মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য
কথা বলিতে বলিতে কথা আর শেষ হইতে চাহে না। আরও কত কথা আসিয়া পড়ে। সেদিন প্রথম জানিলাম, ময়নামতির গানের সম্পাদক এবং নানা পত্রিকায় বহু ঐতিহাসিক প্রবন্ধের লেখক বাবু বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য মহাশয় মনুর পিতা। ইহার পর ‘ময়মনসিংহ-গীতিকা’ লইয়া মনুর পিতার সঙ্গে বহুবার আলাপ হয়। মনুর মতোই তিনি আমাকে স্নেহ করিতেন। তাঁর সম্পাদিত ময়নামতির গান, গোপীচন্দ্রের গান দুইখণ্ড পুস্তক আমাকে উপহার দিলেন। বিশ্বেশ্বরবাবু আমাদের ফরিদপুর জেলার অধিবাসী ছিলেন। তিনি ফরিদপুর জেলার একটি বড় ইতিহাস পুস্তক রচনা করিবার জন্য মালমশলা সংগ্রহ করিতেছিলেন। এই পুস্তকের কয়েক অধ্যায় লিখিয়া তিনি মাসিকপত্রে প্রকাশও করিয়াছিলেন। কিন্তু এই কাজ তিনি সমাপ্ত করিয়া যাইতে পারেন নাই।
কলিকাতার রাস্তা-ঘাটে, সভা-সমিতিতে বহুবার মনুর সঙ্গে দেখা হইয়াছে। তাহার রামধনু পত্রিকায়ও কয়েকবার আমি লেখা দিয়াছি। সেবার শুনিয়া মর্মাহত হইলাম, মাত্র কয়েকদিনের অসুখে মনু চিরকালের মতো আমাদের ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। তাহার বৃদ্ধ পিতামাতা এই নিদারুণ পুত্রশোক কি করিয়া ভুলিয়াছেন কল্পনা করিতে পারি না। কি স্কুল-জীবনে কি পরবর্তী জীবনে মনুর মত নিরহঙ্কারী লোক খুব কমই দেখিয়াছি। তখনকার দিনে ডেপুটি বা এস. ডি. ও.-দের ছেলেরা বড়ই অহঙ্কারী ছিল। গরিব ছেলেদের সঙ্গে মিশিত না। মনু কিন্তু সকলের সঙ্গেই সমান মিশিত। আজও মনে পড়িতেছে মনুর সেই শ্যামল লাবণ্যভরা বালক-মুখখানি। আমারই ক্লাসের বন্ধু। আর তাহাকে কোথাও খুঁজিয়া পাইব না।
স্কুলে পড়িতে দুইটি ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কাটিয়াছিল। একদিন পরীক্ষার আগে শিক্ষকের নিকট হইতে প্রশ্নপত্র লিখিয়া লইতেছি। পাতলা কাগজে লেখা যায় না। তাই পাঠ্যবইখানা কাগজের তলায় লইয়া লিখিতেছি। প্রশ্ন হইয়াছে খুব সহজ। তাই মনের আনন্দে কাগজের তলায় বইখানাসহ আমার নির্দিষ্ট স্থানে যাইয়া প্রশ্নগুলির উত্তর লিখিতে আরম্ভ করিলাম। আমার খাতার তলায় যে বইখানা রহিয়াছে তাহা আমি ভুলিয়া গিয়াছি।
হঠাৎ হেডমাস্টার আসিয়া খাতার তলা হইতে বইখানা বাহির করিয়া আমাকে টানিতে টানিতে তাঁহার ডেস্কের সামনে লইয়া গিয়া আমাকে বেদম বেত্রাঘাত করিলেন। আমি কতবার বলিলাম, ভুলবশত বইখানা আমার খাতার তলায় ছিল। দেখুন স্যার। আমি একটি লাইনও বই দেখিয়া নকল করি নাই। কিন্তু কে আমার কথা বিশ্বাস করে। হেডমাস্টারের মার যে খাইলাম, সেজন্য আমার তো দুঃখ ছিল না। কিন্তু সমস্ত স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক জানিল আমি নকলকারী। আজ এই কথা লিখিতে সেই অপমানের আঘাত এখনও আমার মনে অনুভব করিতেছি। আমার পিছনে ফেলিয়া-আসা জীবনের অতীতের দিকে যতদুর চাই সেখানে এরূপ মিথ্যা অপরাধে বহু লাঞ্ছনার কাহিনী লিখিত হইয়া আছে। আমার আত্মজীবনীর পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে পাঠক এরূপ আরও কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হইবেন। বাবু হেরম্বলাল দাস নামে একজন ভদ্রলোক আমাদের স্কুলে নতুন শিক্ষক হইয়া আসিলেন।
তাঁহার শিক্ষাপ্রণালী ছিল অভিনব। ছোটদের শিক্ষকতা করিতে তাঁহার মতো এমন শিক্ষক খুব কমই পাওয়া যায়। তাঁহার মুখের কথা ছিল এমনই মধুময় যে তিনি ছাত্রদের কখনও মারধোর করিতেন না। তাঁহার হাতের লেখাটি ছিল ছাপার অক্ষরের মতো। পরবর্তীকালে আমি যখন কবি হইয়া উঠিয়াছি, তিনি আমার ‘বনফুল’ নামে একখানা কবিতা-সংগ্রহের বই নকল করিয়া দিয়াছিলেন।
চলবে…
Leave a Reply