নভেম্বরে জারি হতে যাচ্ছে ৪৭তম বিসিএসের প্রজ্ঞাপন। আর এতে অংশ নেয়া পরীক্ষার্থীদের কোটার ক্ষেত্রে আসতে পারে পরিবর্তন।
এর আগে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে গত ২১ই জুলাই কোটা পুনর্বহালে হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করে আপিল বিভাগ।
রায়ে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে।
বাকি সাত শতাংশের মধ্যে পাঁচ শতাংশ থাকবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ করে কোটা থাকবে।
তবে আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, ‘অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ’ রেখে কোটা পদ্ধতির সংস্কার।
গত ২৪শে অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর ও একজন পরীক্ষার্থী সর্বোচ্চ তিনবার বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারবে এমন সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
যদিও ৩১শে অক্টোবর সে সিদ্ধান্ত কিছুটা পরিবর্তন আসে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, চাকরি প্রার্থীরা তিনবারের বদলে চারবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন মর্মে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
তবে কোটা আগের মতোই থাকবে না তাতে পরিবর্তন আসবে এ বিষয়ে নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব আরিফ সোহেল।
নভেম্বরে প্রজ্ঞাপন, যা বলছে সরকার
আগামী নভেম্বরে ৪৭তম বিসিএসের প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা এস. এম. মতিউর রহমান।
৩ হাজার ৪৬০টি পদের জন্য অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই নিয়োগের ‘কার্যক্রম চলমান’ বলেও জানান তিনি।
কোটার বিষয়ে সবশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় এ বছর ২৩শে জুলাই।
প্রজ্ঞাপনে সাত শতাংশ কোটা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরঙ্গনার সন্তানদের জন্য পাঁচ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের কথা জানানো হয়।
সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ৯ম থেকে ২০তম গ্রেডের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে তা কার্যকরের কথা বলা হয়।
তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসহ সব মিলিয়ে মোট পাঁচ শতাংশ কোটা রেখে কোটা পদ্ধতির ‘যৌক্তিক সংস্কার’।
আন্দোলন পরবর্তী সময় এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিসিএস পরীক্ষায় কি আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কোটা বরাদ্দ থাকবে?
নাকি নতুন করে কোটা বণ্টনের নির্দেশনা আসবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব এবং বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বিবিসি বাংলাকে জানান, “এখন পর্যন্ত নতুন করে কিছু চিন্তা করা হয়নি।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব আরিফ সোহেল
‘সাত পারসেন্ট রাখা দাবির সঙ্গে যায়নি’
কোটা কতটুকু রাখা হবে তা নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটির এই সদস্য সচিব আরিফ সোহেল।
তিনি বলেন, “আমাদের দাবি ছিল পাঁচ পারসেন্ট। পরবর্তীতে কমিশন করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে একটি সাম্যমূলক ব্যবস্থা তৈরি করা এবং গবেষণা করে কোটা যতটুকু রাখা দরকার পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলোকে সামনে নিয়ে আসার জন্যে– ততটুকু রাখা।”
কোটার পরিমাণ সাত শতাংশ রাখা পুরোপুরি শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে যায়নি উল্লেখ করে এই ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলেও জানান তিনি।
“এটাকে (কোটা) কীভাবে পরিবর্তন করা যায় বা পরে করবো না এখনই পরিবর্তন করার ব্যাপারে কাজ করবো, সে ব্যাপারে ডিসিশন নেবো,” বলেন মি. সোহেল।
সাত শতাংশ কোটা রাখার বিষয়টি দাবির অনেকটা কাছাকাছি হলেও পুরোপুরি ‘কমপ্লাই’ করে না বলেও মন্তব্য করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটির এই সদস্য সচিব।
“আমরা আবার রিভিউ করবো এটা কীভাবে হওয়া উচিৎ এবং তারপর আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো।”
সেক্ষেত্রে ‘এটা পাঁচ পারসেন্টে রাখা কিংবা এই বিসিএস সাত পারসেন্ট রেখে পরবর্তীতে কমিশন গঠন করার’ মতো সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলেও জানান মি. সোহেল।
তবে এবার আর আগের মতো আর আন্দোলনের প্রয়োজন হবে না বরং পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
কোটা নিয়ে সংকটের শুরু যেভাবে
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল।
সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করা হয়।
পরবর্তী সময়ে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদেরও এই ৩০ শতাংশ কোটায় চাকরিতে আবেদনের সুযোগ তৈরি হয়।
সবমিলিয়ে সরকারি চাকরিতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা, জেলা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী– এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল।
অর্থাৎ কোটা ছাড়া কেবল মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হতো ৪৪ শতাংশ, যার মোট পরিমাণ কোটার চাইতে কম।
তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে কোটার জন্য বরাদ্দ বেশি থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে এনিয়ে বরাবরই অসন্তোষ ছিল।
তবে তা বড় আকারের আন্দোলনে রূপ নেয় ২০১৮ সালে।
ওই বছর জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার সংস্কার চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়েরের পর ঘটনা পরিক্রমায় আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।
টানা আন্দোলন কর্মসূচির মুখে ১১ই এপ্রিল সংসদে দাঁড়িয়ে সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অক্টোবর মাসে এনিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিল করে সরকার।
আলী ইমাম মজুমদার
২০২১ সালে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের হাইকোর্টে রিট দায়েরের পরিপ্রেক্ষিতে এই বছরের পাঁচই জুন আগের মতো কোটা বহালের পক্ষে রায় দেয় আদালত।
রায়ে অসন্তোষ জানিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র ব্যানারে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের সন্তান’ বলা নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং আবু সাঈদের মৃত্যুর পর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
এরইমধ্যে ২১শে জুলাই আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২৩শে জুলাই কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
তারপরও থামেনি আন্দোলন। ওইদিনই সংবাদ সম্মেলন করে সমন্বয়করা জানান, “কোটা আন্দোলন ঘিরে যে রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার দায় সরকার এড়াতে পারে না।”
এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে পাঁচই অগাস্ট ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা আর তার তিনদিন পর আটই অগাস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বিসিএস পরীক্ষা দেয়া যাবে সর্বোচ্চ চারবার
কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য সরকারি চাকরি প্রত্যাশীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে।
সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২৪শে অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্ব-শাসিত সংস্থাসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা নির্ধারণ অধ্যাদেশ, ২০২৪’ এর খসড়ার নীতিগত চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়।
এই অধ্যাদেশের আলোকে ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’-এর ধারা ৫৯-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা, ২০১৪’ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় “একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ চার বার অবতীর্ণ হতে পারবে”- এমন বিধি সংযোজন করতে পারবে।
সেইসাথে, বিসিএস-এর সকল ক্যাডারের চাকরিতে ও বিসিএস-এর আওতা বহির্ভূত সকল চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছর হবে।
তবে স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজস্ব নিয়োগ বিধিমালা অনুসরণ করতে পারবে।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply