মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য
আমি যখন ক্লাসে টুতে উঠিলাম তখন এস. ডি. ও. বাবু বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য মহাশয়ের বাসা হইতে দুইটি ছাত্র আসিয়া আমাদের স্কুলে ভর্তি হইল। বিশ্বেশ্বরবাবুর ছেলে মনু ভর্তি হইল প্রথম শ্রেণীতে, আর তাঁহার ভাইপো জ্ঞানেন্দ্র ভর্তি হইল ক্লাস ফোরে। আমি তৃতীয় শ্রেণীতে উঠিলে মনোরঞ্জন ডবল প্রমোশন পাইয়া আমাদের শ্রেণীর সামিল হইল। অল্পদিনের মধ্যে মনু আমার বিশেষ বন্ধু হইয়া পড়িল। ক্লাসের পড়ায় কোনোবার আমি প্রথম হইতাম, কোনোবার মনু প্রথম হইত। অঙ্কে আমার সঙ্গে মনু পারিত না। গ্রীষ্মের ছুটির আগের দিনে একবার মনু টুলের উপর দাঁড়াইয়া একটি স্তোত্র আবৃত্তি করিয়াছিল। তাহার বালক-কণ্ঠের আবৃত্তি শুনিয়া শিক্ষক-ছাত্র সকলেই খুব প্রশংসা করিয়াছিলেন। সেই স্তোত্রটির দু’এক শব্দ মনে আছে।
অঞ্জন গঞ্জন ইত্যাদি।
আমিও একটি কবিতা আবৃত্তি করিয়াছিলাম। মনুর বালককালের চেহারা কতকটা আমার ছোট ভাই সৈয়দ উদ্দীনের মতো ছিল। একদিন আমার পিতা আমার মাকে এই কথা বলিতেছিলেন। তিনি মনুকে বড়ই স্নেহ করিতেন। মনু যতদিন জীবিত ছিল আমার সঙ্গে
দেখা হইলেই সে আমার পিতার কথা জিজ্ঞাসা করিত। ছুটির দিনে দুপুরবেলা আমি প্রায়ই মনুদের বাসায় যাইতাম। মনুর বাবা উদলগায়ে সবজিবাগানে কাজ করিতেন। ভয়ে কোনোদিনই তাঁহার সঙ্গে কথা বলি নাই। মাঝে মাঝে মনুর মাকে দেখিতাম। তাঁহার গায়ের বর্ণ সাদা ধবধব করিত। মায়ের আঁচল ধরিয়া মনু এটা-ওটা বায়না ধরিত।
আমাদের বাড়িতে কয়খানা বটতলার দোভাষী পুঁথি আর আমার পিতার পাঠ্যবইগুলি মাত্র ছিল। দোভাষী পুঁথি পড়া আমাদের বারণ ছিল। লুকাইয়া-ছাপাইয়া পড়িতে হইত। পিতার পাঠ্যবইগুলি পড়িয়া বুঝিবার ক্ষমতা তখনও হয় নাই। মনুদের বাড়িতে ছোটদের পড়িবার মতো অনেক বই ছিল। খুব সম্ভব ‘সন্দেশ’ কাগজখানাও তখন ছাপা হইত। মনুদের বৈঠকখানায় বসিয়া আমরা দুই বন্ধুতে সেই বইগুলি পড়িতাম। মাঝে মাঝে জল্পনা-কল্পনা করিতাম, বড় হইয়া আমরা এমনি সুন্দর সুন্দর বই লিখিব। বই ছাপা হইলে আমাদের কেমন নামডাক হইবে, নানা জায়গা হইতে আমাদের বয়সের ছেলেমেয়েরা কত তারিফ করিয়া পত্র লিখিবে। বই বেচিয়া আমরা যে টাকা পাইব তাহা দিয়া আমরা একটি বড় স্কুল খুলিব।
এমনি করিয়া সেই বালক-বয়সে কল্পনার জালকে যতদূর সম্ভব প্রসারিত করিয়া আমরা দুই বন্ধুতে মিলিয়া আমাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বর্ণনা করিয়া সারা দুপুর কাটাইতাম।
তৃতীয় শ্রেণী হইতে চতুর্থ শ্রেণীতে উঠিয়া মনু অপর স্কুলে চলিয়া গেল। তাহাতে মনে বড়ই বাথা পাইলাম। তবে ছুটির দিনে মনুর বাসায় যাইয়া দুই বন্ধুতে ছোটদের বই লইয়া আগের মতোই পড়াশুনা করিতাম।
ইহার বহু বৎসর পরে মনুর সঙ্গে দেখা হইল কলিকাতায়। আমি বোধহয় তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়ি। আমার ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ ও ‘রাখালী’ পুস্তক ছাপা হওয়ায় কতকটা সাহিত্যিক সুনামের অধিকারী হইয়াছি। আশ্চর্য হইয়া দেখিলাম মনুও আমারই মতন সাহিত্যিক হইয়া উঠিয়াছে। ‘রামধনু’ নামে ছোটদের একখানা মাসিক সে তখন প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তা ছাড়া ছোটদের উপযোগী দুই-তিনখানা পুস্তকও তাহার বাহির হইয়াছে। মনুকে বলিলাম, “দেখ ভাই, আমাদের বালক-বয়সের সেই সাহিত্যিক হইবার কল্পনা আজ তোমার আমার মধ্যে কতকটা সার্থক হইয়াছে।” শুনিয়া মনু একটু হাসিল। তারপর দুই বন্ধুতে মিলিয়া আমাদের বাল্যকালের কত ঘটনা লইয়া আলোচনা। যে-ঘটনা আমার মনে নাই মনু তাহা বলিয়া যাইতেছে, যে-ঘটনা মনু ভুলিয়া গিয়াছে আমি তাহার সূত্র ধরাইয়া দিতেছি।
চলবে…
Leave a Reply