বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৩ অপরাহ্ন

পুলিশের বাধা সত্ত্বেও চট্টগ্রামে সনাতন জাগরণ মঞ্চের সমাবেশ

  • Update Time : শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৪, ১০.৫৪ এএম
পুলিশ সমাবেশের অনুমতি না দেয়ার পরও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ চট্টগ্রামের সমাবেশে যোগ দেন

হারুন উর রশীদ স্বপন 

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানান ডনাল্ড ট্রাম্প।

শুক্রবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বাধা দিলেও চট্টগ্রামে সনাতন জাগরণ মঞ্চের সমাবেশ হয়েছে। শনিবার ৮ দফা দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮ দফা দাবিতে সমাবেশ করবেন সংখ্যালঘুরা৷

বৃহস্পতিবার ডনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের নিন্দা জানানোর আগে ঢাকা সফর করে যাওয়া জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের বক্তব্যেও এসেছিল সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গ৷ বৃহস্পতিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ” আগস্টের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন তথ্যানুসন্ধান করছে।” তিনি আরো বলেন, “সংস্কার কাঠামোতে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, সেইসাথে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।”

ডনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ বলেন, ” আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।”

তিনি প্রেসিডেন্ট থাকার সময় এমন কখনো হয়নি দাবি করে ট্রাম্প আরো বলেন, ‘‘কমলা ও জো (বাইডেন) বিশ্বজুড়ে ও অ্যামেরিকায় হিন্দুদের উপেক্ষা করে আসছে।” এক্স অ্যাকাউন্টের পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রেও ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে হিন্দুদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প৷

১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে সমাবেশ

আজ (শুক্রবার) চট্টগ্রামের চেরাগি পাহাড় এলাকায় ‘সনাতন জাগরণ মঞ্চ-‘এর ডাকে মহাসমাবেশ হয়েছে। সমাবেশে যোগ দিতে আসার পথে অনেকের ওপর পুলিশ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সমাবেশস্থলেও পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশ সমাবেশের অনুমতি না দেয়ার পরও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ওই সমাবেশে যোগ দেন। আট দফা দাবি এবং ‘সনাতন জাগরণ মঞ্চের’ মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা  মামলার প্রতিবাদে তারা এই সমাবেশের ডাক দেয়। ৩০ অক্টোবর দায়ের করা এই মামলায় এরই মধ্যে দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগে ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে মহাসমাবেশ করে তারা। পুরো চট্টগ্রাম থেকে লংমার্চ করে হিন্দুরা ওই সমাবেশে যোগ দেন।

‘সনাতন জাগরণ মঞ্চের’ মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “পাঁচ আগস্টের পর হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা হয়েছে, মন্দিরে হামলা হয়েছে, লুটপাট হয়েছে। ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত সপ্তাহেও ঘরের মধ্যে দুইজন নারী নিহত হয়েছেন। একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বর্ডার যদি খোলা থাকতো, তাহলে হিন্দুরা বাঁচার জন্য ভারতে যেতে পারতো। এবার বর্ডারও বন্ধ আছে। তাই সবাই বাঁচার জন্য মাঠে নেমেছে।”

তার কথা, “আমরা জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ থেকে এখন ৭.৮ শতাংশে নেমে এসেছি। এইজন্য আমরা আমাদের সুরক্ষার জন্য আট দফা দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছি। যারা এই সরকারকে দেশে-বিদেশে ব্রিবতকর অবস্থায় ফেলতে চায়, যারা সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ করতে চায়, তারাই এই হামলা করছে। এবং আমরা যাতে মাঠে না থাকতে পারি, সেই উদ্দেশ্যে মামলা করেছে। আমরা নিরাপত্তা চাই। এবং আরো বৃহৎ পরিসরে মাঠে নামবো।”

বর্তমান অন্তর্বতী সরকারের হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “সরকার এ পর্যন্ত ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এই সরকার। সেখানে ১৩ শতাংশ সংখ্যালঘু থেকে কাউকেই রাখা হয়নি। এটা কীভাবে হয়?”

গত ৩০ অক্টোবর সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়৷ চট্টগ্রামের কোতোয়ালীয় থানায় রাষ্ট্রদ্রোহের এই মামলাটি করেন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান। ওই মামলা করার কারণে শুক্রবার তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন চান্দগাঁও থানার সভাপতি মোহাম্মদ আজম।

বিবৃতিতে বলা হয়, দলের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

কোতোয়ালী থানায় দায়ের হওয়া মামলায় দাবি করা হয়েছে, “গত ৫ অগাস্ট গণঅভুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা নিউমার্কেট মোড়ে একটি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। গত ২৫ অক্টোবর লালদিঘী মোড়ে সমাবেশের দিন ওই পতাকার ওপর সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় গোষ্ঠী ইসকনের গেরুয়া রঙের ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করে স্থাপন করে দেয়া হয়, যা রাষ্ট্রের অখণ্ডতাকে অস্বীকার করার শামিল।”

কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহিদুল কবির বলেন, “আমরা মামলাটি তদন্ত করে দেখছি। এই তদন্ত পর্যায়ে আর কিছু বলতে পারছি না। ”

সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার প্রশ্ন ও সরকারের ভূমিকা

মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের  সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ” ৫ আগস্টের পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। এটা যতটা সাম্প্রদায়িক, তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক। এখানে রাজনৈতিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটেছে। তবে ঢালাওভাবে সাম্প্রদায়িক হামলা বলা যাবে না।”

তার কথা, “এখন আর সেই ধরনের পরিস্থিতি নেই। তবে আতঙ্ক কাটেনি। আর ওই সাম্প্রদায়িক হামলার পর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা এখনো দৃশ্যমান হয়নি।”

হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ঢালাও মামলা দেয়ার প্রবণতা চলছে। এখানে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বার্থে এইসব মামলা করছে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।”

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, “হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা আমাদের হামলার একটি তালিকা দিয়েছেন। সেই তালিকা ধরে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। যেসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে, সেইসব অভিযোগের ব্যাপারে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। যখনই কোনো ঘটনা ঘটেছে, তখনই হয় মামলা, নয় জিডি করা হয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনা অ্যাড্রেস করা হয়েছে।”

তার কথা, “দেশের সব নাগরিকের নিরাপত্তার ব্যাপারেই পুলিশ সজাগ আছে। দেশে এখন এমন কোনো পরিস্থিতি নেই যে,  কারো আতঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে।”

শনিবার শাহবাগে সমাবেশ

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দীপঙ্কর ঘোষ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ” শনিবারের মহাসমাবেশ শুধু ঢাকায় নয়, এক যোগে দেশের ৬৪ জেলায় হবে। সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চার উদ্যোগে এই সমাবেশ ডাকা হয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ সংখ্যালগুদের ৩১টি সংগঠন মিলে এই জোট।”

তার কথা, “আমাদের হিসাবে ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর দুই হাজার ১০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরপর আরো অনেক হামলার ঘটনা ঘটেছে। আমরা পুলিশ সদর দপ্তরে এই তালিকা দিয়েছি। তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছে।  হামলা কমে এলেও এখনো ওই হামলাগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখনো সংখ্যালঘুরা আতঙ্কে আছেন। আর এই সময়ে আমাদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রানাদাস গুপ্তসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে।”

“জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক সংখ্যালঘু নির্যাতনের তদন্তের কথা বলেছেন। ডনাল্ড ট্রাম্প সংখ্যালঘু নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন । সরকারের উচিত দ্রুত সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার করা,” বলেন তিনি।

তাদের আট দফা দাবির মধ্যে আছে: ১. সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দোষীদের দ্রুততম সময়ে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্তদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা । ২. অবিলম্বে ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে। ৩. ‘সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠন করতে হবে। ৪. হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে ‘হিন্দু ফাউন্ডেশন’-এ উন্নীত করতে হবে। পাশাপাশি বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকেও ফাউন্ডেশনে উন্নীত করতে হবে। ৫. ‘দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন এবং ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন’ যথাযথ বাস্তবায়ন । ৬. সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ এবং প্রতিটি হোস্টেল প্রার্থনাকক্ষ বরাদ্দ করতে হবে। ৭. ‘সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড’ আধুনিকায়ন করতে হবে। ৮. শারদীয় দুর্গাপূজায় পাঁচ দিন ছুটি দিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসবে প্রয়োজনীয় ছুটি দিতে হবে।

ডিডাব্লিউ ডটকম

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024