রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২৩ পূর্বাহ্ন

স্টেম সেল: জীবনে নতুন আশা

  • Update Time : শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮.০০ এএম

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

পৃথিবী জুড়ে এখন আলোচিত হচ্ছে স্টেম সেল। অধিকাংশ ক্যানসার, পারকিনসন্স, জেনেটিকাল ডিজঅর্ডার, দৃষ্টিহীনতা, কয়েক ধরনের ডায়াবেটিস, জটিল হৃদরোগ, চুলপড়া, হাড়ভাঙাসহ অনেক দুরারোগ্য রোগকেও স্টেম সেল ব্যবহার করে দূর করার কাজ চলছে। কেউ কেউ তা বাস্তবে পরিণত করেছেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্টেম সেলের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ায় তা গতিময়তা লাভ করে। বাংলাদেশে কিছু ক্ষেত্রে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট হলেও ব্যাপক অর্থে স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা এখনো উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে নয়।

স্টেম সেলকে এক কথায় বলা যায় মাদার সেল বা মাতৃকোষ। এই সেল থেকেই সারা দেহের বিভিন্ন কোষের সৃষ্টি হয়। জন্মের সময় বাবা মায়ের শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু মিলিত হয়ে এককোষী জাইগোট তৈরি হয়। সেই এক কোষ থেকে দুই কোষ, দুই থেকে চার- এভাবে ধীরে ধীরে মাতৃগর্ভে প্লাসেন্টার ভেতর বেড়ে ওঠে মানব শিশু। একটি মাত্র মাতৃকোষ থেকে সব তৈরি হলেও চামড়া, হাড়, মাংস, হৃদপিণ্ড, লিভার এদের কোষের গঠন এক নয়, টিস্যুর গড়ন আলাদা। এক পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা ভাবতে থাকেন, স্টেম সেল হলো এমন মাতৃকোষ যা থেকে যে কোনো সময় যে কোনো কোষ তৈরি করা সম্ভব। তাই কোনো ভাবে যদি স্টেম সেল সংরক্ষণ করা যায়, তবে পরবর্তী সময়ে কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে তার শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত অংশে প্রয়োজনীয় স্টেম সেল সরবরাহ করা গেলে তা থেকে উপশম সম্ভব হবে।

উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, মানুষের দেহের সাধারণ কোষগুলো ১২০ দিন বেঁচে থাকে। তারপর সেখানে নতুন কোষের জন্ম হয়। আগের কোষ মারা যাওয়াতে শূন্যস্থানে নতুন কোষ পূর্ববর্তী কোষের কাজগুলো যথাযথ ভাবে করতে পারে।

কিন্তু যখন একজন মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন তখন তার ক্ষতিগ্রস্ত অংশে কোষগুলো ১২০ দিন পরেও বেঁচে থাকে। এদিকে নিয়মিত নতুন কোষ তৈরি হয়ে সে জায়গায় জমতে থাকে। যার ফলে ক্যানসার আক্রান্ত অংশ ফুলে ওঠে। অনেকের কাছে যা টিউমার হিসাবে পরিচিত। এই বাড়তি কোষগুলো শরীরে অসুবিধার সৃষ্টি করে। কেমো থেরাপির মাধ্যমে এই আক্রান্ত কোষগুলোকে সাময়িকভাবে দমন করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে কোষ বেড়ে যায় স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে। তখন আবার কেমো দিতে হয়। এই কেমো পুরো শরীরের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তার ফলে অনেক সুস্থ কোষ মারা যায়। রোগীর চুলপড়াসহ নানান উপসর্গ দেখা যায়।

এখন যদি আক্রান্ত অংশে রোগীর শরীরের সঙ্গে মিলে যায় এমন স্টেম সেল সরবরাহ করা যায় তবে সেই সেলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত অংশে গিয়ে নিজেদের প্রয়োজন মতো কোষ তৈরি এবং প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ নিজেরাই করতে পারে। এতে করে সেই অংশে কোনো কেমো দেয়ার প্রয়োজন হয় না বরং আদি কোষ নিজেই অসুস্থ অংশকে সুস্থ করে তোলে। যেভাবে জন্মের সময় সে একজন মানুষের সব কোষ তৈরি করে এবং বিপদ থেকে রক্ষা করে ঠিক একই নিয়মে। এই পদ্ধতিতেই স্টেম সেল ব্যবহার করে অনেক জায়গায় ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় স্থায়ী সুফল পাওয়া যাচ্ছে। এতে খরচও পড়ছে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম।


২.

স্টেম সেল নিয়ে ইংল্যান্ডে কয়েক দশক ধরে টিম লিডার হিসাবে কাজ করছেন বাংলাদেশের গবেষক ডা. জাফর সাদিক।

বাংলাদেশে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট হচ্ছে। সেটা কি মূলত স্টেম সেল নয়?

এর উত্তরে ডা. জাফর সাদিক বলেন, স্টেম সেল দুই রকমের থাকে। পরিণত এবং অপরিণত। পরিণত স্টেম সেল দিয়ে যে কাজ করা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি ফলাফল পাওয়া যায় অপরিণত স্টেম সেল থেকে। মানুষের হাড়ের ভেতর যে স্টেম সেল থাকে সেটা পরিণত স্টেম সেল। সাধারণত মানব দেহের কোনো গুরুত্বপূর্ণ হাড় ক্ষয় হয়ে গেলে দেহের অন্য জায়গার হাড়ের ভেতর থেকে স্টেম সেল নিয়ে সেই ক্ষয়গ্রস্ত হাড়ে দেয়া হয়। সেখানে স্টেম সেল ক্ষয় রোধে সাহায্য করে। এটা স্টেম সেলের গবেষণায় একেবারে প্রাথমিক অবস্থা। বাংলাদেশে এটা কিছু কিছু হচ্ছে। এই পদ্ধতি বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট নামে এখানে পরিচিত।

ডা. জাফর সাদিক জানান, অধিকাংশ ক্যানসার, পারকিনসন্স, জেনেটিকাল ডিজঅর্ডার অর্থাৎ সব ধরনের প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টিহীনতা, কয়েক ধরনের ডায়াবেটিস, জটিল হৃদরোগ, চুলপড়া, হাড়ভাঙাসহ অন্তত সতেরটি গুরুতর রোগের চিকিৎসায় স্টেম সেল ব্যবহার করে উপকার পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে কিছু এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। কিছু ক্ষেত্রে রোগের চিকিৎসায় স্টেম সেল এখন হসপিটালগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে মূলত অপরিণত স্টেম সেল ব্যবহৃত হচ্ছে।

অপরিণত স্টেম সেলের উৎস কোথায়? জানা যায়, মানবদেহে অপরিণত স্টেম সেলের সবচেয়ে বড় উৎস হলেন সন্তান জন্ম দেয়া মা নিজে! মায়ের গর্ভে যে স্থানটিতে ভ্রুণ অবস্থা থেকে শিশুটি বেড়ে ওঠে সেটাকে বলে প্লাসেন্টা। এটি একটি গোলাকার ফুলের মতো বস্তু। যার ভেতর তরলের মধ্যে শিশুটি ভাসতে থাকে। এটি নিরাপদ আবরণ হিসাবে কাজ করে। এখান থেকেই শিশুর খাবার সরবরাহ হয়। একমাত্র ভাইরাস ছাড়া আর কোনো ক্ষতিকর পদার্থ এর মধ্যে ঢুকতে পারে না। এই প্লাসেন্টার সঙ্গে একটি কর্ড বা নাড়ি যুক্ত থাকে। যা দিয়ে মায়ের শরীর থেকে রক্ত ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদার্থ শিশুর দেহে যায়। এই নাড়িটি জন্মের পরও শিশুর নাভির সঙ্গে যুক্ত থাকে।

৩.

সাধারণ অবস্থায় সন্তান জন্মের কিছুক্ষণের মধ্যেই তার দেহ আবরণ অর্থাৎ প্লাসেন্টা মায়ের শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। সাধারণত প্লাসেন্টা এবং তার কর্ড বা নাড়িটি ফেলে দেয়া হয়। কারণ এটার আর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। বিস্ময়কর হলেও সত্য এই ফেলা দেয়া বস্তুটিই হলো স্টেম সেলের আধার। প্লাসেন্টা এবং কর্ডে যে পরিত্যক্ত রক্ত থাকে যা কর্ড ব্লাড নামে পরিচিত তা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে সেখানে পাওয়া যায় গড়ে পঞ্চাশ হাজার থেকে দুই বিলিয়ন স্টেম সেলা

ডা. জাফর সাদিক জানান, তিনি নিজে একবার প্লাসেন্টা ও কর্ড থেকে ২৬৯ এম রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করে তাতে এক দশমিক আট বিলিয়ন স্টেম সেলের অস্থিত্ব খুঁজে পান। তিনি জানান, বাইরে বেরিয়ে এলেও রুম টেমপারেচারে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্টেম সেল নষ্ট হয় না। এর মধ্যে যদি একে সংরক্ষণ করা যায় এবং মাইনাস ২৭৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনে রাখা যায় তবে শত শত বছরেও স্টেম সেলের কোনো ক্ষতি হবে না। এভাবে রক্ষণাবেক্ষণের পদ্ধতিকে বলা হয় ক্রায়ো প্রিজারভেশন। রক্ত সরিয়ে নেয়ার পর প্লাসেন্টাটি ফেলে দেয়া হয় না। এটিকে প্রক্রিয়াজাত করে ক্যাপসুল তৈরি করা হয় যা গর্ভবতী মায়েদের জন্য প্রোটিনের প্রয়োজন মেটায়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় প্লাসেন্টা ইনক্যাপসুলেশন।

ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেকগুলো দেশেই স্টেম সেল সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বৃটেনের কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান এনএইচএস বা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ব্যবস্থাপনায় প্রায় প্রতিটি হসপিটালে স্টেম সেল রিসার্চ ইউনিট খোলা হয়েছে। হসপিটালগুলোতে সিজারিয়ান অপারেশনের পর প্লাসেন্টা ও কর্ডের ভেতর রক্ষিত রক্ত অর্থাৎ কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করা হচ্ছে। মায়েদের কাছে আবেদন করা হচ্ছে কর্ড ব্লাড দান করার জন্য।

8.

অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণের উদ্যোগ নিচ্ছেন। ভবিষ্যতে সন্তান যদি কোনো দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয় তবে তারই রেখে দেয়া স্টেম সেল থেকে তার চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। রক্ষিত স্টেম সেল থেকে অন্তত চার বার চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার অন্য কোনো রোগীর সঙ্গে যদি প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টরগুলো মিলে যায় তবে তাকেও স্টেম সেল দেয়া যেতে পারে। বিষয়টা একজনের রক্ত অন্যকে দেয়ার মতো। তবে স্টেম সেলের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি একটু জটিল।

স্টেম সেল সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক গড়ে ওঠেছে। অনেকটা ব্লাড ব্যাংকের মতো। ডা. জাফর সাদিক জানান, ইংল্যান্ডে যে প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আছে তাদের মধ্যে ফিউচার হেলথ, সেলস ফর লাইফ স্মার্ট সেলস অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠানে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের জন্য স্টেম সেল সংরক্ষণ করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ভাবে স্টেম সেল ব্যাংক গড়ে ওঠেছে।

বাংলাদেশেও বেশ কয়েক বছর আগে এক সেমিনারে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান স্টেম সেল সংরক্ষণ ও চিকিৎসার ওপর জোর দেন। ভারতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাই তার নিজ সন্তানের স্টেম সেল সংরক্ষণের ঘোষণা দেন। তিনি প্রত্যেক মাকে এই উদ্যোগে অংশ নিতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা আমাদের মেয়ে আরাধ্যার স্টেম সেল সংরক্ষণ করেছি। এটা খুবই ছোট্ট, কিন্তু অমূল্য উপহার যা আমরা সন্তানদের দিতে পারি। যারাই ভবিষ্যতে মা, বাবা হওয়ার কথা ভাবছেন তাদের প্রত্যেকের স্টেম সেল ব্যাংকিং সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। নারীর স্টেম সেল প্রকৃতির সম্পদ। আমাদের উচিত সেই সম্পদ সংরক্ষণ করা।’

৫.

কিছু জায়গায় স্টেম সেল সংরক্ষণ ও এর মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদানকে অনৈতিক বলা হচ্ছে। একে ভ্রুণ হত্যার সঙ্গেও তুলনা করছেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. জাফর সাদিক বলেন, ভ্রুণ হত্যা হলো যে সন্তানটি জন্ম নিতে যাচ্ছে তাকে মেরে ফেলা। আর আমরা স্টেম সেল সংগ্রহ করছি সন্তান জন্ম হওয়ার পর ফেলে দেয়া প্লাসেন্টা থেকে। যার সঙ্গে সন্তান হত্যার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং এটি সন্তানের ভবিষ্যতকে অনেক বেশি নিরাপদ করছে।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমরা কার্টনে করে অনেক সময় মাল আনি। তারপর সেটি ফেলে দিই। কিন্তু কার্টন বা প্যাকেটের গায়ে যদি লেখা থাকে রিইউজেবল তাহলে আমরা কিন্তু তা কাজে লাগাই। প্লাসেন্টাও ঠিক তাই। রক্ত দেয়া, চোখ দান করা যদি বৈধ হয় তবে স্টেম সেল দান করা বা সংরক্ষণ করাও বৈধ। এতে মানুষের কল্যাণ হচ্ছে।

 

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক। 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024