শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৩ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৬০)

  • Update Time : মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

হানিফ মোল্লা

নদীতে এই বাঁধাল বাঁধিতে আমাদের গ্রামের প্রায় সকলেই অংশগ্রহণ করিত। তাহারা একত্র হইয়া যে গল্পগুজব ও গান করিত তাহাই ছিল আমার সবচাইতে আকর্ষণের বস্তু। হানিফ মোল্লাকে কেন্দ্র করিয়া নদীতে বাঁধ বাঁধা, মালদা হইতে আমের চালান আনা প্রভৃতি উপলক্ষ করিয়া আমাদের গ্রামবাসীদের মধ্যে যে সমবেতভাবে কাজ করার একটি পদ্ধতি গড়িয়া উঠিয়াছিল, তাঁহার মৃত্যু পরে ইহা ভাঙিয়া গেল। এই লোকটি তেমন শিক্ষিত ছিলেন না কিন্তু তাঁহার মধ্যে যে আকর্ষণকারী ব্যক্তিত্ব ছিল তাহারই বলে তিনি যাহাকে যাহা আদেশ করিতেন সে তাহা পালন করিয়া নিজেকে ধন্য মনে করিত। বর্ষা শেষ হইলে মাছ ধরার সমস্ত সাজসরঞ্জাম হানিফ মোল্লার বাড়িতে অতি যত্নের সহিত সংরক্ষিত হইত।

সেবার পানির তলা হইতে নৌকা উঠাইবার সময় তাঁহাকে কাছিমে কামড় দেয়। সেই যা দূষিত হইয়া তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। সেই ছোট গাহ্ এখনও তেমনি আছে। গ্রামের লোকদের একত্রিত করিয়া কেহ আর সেখানে বাঁধাল দিয়া মাছ মারে না। তাঁহার মৃত্যুর পর ছোট ভাই কাঙালী মোল্লা মহাজনের তবিল ভাঙিয়া খাইল। আমের বেপারীরা আর মালদার পথে যাইতে পারিল না। গ্রামের মধ্যে মাড়োয়ারির পাট গুদাম বসিল। বচন মোল্লা সেখানে চাকরি পাইলেন। বেশ ভালো বেতন। পাটের ধুলা ও আঁশ নাকে লাগিয়া কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর যক্ষ্মা হইল। সেই রোগেই তিনি মারা গেলেন।

পূর্বে যে মোকর্দমার কথা উল্লেখ করিয়াছি এই মোকর্দমায় হানিফ মোল্লা আমাদের বিপক্ষে ছিলেন। যত দিন মামলা চলিয়াছিল আমরা তাঁহার বাড়ি যাইতাম না। মামলায় হারিয়া একদিন হানিফ মোল্লা আমাদের বাড়ি আসিয়া আমার পিতার হাত ধরিয়া কি কি বলিলেন। সেই হইতে আমরা আবার হানিফ মোল্লার বাড়ি যাওয়া-আসা করিতে লাগিলাম। তাঁহার প্রতি আমার পিতার মনে যে অন্তঃসলিলা স্নেহধারা ছিল তাহা এই মামলা নষ্ট করিতে পারে নাই।

পূর্বেই বলিয়াছি আমাদের খড়ের ঘরের কেয়াড় বা দরজা বাঁশের তৈরি ছিল। মাটির ভিতরে বাঁশের চুঙ্গা গড়িয়া সে চুঙ্গার ভিতরে দরজার কাঠিটি আলগা করিয়া বসানো থাকিত। দরজা মেলিতে বা আটকাইতে কড়কড় করিয়া শব্দ হইত। সেবার বাজান হিন্দুপাড়া হইতে একজোড়া চৌকাঠ কপাট কিনিয়া আনিলেন। আমাদের পশ্চিম ঘরে যেখানে আমি, বাজান ও আমার ভাইরা শুইতাম সেই কপাট সেখানে লাগানো হইল। এই কপাট লাগাইয়া আমাদের ঘরের শোভা কিরূপ হইল দেখিবার জন্য এ-বাড়ি ও-বাড়ি হইতে কৌতূহলী গ্রাম্যবধূরা আমাদের বাড়ি আসিয়া জড় হইল। সেই কপাট খুলিয়া বন্ধ করিয়া তাহাদিগকে দেখাইয়া আমরা বেশ গৌরব বোধ করিতাম। ইহার পরে মেছের মোল্লার বাড়িসহ তাহার সমস্ত সম্পত্তি আমরা কিনিয়া ফেলিলাম। সেই বাড়ি হইতে একজোড়া কাঁঠাল কাঠের কপাট আনিয়া আমার মায়ের ঘরের দরজায় লাগানো হইল। তারপর আমাদের একখানা কাছারিঘরও হইল। বাজান একখানা চৌকি কিনিয়া আনিয়া সেখানে বসাইলেন। এইভাবে ধীরে ধীরে আমাদের ঘর-সংসারে বর্তমান সভ্যতা আসিয়া প্রবেশ করিতে লাগিল।

মেছের মোল্লার সমস্ত সম্পত্তির দাম ছিল পাঁচশত টাকা। মামলা করিয়া আমার পিতার হাতে অত টাকা ছিল না। স্থানীয় মহাজনরা তাঁহাকে বড়ই বিশ্বাস করিত। মহাজনের নিকট হইতে সুদে টাকা ধার করিয়া তিনি এই সম্পত্তি কিনিয়া ফেলিলেন। এই সম্পত্তির অর্ধেক বাজান তাঁর চাচাতো ভাইদের নামে লেখাইলেন। সেই জমিজমা লইয়া যদি কাহারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ বাধে, চাচাতো ভাইরা তখন বাজানের হইয়া লড়িবেন।

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024