গ্রাম্য-মামলা
এইভাবে সাক্ষীদিগকে শিখাইতে শিখাইতে প্রায় রাত ভোর হইয়া আসিত। শেষরাতে উঠিয়া মা সাক্ষীদের জন্য রান্না করিয়া রাখিতেন। তাহা সাক্ষীরাই ধামায় করিয়া লইয়া সকালবেলা বাজানের সঙ্গে উকিলের বাড়ি যাইত। আমাদের উকিল আবার সাক্ষীদিগকে প্রশ্ন করিয়া সকলে ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পারিবে কি না পরীক্ষা করিয়া লইতেন। যাহারা ঠিক ঠিক উত্তর করিতে পারিত না তাহাদের সাক্ষী পরের দিনের জন্য নির্দিষ্ট হইত। ইতিমধ্যে বাজান তাহাদিগকে প্রশ্ন করিয়া তৈরি করিয়া লইতেন। পারতপক্ষে বাজান কোনো মামলায় হাত দিতেন না। কিন্তু যে মামলা তিনি করিতেন তাহাতেই জয়লাভ করিতেন। কারণ, তিনি মিথ্যা মোকর্দমা করিতেন না, এবং হাকিমের সামনে যাইবার আগে তিনি সাক্ষীদিগকে নানা প্রশ্ন করিয়া তৈরি করিয়া লইতেন।
কাছারিতে আসিয়া আমাদের লোকেরা কোনো বটগাছের তলায় বসিয়া বাড়ি হইতে আনা সেই ভাত-তরকারি খাইয়া সাক্ষী দেওয়ার জন্য তৈরি হইত। একঘেয়ে গ্রাম-জীবন হইতে ইহার মধ্যে কিছু বৈচিত্র্য আছে বৈকি!
মামলা-মোকদমা করা খুবই খারাপ, কিন্তু সকল খারাপের মধ্যেই কিছুটা ভালো মিশিয়া আছে। এই মামলা-মোকদমা উপলক্ষ করিয়া গ্রামবাসীদের মধ্যে এক-একটি দলের যে একতা গড়িয়া উঠে তাহার আনুগত্য অনুকরণীয়। এই দলীয় লোকেরাই পরে গ্রামে কাহারও কোনো বিপদ ঘটিলে জান-প্রাণ দিয়া আসিয়া সাহায্য করে। বন্যা, নদীতে বাড়ি ভাঙা, ডাঙা হইতে নৌকা পানিতে নামানো, নতুন ঘর তোলা প্রভৃতি ব্যাপারে যেখানে সমবেত কার্যের প্রয়োজন সেখানে এই দলবদ্ধ লোকগুলি অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেয়। এই সাহায্যের কৃতজ্ঞতা বংশ-পরম্পরায় মানুষে মানুষে আত্মীয়তার যোগসূত্র রচনা করে। এই মামলায় যাহারা আমাদের হইয়া সাক্ষী দিয়াছিল তাহারা এখন আর কেহ জীবিত নাই; কিন্তু তাহাদের সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতকুরদের সঙ্গে দেখা হইলে এই মামলার কাহিনী মনে করাইয়া দিয়া পূর্বকালে আমাদের প্রতি তাহাদের সাহায্য-প্রবণতাকে বর্তমানে টানিয়া আনিতে প্রয়াস পাই।
মুন্সেফ কোর্টে এই মামলায় আমরা জিতিলাম। বিপক্ষের লোকেরা জজকোর্টে এই মামলার আপিল দায়ের করিল। জজকোর্টের সওয়াল-জওয়াবের সময় তাহারা ভূতপূর্ব কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট অম্বিকাচরণ মজুমদার মহাশয়কে উকিল নিযুক্ত করিল।
মামলার তারিখের দিন সমস্ত কোর্ট লোকে লোকারণ্য। বারের প্রায় অধিকাংশ উকিলই সেইদিন অম্বিকাবাবুর সওয়াল-জওয়াব শুনিবার জন্য সেখানে আসিয়া একত্রিত হইয়াছিলেন। জহের ছিল আমাদের ক্লাসের বন্ধু। আমি তখন ক্লাস-টুর ছাত্র। আমি আর আমার বন্ধু জহের সেই মামলা দেখিবার জন্য কোর্টে আসিলাম। জহেরের বাবা এই মামলায় আমাদের বিপক্ষীয়দের মধ্যে একজন।
অম্বিকাবাবুর কণ্ঠস্বর উচ্চ হইতে উচ্চে উঠিয়া উদারা-মুদারা ছাড়াইয়া যাইতেছিল। মাইলখানেক দূর হইতেও সেই কণ্ঠস্বর শোনা যাইতেছিল।
আমার বন্ধু জহের বারবার বলিতেছিল, আল্লা! এই মামলায় বাপজান যেন জয়লাভ করেন। আমিও তাহারই মতো আমার পিতার জয়লাভের প্রার্থনা করিতেছিলাম। আমাদের দুইজনের এই বিপরীত প্রার্থনার জন্য আমাদের বন্ধুত্ব কোনো সময়ই ক্ষুণ্ণ হয় নাই।
এই মামলায় বাজান জয়লাভ করিলেন। বিপক্ষের লোকেরা একে তো মামলার জন্য যথেচ্ছ খরচ করিয়াছিল, এবার মামলায় হারিয়া আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে যাইয়া কেহ কেহ একেবারে সর্বস্বান্ত হইয়া পড়িল।
বন্ধুমহলে অথবা কোনো মজলিশে, সুযোগ পাইলেই বাজান এই মামলার আনুপূর্বিক সকল ঘটনা বলিয়া বড়ই গৌরব বোধ করিতেন।
চলবে…
Leave a Reply