স্বদেশ রায়
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী কোভিডের ফলে ২০১৯-২০ এ দক্ষিণ এশিয়াতে ২.৪% থেকে ১৩% পর্যন্ত দারিদ্র বাড়ে। এই তথ্য পাবার পরে অনেকে ধারণা করেছিলেন, এর মূল কারণ কোভিডের এক বছরের লক-ডাউন। এই ক্ষত দ্রুত পুষিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াবে দেশগুলো। এই সহজে পুষিয়ে নেবার ধারনাটা এসেছিলো বা হিসেব করা হয়েছিলো কোভিড পূর্ববর্তী বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে।
কিন্তু কোভিডের কারণে শুধু নয়, কোভিডের অন্তত পাঁচ বছর আগে থেকে পৃথিবীর অর্থনীতি বা যদি ভাগ করে বলা হয় গ্লোবাল সাউথ ও উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিতে যে পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছিলো- এবং টেকনোলজি ও নিরাপত্তার যে প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছিলো, তার হিসেবটি হয়তো সঠিকভাবে করা হয়নি। এবং সাউথ এশিয়ার দুর্বল দেশগুলোতে এর প্রভাব কীভাবে পড়বে বা পড়তে পারে তাও সঠিকভাবে করা হয়নি। অন্যদিকে এশিয়া, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া যে আবার এত বছর পরে এসে গুনার মিরডালের এই এলাকার মূল খাদ্য চাল থিওরোতি ঢুকে যাবে- সে হিসাবটিও করা হয়নি।
২০২০ এ এসে যখন বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে ও এবং বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলতে থাকেন, বাংলাদেশ কোভিডের ধাক্কা সহজে কাটিয়ে উঠেছে। এ সময়ে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা দিয়ে অনেক লেখায় দ্বিমত রেখেছিলাম। বলেছিলাম, কোভিডের ধাক্কার প্রকৃত রূপ আগামী দিনে দেখা যাবে। কারণ, কোভিডের সময় মূলত বাংলাদেশের একটি বড় শ্রণীর মানুষ নিম্ম মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া বড় ও ছোট শহরের ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে গ্রামের কৃষক অবধি অনেকেই তার পুঁজি ভেঙ্গে সংসার চালিয়েছিলো। যার ফলে অনেকেই পুঁজির অভাবে পুরানো অবস্থানে ফিরতে পারেনি। মধ্যবিত্তদের একটি বড় শ্রেনী সঞ্চয়ে হাত দিয়েছিলো। যার ফলে ওই অংশটিও নিম্ম মধ্যবিত্তে নেমে আসার ঝুঁকিতে পড়ে যায়।
এ যেমন বাংলাদেশের একটি বিষয়- তেমনি পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়া শুধু নয়, গ্লোবাল সাউথেও বিজনেস ও জীবন যাত্রার ধরণ বদলে যায়। টেকনোলজির ব্যবহারও বদলে যায় কোভিডের কারণে। এই সামগ্রিক প্রভাবগুলো যে অর্থনীতিতে আগামী দুই, তিন বা চার বছর ধরে অনেক বেশি ফেলবে- সে বিষয়টি ওই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেকগুলো দেশ সঠিকভাবে হিসাব করছিলো বলে মনে হয়নি। যে কারণ ২০২১ ও ২২ এ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দারিদ্র্য বাড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে খাদ্য পণ্যের দাম। এ সময়ে জিও পলিটিকাল স্বার্থে হোক, আর নিজস্ব রাষ্ট্রক্ষমতার স্বার্থে হোক রাশিয়ার এক নায়ক পুতিন ইউক্রেন আক্রমন করে। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে এক অর্থে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গোটা পৃথিবী জড়িয়ে পড়ে। আমেরিকা অর্থনৈতিক স্যাংশণ দেয় রাশিয়ার ওপর। ওই অর্থনৈতিক স্যাংশনে রাশিয়ার বা গ্লোবাল সাউথের অর্থনীতির কতটুকু ক্ষতি হয়েছে আর কতটুকু লাভ হয়েছে- সে বিষয় এ লেখায় বলতে গেলে লেখার আকার যেমন বেড়ে যাবে, তেমনি মূল প্রসঙ্গ থেকে কিছুটা সরে যেতে হবে। তাই ওই বিষয়ে না গিয়ে বলা যায় ২০২২-এ রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করার আগে থেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্য মূল্য বাড়ছিলো- তবে তখনও এই এলাকার ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর একটি শ্রেণীর হাতে কিছুটা শেষ সঞ্চয় ছিলো বলে দরিদ্র’র সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় তখনও কম ছিলো। তারপরেও অধিকাংশ মানুষ মূল খাদ্য ও অনান্য খাদ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছিলো। এ সময়ে খুব মোটা দাগে বলা হয়, তেলের দাম ও খাদ্য সংকট হচ্ছে ইউক্রেন – রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে।
ইউক্রেনে রাশিয়া প্রথমে কিছু গম ক্ষেত পুড়িয়েছিলো কিন্তু পরবর্তীতে তারা সে কাজে বিরত হয়। এবং জাতিসংঘ’র মাধ্যমে খাদ্য চলাচলকে নিশ্চিত করা হয়। আর কোভিডের পর পরই নয়, তার আগের থেকেই তেলের দামের ইনডিকেটর লক্ষ্য করলে এবং এশিয়ার অর্থনৈতিকভাবে সচল ও দ্রুত অগ্রগামী দেশগুলো যেমন, চায়না, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং সর্বোপরি ভারত ও জাপানের জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি’র হারের ইনডিকেটর লক্ষ্য করলে- বোঝা যাচ্ছিলো যত দিন যাবে ততই তেলের দাম বাড়বে। আর চায়না ও ইন্ডিয়ার অর্থনীতিতে তেলের ক্ষুধার তীব্রতাই ঈংগিত করে তেলের দামের ইনডিকেটর উর্ধমূখী করতে তারা একটা ফ্যাক্টর হবে। বাস্তবে ঘটেছেও তা।
এ বিষয়গুলো দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো যে খুব আমলে নেয়নি তার প্রমান যেমন এখন দ্রব্য মূল্য দিচ্ছে- তেমিন এই দেশগুলোকে রাজনীতিতেও সে মিউজিক ফেস করতে হয়েছে।
এখন তেলের দাম যেখানে আছে এখানেও থাকবে না। কারণ চায়না ও ভারতের বর্তমানের সমঝোতা তাদের বানিজ্যে যে গতি দেবে সেখানে তাদের জ্বালানি চাহিদা দ্রুত লাফ দেবে- এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে আমেরিকার নির্বাচনে যেই জয়লাভ করুক না কেন, তারা কেউই ক্লিনটন, বুশ, ওবামা বা বাইডেনের “ বিশ্ব পুলিশিং নীতিতে” থাকবে না। যার ফলে পূর্ব এশিয়, মধ্যপ্রাচ্য, সেন্ট্রাল এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশ আমেরিকার সঙ্গে তাদের সামরিক সমঝোতা বজায় রাখবে ঠিকই; তবে তারা চায়নার সঙ্গে অনেক বেশি এবং ভারতের সঙ্গে ভারতের সমর্থ অনুযায়ী অর্থনৈতিক সংযোগ আরো বাড়াবে। তাই ওই দেশগুলো অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ঢুকে গেলে, বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ান উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর চাকার গতি বেড়ে যাবে অনেক। যার ফলে জ্বালানির দাম বাড়বেই।
জ্বালানির দামের প্রভাব সবকিছুতেই পড়ে। আর এমন একটি সময়ে সব থেকে সমস্যায় পড়ে যায় সেই সব দেশ যারা তাদের মানুষকে শিল্প ভিত্তিক উৎপাদনের অংশ করতে পারে না । বাস্তবে যাদের রোজগার শুধুমাত্র কৃষি ও দৈহিক শ্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট অর্থনীতির দেশগুলো সত্যি অর্থে তাদের মানুষকে শিল্প ভিত্তিক উৎপাদনের অংশ করার পথে হাটেনি। তারা দৈহিক শ্রম বিক্রি ও কৃষিতেই সীমাবদ্ধ আছে।
জ্বালানির মুল্যবৃদ্ধি পেলে কৃষি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় সব কিছুর মুল্য বৃদ্ধি পাবে- এটাই স্বাভাবিক। সারা পৃথিবীতে তা ঘটে গেছে। এখান থেকে পৃথিবীকে পিছিয়ে আসার কোন উপায় নেই। এর ভেতর দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর বেশিভাগ তাদের ভূমি ও অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে জনসংখ্যা বাড়িয়েছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। যে কারণে একদিকে তাদের যেমন প্রচুর খাবার প্রয়োজন, অন্যদিকে এই খাবার আবার কম মূল্যে দেয়াও প্রয়োজন- যেহেতু মানুষের আয়ের পথ খুবই কম।
বাস্তবে উৎপাদন মূল্য কমানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ, কৃষি উৎপাদনের খরচ কমানোর একমাত্র পথ এখন হাতে আছে সরকারি ভর্তুকি দেয়া। কিন্তু এই দেশগুলো ব্যালান্স অফ পেমেন্টের জন্যে আইএমএফ এর অর্থ নির্ভর হয়ে গেছে। আইএমএফ কখনোই ভর্তুকির পক্ষে নয়। এ কারণে বাস্তবতা মেনেই উৎপাদন করতে হবে।
আর এই বাস্তবতায় দক্ষিণ এশিয় এই ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর পক্ষে মূল খাদ্য চালের দাম কমানোর পথ নেই বললেই চলে। এর ভেতর বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীংলকা ও ভূটানে চালের ঘাটতি। দক্ষিণ এশিয়ায় এখন একমাত্র চাল রফতানি করার ক্ষমতা আছে ভারতের। কিন্তু তাদের উৎপাদন মূল্য ও রফতানি ট্যাক্স সবকিছু মিলে বাংলাদেশী টাকায় প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৭৫ টাকার কমে এ মুহূর্তে কোন চাল অন্যদেশে তাদের রফতানির সুযোগ নেই। থাইল্যান্ড এর সাধারণ চালের রফতানি মূল্য এক কেজি বাংলাদেশী টাকায় ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। ভিয়েতনামের ও ইন্দোনেশিয়ার চালও বাংলাদেশী টাকায় প্রতি কেজি ১০০ টাকার কাছাকাছি। অপরদিকে পৃথিবীর অন্যতম একটি চাল রফতানি কারক দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে যারা অঙ্গাঅঙ্গি মিল রয়েছে- সেই সাবেক বার্মা বর্তমানের মিয়ানমার যা একদিন চালের হাব ছিলো,সেখানে এখন খাদ্যাভাব। কারণ, দীর্ঘ সামরিক শাসনে অভ্যস্ত এই দেশটিকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী, রাষ্ট্রপরিচালনায় অনঅভিজ্ঞ সূচিকে দিয়ে যে গণতন্ত্রর টেস্ট কেস বা গিনিপিগ করা হয়েছিলো- তা শুধু ব্যর্থ হয়নি, দেশটি দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধে ঢুকে গেছে। যার ফলে তাদের চাল উৎপাদন স্বাভাবিক পর্যায়ে ফেরার আশা এ মুহূর্তে না করাই উচিত।
ফলে দক্ষিণ এশিয়া শুধু দারিদ্র্য ও মূল খাদ্য অভাবে পড়তে যাচ্ছে তা নয়, দীর্ঘ সময় ধরে কৃষি বিজ্ঞানিরদের কল্যানে- এ এলাকার রাজনীতি যে গুনার মিরডালের সেই চালের তত্ত্ব থেকে বের হয়ে এসেছিলো তারও পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। কারণ যে কোন দেশের মানুষের সকল স্থিতিশীলতার মূলই হলো তার মূল খাদ্য।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply