোজা

·  প্যারাসুট জ্যাকেট বা ঊইন্ড ব্রেকার

·  কাঁধে আর কোমড়ে সমানভাবে ওজন নেয় এমন ব্যাকপ্যাক

·  মাংকি ক্যাপ বা ফানেল আকৃতির কাপড় বালাক্লাভা এবং মাফলার

·  পোলারাইজ্ড সানগ্লাস

·  ২টি ট্রেকিং পোল বা ওয়াকিং স্টিক

·  হেড ল্যাম্প বা টর্চ; সঙ্গে অতিরিক্ত ব্যাটারি

·  ক্যামেরার সঙ্গে অতিরিক্ত ব্যাটারি, মেমরি কার্ড, এবং পাওয়ার ব্যাংক

সান্দাকফু  (ছবি: উইকিপিডিয়া)

পরিশিষ্ট

দার্জিলিংয়ের টংলু ও সান্দাকফু ভ্রমণের জন্য কমপক্ষে এক সপ্তাহের সময় নিয়ে যাওয়া উচিত। কেননা কমপক্ষে ৪ দিনই কেটে যায় মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু যেতে। ল্যান্ডরোভারে করে বিলাসযাত্রার সুযোগ থাকলেও পথের চারপাশের অবিস্মরণীয় দৃশ্যকে শতভাগ উপভোগ করতে পায়ে হেঁটে যাওয়া উত্তম। ট্রেকিংয়ের রাস্তা যথেষ্ট সহজ হলেও তাপমাত্রাকে খুব একটা অনুকূলে পাওয়া যাবে না। কারণ প্রায় সারা বছরই এখানে তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের নিচে, বিশেষ করে যত উচ্চতায় ওঠা যায় তাপমাত্রা ততই নামতে থাকে। তাই নিরাপদ ট্রেকিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে যাওয়া অপরিহার্য।

ইউএনবি নিউজ

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024