শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:২০ পূর্বাহ্ন

ছাত্ররা কি ‘কিংস পার্টি’ গঠনের চেষ্টা করছে?

  • Update Time : শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৪, ১১.৫২ এএম
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ

তাফসীর বাবু

বাংলাদেশে সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং সংবিধান বাতিলের মতো দাবিতে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা গেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন পক্ষকে। গত কয়েকদিনে ধারাবাহিকভাবে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকও করেছে তারা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিক কমিটির এভাবে মাঠে নামার পর এর নেপথ্যে কী কারণ থাকতে পারে সেটা নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে রাজনীতিতে।

রাষ্ট্রপতির অপসারণের মতো পদক্ষেপ দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি করতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে বিরোধিতা করেছে বিএনপি। আবার এতে করে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

যদিও আন্দোলনকারীরা বলছেন, ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা বা নির্বাচন পিছিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তুতি নেয়ার মতো কোনও কৌশল তাদের নেই।

‘কিংস পার্টি’ গঠনের চেষ্টা?

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা এখন তিনভাগে বিভক্ত হয়ে তিনরকম ভূমিকা পালন করছেন।

ছাত্রনেতাদের তিনজন আছেন সরকারে, বাকিরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর জাতীয় নাগরিক কমিটির ব্যানারে পালন করছেন নানা কর্মসূচি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করতে দেখা যাচ্ছে এসব নেতাদের। তবে এসব প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্যে যুক্ত নেই সরকারে থাকা তিন ছাত্র প্রতিনিধি।

যদিও ছাত্রদের এসব উদ্যোগকে অনেকেই বলছেন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের আগের পর্যায় হিসেবে।

তাহলে কি ক্ষমতায় থেকে নেপথ্যে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের চেষ্টা করছেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা?

পাঁচ দফা দাবি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা

এমন প্রশ্নে ক্রীড়া ও শ্রম মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অবশ্য বলছেন, কোনো ধরনের রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা তারা করছেন না।

“দেখেন আমরা দল গঠন করছি কি না এই প্রশ্নটা কোথা থেকে উত্থাপিত হলো? এটা উঠলো কারণ মানুষ চেয়েছে যে, গণঅভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তারা একটা রাজনৈতিক দল করুক। কিন্তু আমার জানামতে ছাত্ররা সেখানে এখনও সায় দেয় নাই।”

“আর কিংস পার্টির যে কথা বলছেন, সেখানে সরকারের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। সেটা করা হলে আপনাদের এতোদিন নজরে পড়তো। ছাত্রদের বা নাগরিক কমিটির কেউ যদি রাজনৈতিক দল খুলতে চায়, তাদের সে অধিকার আছে। কিন্তু আমাদের জায়গা থেকে আমরা প্রথম দিন থেকেই বলে আসছি জাতীয় ঐক্য তৈরির জন্য। এবং জাতীয় ঐক্যর ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করতে পারে এমন কিছুই আমরা আমাদের জায়গা থেকে সাজেস্ট করবো না।”

বাংলাদেশে অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনা শুরু হয় যায় সেপ্টেম্বরে যখন ঢাকায় আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি।

একইসময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও ধারাবাহিক সফর শুরু করেন বিভিন্ন জেলায়।

তবে দল গঠনের আলোচনাটা দেখা যায় মূলত নাগরিক কমিটিকে ঘিরে।

সংগঠনটি ইতোমধ্যেই ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক কাঠামো চূড়ান্ত করেছে। দেশের অধিকাংশ জেলার সম্ভাব্য কমিটিও প্রস্তুত। যেগুলো পরে রাজনৈতিক দলের কাঠামো হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

কিন্তু নাগরিক কমিটি কি আসলেই কোনও রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে?

“ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা একটা তারুণ্যের যে শক্তি আমরা চাই ঐ শক্তিটা আগামীর ক্ষমতায় আসুক। এখানে নাগরিক কমিটি যে ডিরেক্ট দল গঠন করে তাদেরকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে তেমনটা না। আমরা চাই সামগ্রিকভাবে বিএনপি হোক, জামায়াত হোক বা অন্য দল হোক, তারা তরুণদের কাছে ক্ষমতাটা দিয়ে দিক। কারণ তরুণরা পচে-গলে যায় নাই। তারা কারও সঙ্গে আঁতাত করে নাই,” বলছিলেন, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী।

কিন্তু দলগুলো যদি তরুণদের ক্ষমতায়িত না করে তাহলে কী হবে?

এমন প্রশ্নে মি. পাটোয়ারীর বলছেন, যারা তরুণদের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারবে না, তারা আগামীতে ক্ষমতায় যেতে পারবে না।

“তাদের ক্ষমতার পথ বাধাগ্রস্ত করার জন্য এবং ভালো একটা মানুষকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিক কমিটি কাজ করবে। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে যে কেউ দল গঠন করতে পারে। তবে সেটা এই প্লাটফর্ম থেকে হবে না,” বলছিলেন পাটোয়ারী।

ক্রীড়া ও শ্রম মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া

ছাত্রদের উদ্যোগ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘কনফ্লিক্ট’ তৈরি করতে পারে?

নাগরিক কমিটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তেমনটা বলছে না। আবার ভবিষ্যতে দল গঠনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা উপদেষ্টা বলছেন, দল গঠনের কোনও কার্যক্রমে তারা নেই, সহায়তাও করছেন না।

কিন্তু নানা ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। বিশেষত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রপতির অপসারণের মতো বিষয়ে এখনও ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে না।

রাজনীতি বিশ্লেষক এবং লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ছাত্ররা যদি সত্যিই দল গঠন করতে চায় সেটা অস্বাভাবিক হবে না। তবে দল গঠনের জন্য সময় প্রয়োজন।

“দেখেন, এখন যা হচ্ছে তার অনেক কিছুকেই পরে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে হবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে। সুতরাং ছাত্ররা এক্ষেত্রে চাইতেই পারেন যে, সে সরকারটা যেন তাদের হয় বা অন্তত পরবর্তী নির্বাচনে যেন তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য নির্বাচিত হন। সুতরাং এমন ভাবনা থাকলে দল গঠনের চিন্তা অস্বাভাবিক না।”

কিন্তু এমন একটি দলের কতটা সফল হওয়ার সুযোগ আছে?

“এখন যদি জনআকাঙ্ক্ষার সত্যিকারের প্রতিফলন দিতে নতুন কোনও দল আসে এবং জনগণের কাছে সে বার্তাটা তারা পৌঁছাতে পারে। তাহলে এখনকার বিরাজমান ধারার বিপরীতে ঐ ধারাটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে এর জন্য সময় লাগবে। এখন জুলাই বিপ্লব যারা করেছেন, তারা যে লক্ষ্যে এটা করেছেন, সেটা অর্জন না করা পর্যন্ত ক্ষমতার রাশ তারা আলগা করতে চাইবেন না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা করতে গেলে অন্যদের সঙ্গে তাদের কনফ্লিক্ট হতে পারে।”

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং সংবিধান বাতিলের মতো দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন পক্ষ মাঠে নামার পর এর নেপথ্যে কী কারণ থাকতে পারে সেটা নিয়ে নানা রকম বিশ্লেষণ আছে।

এটা দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি করতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে বিরোধিতা করেছে বিএনপি। আবার এতে করে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসুদ বলছেন, ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা বা নির্বাচন পিছিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তুতি নেয়ার মতো কোনও কৌশল তাদের নেই।

“আসলে সিঁদুরে মেঘ দেখে যদি কেউ ভয় পায়, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটাবো এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তুলবো- এই কথাটাই আমাদের এক দফার মধ্যে ছিল। এর জন্যই আমরা কাজ করছি। আমরা রাজনৈতিক দল গঠন করছি না কিংবা কারো জন্য পরিবেশ তৈরিতেও কাজ করছি না।”

তবে বাস্তবতা যেটাই হোক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা নাগরিক কমিটি এখন অনেকটা রাজনৈতিক পক্ষ হয়েই তাদের পাঁচ দফা দাবি নিয়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক করছে।

তাদের এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কতটা সফল হবে সেটার উপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যতে ছাত্র এবং নাগরিক কমিটির রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা দলীয় রূপ নিয়ে সামনে হাজির হবে নাকি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকবে।

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024