যাদব ঢুলি
মেছের মোল্লার জমি কিনিয়া বাঁশগাড়ি দখল লইবার সময় যাদব ঢুলি ও তার ভাই ঢোল বাজাইতে আসিল। ধামায় করিয়া পান, বাতাসা লইয়া আমরা জমি দখল করিতে চলিলাম। প্রত্যেক খণ্ড জমিতে গর্ত করিয়া তাহার মধ্যে দুই-একটা তামার পয়সা দিয়া সেখানে বাঁশ গাড়িয়া দেওয়া হইল। বাঁশের আগায় আমাদের নিশান পতপত করিয়া উড়িতে লাগিল। ঢোলের বাজনা শুনিয়া যাহারা এখান হইতে ওখান হইতে আসিয়া জড় হইল, আমরা তাহাদের মধ্যে পান-বাতাসা বিতরণ করিলাম। যদি কেহ বাঁশগাড়ি করিতে আমাদিগকে বাধা দিত, তাহার জন্যও আমাদের লোকেরা প্রস্তুত ছিল। আমাদের পক্ষের দশ-বারোজন লোক হাতে লাঠি লইয়া আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যাইতেছিল।
এই বাঁশগাড়ির সময় যাদব ঢুলির সঙ্গে আমার বেশ ভাব হইয়া গেল। বাঁশগাড়ির কাজ শেষ হইলে সে যখন আমাদের বাড়ি খাইতে আসিল, তখন সে তাহার ঢোলটি ইচ্ছামতো আমাকে বাজাইতে দিল। ইতিপূর্বে এত বড় সম্মান বোধহয় আমাকে আর কেহ দেয় নাই। ইহার আগে বহুবার আমি যাদব ঢুলির বাজনা শুনিয়াছিলাম। নদীর ওপারে মদন চুলি ভালো ঢোল বাজাইত। সে ছিল জাতিতে বাউতি, চুন তৈরি করিত। যাদব জাতিতে মুসলমান। আমাদের গাঁয়েই তাহার বাড়ি। সেইজন্য আমরা তাহাকে লইয়া বড়ই গৌরব বোধ করিতাম। কোথাও মদন ঢুলির সঙ্গে তাহার ঢোলবাদ্যের তুলনা হইলে আমরা তর্ক করিয়া যাদব ঢুলিকে বড় করিতাম। হিন্দুদের বিবাহে যাদব যখন নাচিয়া নাচিয়া ঢোল বাজাইত, তখন মনে হইত তাহার ঢোলবাদ্যের সঙ্গে যেন ত্রিভুবন নাচিতেছে। এত বড় একজন ওস্তাদ লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হইল, এ কি কম সৌভাগ্যের বিষয়? যাদব আমাকে আরও বলিল, “আমার বাড়ি গেলে তোমাকে ঢোলবাদ্য শিখাইয়া দিব।”
একদিন সত্যসত্যই সকালে উঠিয়া যাদবের বাড়ি গেলাম। যাদব আমাকে আদর করিয়া তাহার বারান্দায় বসিতে দিল। যাদবের ঘর, উঠান, ঘরের মেঝে লেপা-পৌঁছা পরিষ্কার। উঠানের পাশে দুই-একটি ফুলের গাছ। সব মিলিয়া যেন পটে-আঁকা একখানা ছবি। যাদবের বউটি এমন সুন্দরী-তার মুখখানা যেন সিন্দুরের মতো ডুগু ডুগু করে। সেই বয়সের চোখ দুইটিই বুঝি সত্যকার সৌন্দর্য দেখার উপযুক্ত ছিল। সেই তো কতকাল আগে যাদবের বউকে দেখিয়াছিলাম, কিন্তু আজও আমার মনে হয় রং-তুলি পাইলে তাকে আমি তেমনি করিয়া আঁকিয়া দেখাইতে পারি। ঘরের কপাট ধরিয়া বউটি দাঁড়াইল। যাদব বউকে বলিল, “এ অমুকের ছেলে অমুক। আমার কাছে ঢোল বাজনা শিখিতে আসিয়াছে।”
মোল্লাবাড়ির ছেলে হইয়াও যে আমি ঢোলবাদ্য শিখিতে আসিয়াছি ইহা শুনিয়া বউটি হাসিয়া কুটিকুটি। যাদবের ছোট ভাইয়ের বউকে ডাকিয়া আনিয়া বলিল, “আয়, দেখ আসিয়া, কে নতুন কুটুম ঢোল বাজনা শিখিতে আসিয়াছে।” যাদবের ছোট ভাইয়ের বউ দেখিতে শ্যামলা রঙের। কিন্তু মুখের গঠন ছিল নিখুঁত। আর সেই মুখে কি যেন একরকম বউ-বউ ছবি আঁকা। যাদবের মা আমাকে ছাতু-মুড়ি আর গুড় দিয়া নাস্তা করাইল। আমার খাওয়া হইলে যাদব তাহার ঢোলটি লইয়া উঠানের মধ্যে কত কৌশল করিয়াই বাজাইতে লাগিল। তারপর নানারকমের ছড়া বলিয়া সেই ছড়ার তালে তালে ঢোল বাজাইল। ঢোলের তালে তালে বাড়ির বড় বউকে ডাকিল, “ও বড় বউ! কি কর?”
চলবে…
Leave a Reply