দেবযানী কুর্চি কাঁকন
মন খারাপ? চলো পাহাড়ে যাই। এই যে কিছু হলেই শান্তির খোঁজে ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় পাহাড়ে এটা কেবলই পাহাড়ের অমলিন সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক রূপের জন্য। এই ব্যস্ততার মাঝে পাহাড়ের শান্ত পরিবেশে এসে আমাদের জীবন এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। এই সৌন্দর্য শুধু প্রাকৃতিক নয়, এটি মানব সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং পরিচয়ের অংশও। বিশেষ করে আদিবাসী জনগণের জন্য, যাদের জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতি পাহাড়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী মানুষেরাই বাঁচিয়ে রেখেছে এই পাহাড়কে।
ময়মনসিংহের টেংরামারী ক্যাম্পের সংলগ্ন এক মাটির ঘরে বিউটি নকরেকের বাস। ছেলেবেলায় পাহাড়ে ছেলেবেলায় পাহাড় ধসে হারিয়েছেন নিজের ছোট ভাইকে, তারপর থেকেই তিনি বোঝেন যে পাহাড়, গাছ এবং গাছের শিকড় – এই প্রকৃতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর যাতে কোন বোনকে পাহাড় ধসের কাছে নিজের ভাইকে হারাতে না হয় তাই এ যাবতই বৃক্ষরোপণ করেছেন তাই এক হাজারেরও বেশি।
প্রাচীন যুগে যখন বাঙালিরা সমতল ভূমিতে জীবন জীবিকা নির্বাহ করা শুরু করলো তখন আদিবাসীরা বেছে নিয়েছিল পাহাড়কে। পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের সাথে লড়াই করে বাস করা শুরু করে, পাহাড়ের খাড়া ঢাল, শক্ত ভূমিতে বেঁচে থাকার তাগিদে ফসল ফলানোর উদ্দেশ্যে আবিষ্কার করল জুম চাষ, ড্রায় ফার্মিং, ড্রপ চাষ, আঁকড়ে লাগানো, মিশ্র চাষ, বৃষ্টির জল সংগ্রহ ইত্যাদি। শুরুর দিকে পাহাড়ে বসবাস অতটা সহজ ছিল না, অনেক সংগ্রাম, পরিশ্রম, চড়াই-উৎরাই পার করে পাহাড়িরা পাহাড়কে বসবাসের উপযোগ্য করে তুলেছে। টেকসই চাষাবাদ করে পরিবেশ ও মাটি রক্ষা করছে। সাধারণ মানুষের জন্য পাহাড়ে গিয়ে পাহাড়ের লীলাভূমি দেখা সহজ করেছে ও জীবন ঝুঁকি কমিয়েছে ।
পাহাড়ে বাস করা আদিবাসী জনগণ প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তারা নিজেরাই এখন প্রকৃতির অংশ, তাদের জীবনযাত্রা পাহাড়ের পরিবেশের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সংগতিপূর্ণ। এদের খাদ্য, সংস্কৃতি, এবং সমাজ জীবনের ভিত্তি পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ। পাহাড়ের ফলমূল, গাছপালা, পশু-পাখি—সবকিছুই আদিবাসীদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা পাহাড়কে একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে দেখতে পায়। তাইতো এই পাহাড়ের রক্ষণাবেক্ষণেও তারা সচেষ্ট।
আদিবাসীরা পাহাড় রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে থাকে। পাহাড়ের বনাঞ্চল রক্ষা করা আদিবাসীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বনাঞ্চলকে ঘিরে তাদের অস্তিত্ব টিকে আছে। আদিবাসীরা বিশ্বাস করে যে বন ও পাহাড় তাদের পূর্বপুরুষদের পবিত্র স্থান। তাই তারা সর্বদা এসব স্থান রক্ষায় সচেষ্ট থাকে। কিন্তু বাঙালিদের যেন আদিবাসীদের এসব সংগ্রাম, লড়াই চোখেই পড়ে না। তারা সব সময় আদিবাসীদের নিয়ে হাস্যরসাত্মক, ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য, তাদেরকে অবহেলা, অবমাননা এবং সুবিধাবঞ্চিত করে রেখেছে অনেকাংশে।
বনভূমি দেশের পরিবেশ, অর্থনীতি, জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণভাবে, একটি দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমির প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে মোট ভূমির ১৭% বনভূমি রয়েছে। এই ১৭ শতাংশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বনভূমি রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ,সিলেট বিভাগ অর্থাৎ পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে। আর পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে বসবাস আদিবাসীদের। অর্থাৎ সমীকরণ মিলছে তো? আমাদের পরিবেশ রক্ষায় আদিবাসীদের গুরুত্ব কতখানি! যেখানে সমতল ভূমিতে জীবিকাকে পুঁজি করে বাঙালিরা গাছপালা কেটে বনভূমি ধ্বংস করছে। অপরদিকে আদিবাসীরা এসব বনভূমি রক্ষায় সংগ্রাম করে চলেছে।
পাহাড়ি ও তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, ভিন্ন জীবনচিত্র আমাদের সংস্কৃতিকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে। যা বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত করে। নানান রঙ ঢঙের মানুষের বসবাস এই বাংলায়, বৈচিত্র্যময় বাংলার এই হল ভিত্তি। একই ভূখণ্ডে এত নানা রঙের মানুষের বসবাস আন্তর্জাতিক মহলে দৃষ্টিনন্দন কৃষ্টি।
একইভাবে বাঙালি ও পাহাড়ের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গাঢ় করতে পারলে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশীরা উদাহরণের নাম হয়ে থাকবে।
পরিশেষে বলা যায়, “আদিবাসী আছে বলেই পাহাড় টিকে আছে।” তাদের সংস্কৃতি, জীবনধারা এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা পাহাড়ের সৌন্দর্য ও স্থায়িত্ব বজায় রাখতে অপরিসীম ভূমিকা রাখে। তারা প্রকৃতির রক্ষক এবং পরিবেশের সুরক্ষায় নেতৃত্বদানকারী। তাদের অংশগ্রহণ ও সমর্থন ছাড়া পাহাড়ের সৌন্দর্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই, আমাদের উচিত আদিবাসীদের এই মূল্যবান জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সমর্থন করা এবং তাদেরকে পরিবেশ সুরক্ষায় আরও শক্তিশালী করার জন্য কাজ করা।
ফুটবল, দাবা, ভার উত্তোলন– আদিবাসী কিশোর-কিশোরীদের বিশ্বজয়ের অদম্য সম্ভাবনা
বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ এবং প্রতিভার অভাব নেই । ফুটবল, দাবা এবং ভার উত্তোলন এই তিনটি খেলায় তাদের অর্জন উল্লেখযোগ্য। চ্যালেঞ্জ, মেধা, কৌশলের যুদ্ধের নাম দাবা। সঠিক পরিকল্পনা কিংবা একটা চালের ভুলে খোয়াতে পারেন মন্ত্রী। এমনই এক চ্যালেঞ্জিং কৌশলগত যুদ্ধে নিজ মেধার দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত আদিবাসী কিশোরী দাবায় বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন প্রজ্ঞা পারমিতা প্রান্তা। তুখোড় মেধাবী এই দাবাড়ু প্রজ্ঞা পারমিতা প্রান্তার সাথে কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর আমরা জানতে পারি, “কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তার, ছিলনা কোন ট্রেনিং এর আয়োজন। বাবার কাছে দাবা খেলার হাতেখড়ি তার। বাবার শেখানো কৌশল আর দৃঢ় মনোবল এই পুঁজি করে আজ সে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ময়মনসিংহ থেকে । শুধু একজন দুর্দান্ত দাবাড়ু নয় পাশাপাশি একজন ফুটবল খেলোয়াড়ও ”। একইভাবে প্রজ্ঞা পারমিতা প্রান্তা, স্বর্ণালী চাকমা, মহর্ষি মেহাই – এই মানুষগুলোর সাথে কথা বলে আমরা জানতে পারি, কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সহায়তা ছাড়াই দাবার মতো চ্যালেঞ্জিং খেলায় এরা পটু। মূলত জিনগতভাবে এরা খেলাধুলায় বেশ তুখোড়। শুধু ফুটবলেই নয় দাবার গুটিতেও বাজিমাত করেন এই আদিবাসী কিশোর-কিশোরীরা। এই খেলার মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রতিভা প্রদর্শন করে এবং সমাজের মূলধারায় তাদের অবস্থান শক্তিশালী করছে।
দাবা একটি মানসিক খেলা, যা পরিকল্পনা এবং কৌশলের প্রয়োজন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে দাবার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে, বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে। বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে দাবার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও ভার উত্তোলনেও আদিবাসীদের জুড়ি মেলা ভার। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যুবকরা এই খেলায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে এবং অনেকেই পদক জিতেছে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি ভার উত্তোলন প্রতিযোগিতায় ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর একজন প্রতিযোগী স্বর্ণপদক জয়লাভ করে সমাজের সম্মান বৃদ্ধি করেছে। তাদের এ অর্জন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের কলসিন্দুর মেয়েদের গল্প জানেনা এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর; তাদের অর্জন এবং অবদান সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ অবগত। সবাই তাদেরকে শ্রদ্ধা করে এবং ভালোবাসে। কিছুদিন আগে যখন কলসিন্দুরের মেয়েরা এ দেশের নাম উজ্জ্বল করে দেশে ফিরল, তখন সাময়িক সময়ের জন্য হলেও বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ গণমাধ্যমের চোখে এসে পড়েছে– কিভাবে তাদের ঘর করে দেয়ার প্রতিজ্ঞা দিয়েও বাসস্থান তৈরি করে দেয়া হয়নি, কিভাবে তারা দিনের পর দিন এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সমাজের বাধা-বিপত্তি এবং দারিদ্র্যের কষাঘাতকে উপেক্ষা করে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছে; নিজের দেশের নাম উজ্জ্বল করেছে।
এই জনগোষ্ঠীর কিশোর কিশোরীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় খেলাধুলা, ভার উত্তোলন এবং মেধার কৌশলের নজির । জিনগতভাবেই তারা সাধারণ মানুষের তুলনায় শক্তিশালী এবং খেলাধুলাতে পারদর্শী । দুর্দান্ত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের শীর্ষ অনিহার শিকার হয়েছে আদিবাসীরা। তারা আজকে কোনোরকম ট্রেনিং, কোন রকম কোচিং এবং যথাযথ নির্দেশনা ছাড়াই এ সকল অঞ্চল থেকে এই ছেলেমেয়েরা উঠে আসছে নিজ মেধার জোরে যারা আন্তঃজেলা, আন্তঃবিভাগ এবং কখনো না কখনো জাতীয় পর্যায়েও খেলার সুযোগ পাচ্ছে কিংবা আগামীতে পাবে। কিন্তু তাদেরকে সঠিক মূল্যায়ন ও যথাযথভাবে তুলে আনতে বাংলাদেশ ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ব্যর্থ । আজকে হাজারো মারিয়া মান্দা, ঋতুপর্ণা চাকমা, রুপনা চাকমা যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং সুযোগের অভাবে জাতীয় দল পর্যন্ত আসতেই পারছে না; হারিয়ে যাচ্ছে প্রাথমিক ধাপেই। ইন্টারনেটের প্রচলন ও ব্যবহার পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের মত জায়গাগুলোতে তেমনভাবে না থাকলেও কিন্তু তারা দাবার মতো মেধার খেলাতে হয়ে যাচ্ছে বারংবার চ্যাম্পিয়ন। মনে করে দেখুন, প্রজ্ঞা পারমিতা প্রান্তার কথা যে কিনা কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং দাবা সম্পর্কিত কোন পড়াশোনা ছাড়াই কেবলমাত্র বাবার কাছ থেকে শিখে এ বছর আন্ত:বিভাগীয় দাবাতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সে স্বপ্ন দেখে একদিন জাতীয় পর্যায়ে খেলার এবং কোন একদিন বাংলাদেশের পতাকা বুকে জড়িয়ে নিজের দেশকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থাপন করার। ঠিক যেমনটি করছেন, আমাদের দেশের ৮০ বছর বয়সী ‘রানী হামিদ’।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন দাবা অ্যাসোসিয়েশনের সঠিক দৃষ্টি যদি এই জনগোষ্ঠীর উপর এসে পড়ে তবে এখান থেকে আমরাও বাংলার গ্র্যান্ডমাস্টার ভ্লাদিমির ক্রামানিক পেতে পারি। তার পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, ক্রিকেট এবং ফুটবল বোর্ড যদি তাদের শুভ দৃষ্টি আদিবাসী কিশোর কিশোরীর প্রতিভার উপর রাখে তবে আমরা আরো ইতিহাস গড়ার কারিগর খুঁজে পেতে পারি।
মনে রাখতে হবে, ফুটবল, দাবা এবং ভার উত্তোলনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অর্জন শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং একটি বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষণ। এই খেলার মাধ্যমে তারা নিজেদের পরিচয়, সংস্কৃতি এবং প্রতিভা প্রকাশ করছে। সেই সাথে এই অর্জনগুলো আগামীতে দেশ ও জাতির উন্নতির সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কিশোর কিশোরীদের মধ্যে আশা ও উৎসাহ সঞ্চার করবে।
দেবযানী কুর্চি কাঁকন, এইচএসসির ২৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী
বিজ্ঞান বিভাগ, মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ , ঢাকা।
Leave a Reply