সারাক্ষণ ডেস্ক
অদ্য সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীয় সিরডাপ মিলনায়তনে এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) উদ্যোগে “সরকারি কৃষিসেবা ও ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তিতে গ্রামীণ নারী কৃষকের অন্তর্ভুক্তি ও বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা” শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহিলা ও শিশু এবং সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাননীয় উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন মেঘনা গুহঠাকুরতা, নির্বাহী পরিচালক, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ; ড. রেজিয়া খাতুন, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, এফএসআরডি, বিএলআরআই; ড. রঞ্জন সাহা পার্থ, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রওশন জাহান মনি, উপ-নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি ও কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর, স্ট্যান্ড ফর হার ল্যান্ড ক্যাম্পেইন, বাংলাদেশ এবং সভাপতিত্ব করেন খুশী কবির, এএলআরডি-র চেয়ারপারসন।
প্রধান অতিথি তার বক্তব্যে উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন- আমাদের প্রথম কাজের অগ্রাধিকার হলো দূর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা মুক্ত করা। তিনি আরো বলেন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় যেসব ভাতাসমূহ রয়েছে তা সময়িতভাবে স্থগিত করা হয়েছে কারণ এর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি বিদ্যমান। তাই পিকেএসএফ এর মাধ্যমে এই সকল সুবিধাগুলোর মূল্যায়ন করে পুনরায় চালু করা হবে। পাশপাশি প্রান্তিক নারীদের মাঝে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাপনার কথাও ভাবছি। এই সকল বিষয় একটি অ্যাপস তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। উত্তরাধিকারের কথা বলতে গিয়ে তিনি নারীর ভূমি অধিকারটি ৫৪ বছরেও কিছু করা গেলনা। এই ক্ষেত্রে তিনি ভূমি সংস্কারের উল্লেখ করেন। বলেন এর মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা তাদের অসুবিধার কথা সহজে বলতে বা জানাতে পারবেন। তিনি আরো বলেন মন্ত্রণালয়ের দরজা সব সময় খোলা আমরা একসাথে কাজ করতে পারি, আলোচনা করতে পারি।
প্রবন্ধ উপস্থাপক এএলআরডি-র উপ-নির্বাহী পরিচারক রওশন জাহান মনি বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা বলেন বাংলাদেশে কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে কৃষি কাজে সবচেয়ে বেশি নারী নিয়োজিত আছেন, যা দিন দিন আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের (২০২২) তথ্যানুযায়ী মোট নারী শ্রমশক্তির ৭৪% কৃষিতে নিয়োজিত। হাওরাঞ্চলে মৎস্য সম্পদ আহরণের সাথেও নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত আছেন। সুন্দরবন অঞ্চলে কাকড়া চাষ ও চিংড়ির ঘেরে নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি শ্রম দিলেও মজুরি বৈষম্যের শিকার হতে হয়। চা বাগানে নারীরা চা শ্রমিকের কাজের পাশাপাশি নিজেরা সবজি উৎপাদন, গবাদিপশু পালন ও বাড়ির কাজ করে থাকেন। কিন্তু তাদের এই শ্রম, স্বাস্থ্য ঝুঁকি কখনো বিবেচনা করা হয়না। গ্রামীণ নারী কৃষকের কার্যকর স্বীকৃতি নেই। কৃষি ঋণ, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, বা অন্যান্য কৃষি সেবায় এবং বাজারে নারীর প্রবেশাধিকার সামাজিকভাবে বাঁধাগ্রস্ত। নারী পুরুষ মজুরি বৈষম্য প্রকট। এছাড়াও চলতি বাজারে দৈনন্দিন মজুরি অনেক কম।
পরে তিনি কিছু সুপারিশ তুলে ধরনে। তাহলো- কৃষি অফিস, বিএডিসি, কৃষি ব্যাংক বা অন্যান্য ব্যংকের কৃষি ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বয় তৈরি করতে হবে যাতে দরিদ্র প্রকৃত নারী কৃষকরা ঋণ সুবিধা পায়; নারী কৃষকদের একটি তালিকা তৈরি করে কৃষি অফিস সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে সরবরাহ করতে পারে যাতে নারী কৃষকরা ঋণ সুবিধা পেতে পারেন; সরকারী কৃষি ঋণ নীতিমালা সহজ ভাষায় কৃষদের সরবরাহ করতে হবে যাতে করে প্রকৃত কৃষকরা ঋণ পেতে আগ্রহী হন। কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচি সংক্রান্ত সেবাগুলো নিয়ে মাঠপর্যায়ে প্রচারণা চালাতে হবে; স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি অধিদপ্তর আয়োজিত কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে: কৃষি কাজে নারী শ্রমিকদের সমান মজুরিসহ পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস করা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষি শ্রমিকের অগ্রাধিকার দিতে হবে: নারীর কৃষক হিসেবে স্বীকৃতির অন্যতম একটি প্রতিবন্ধকতা হলো নারীর ভূমিহীনতা। কাজেই উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে; কৃষি খাসজমি বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করতে হবে। এলাকাগুলোতে প্রকৃত ভূমিহীনদের তালিকা তৈরি এবং নিয়মিত আপডেট রাখতে হবে। খাস জমি পেতে একা নারীর সক্ষম পুত্র সন্তান থাকার বিধান দ্রুত বাতিল করতে হবে; খাসজমি বিতরণ ও বন্টন নীতিমালাকে আইনে পরিণত করতে হবে; ভূমি সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে। খাসজমি জলমহাল, জলাভূমিতে দখলদারদের উচ্ছেদ করে প্রকৃত ভূমিহীনদের বরাদ্দ দিতে হবে: ভূমি অফিসকে দূর্নীতিমুক্ত এবং দালালমুক্ত করতে হবে। প্রশাসনকে অবশ্যই জনবান্ধব হতে হবে, ভূমিহীনদের প্রতিপক্ষ হিসেবে আচরণ বন্ধ করতে হবে।
প্যানেল আলোচনায় মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন শুদ্ধকৃষি ব্যবস্থায় গ্রামীণ নারীদের যুক্ত করতে হবে। তাদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। কৃষিতে গ্রামীণ নারীদের অবদান থাকলেও সেই কৃষি জমরি মালিকানা কাদের হাতে থাকছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। নারী কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৈষম্য কিভাবে হ্রাস করা যাবে এবং তাদের সম-মজুরি নিশ্চিত করা যাবে তার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
বিএলআরআই-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান ড. রেজিয়া খাতুন বলেন-কৃষিতে গ্রামীণ নারীরা শ্রম দেয়া ৬০-৯০ শতাংশ। কিন্তু পণ্যের লভাংশ পুরো চলে যায় পুরুষের হাতে। ফলে নারীরা শ্রম বিনিয়োগ করেও সুফল ভোগ করতে পরছে না। তিনি আরো বলেন নারীদের উন্নয়ন হতে হবে প্রযুক্তিভিত্তিক এবং এই বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষিতও করতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. রঞ্জন সাহা পার্থ বলেন- শুদ্ধ কৃষির সাথে গ্রামীণ নারী শ্রমের অত্যন্ত নিবীর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু বাজার ব্যবস্থার সাথে কৃষি যুক্ত হওয়ার ফলে কৃষির ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীর শ্রম প্রান্তিক অবস্থানে পৌছেছে। তিনি বাংলাদেশে এগ্রো টুরিজমের বা কৃষি পর্যটন তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করেন। বলেন-বাংলাদেশে এগ্রো টুরিজমের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে এবং এক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষি ঋণ নীতিমালার আলোচনায় এএলআরডি-র নির্বাহী পরিচালক বলেন শুধু কৃষি ঋণ নয়, গ্রামীণ নারী কৃষকের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে আমাদের চলমান কার্যক্রম ও দাবি-দাওয়া অব্যাহত রাখতে হবে। এই নীতিমালার আওতায় সকল সরকারি ব্যাংকসহ অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংককেও অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট অংশ যা নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে তা নিশ্চিত করতে হবে।
সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে খুশী কবির বলেন- আগেও যখন কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ ছিলো না তখনও নারীরা ফসল উত্তলোনের পরের সকল ধরনের কাজ নারীরাই করতো। এখন যখন কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বেড়েছে তখনও নারীরা ফসল পক্রিয়াজাতকরণের কাজের পাশাপাশি মাঠের কাজেও সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এতে বোঝাই যায় কৃষিতে নারীর অবদান অনস্বিকার্য। তারপরও নারীরা কৃষক হিসেবে অবমূল্যায়িত এবং যথাযথ স্বীকৃতি পাচ্ছেনা। ফলে নারীরা কৃষি ঋণ, কৃষি কার্ড ইত্যাদি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এতে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন তৃনমূলের নারী মনিরা বেগম, ফরিদপুর; সাবিনা হেমব্রম, দিনাজপুর; লামিয়া, পটুয়াখালী। তাছাড়া আসমা আক্তার মুক্তা, শাহদাৎ মন্ডল, বদরুল আলম, মাহবুব আলম, আরিফুজ্জামান, মেহনাজ মালা, লিপি প্রমুখ। এছাড়াও নারী অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, উন্নয়নকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধি এবং তৃণমূল থেকে নারী প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করবেন।
Leave a Reply