বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:০০ অপরাহ্ন

ভূত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

  • Update Time : শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭.০০ পিএম

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

কি বাদামই হোত শ্রীশ পরামানিকের বাগানে। রাস্তার ধারেই বড় বাগানটা। অনেক দিনের প্রাচীন গাছপালায় ভর্তি। নিবিড় অন্ধকার বাগানের মধ্যে-দিনের বেলাতেই।

একটু দূরে আমাদের উচ্চ প্রাইমারি পাঠশালা। রাখাল মাস্টারের স্কুল। একটা বড় তুঁত আছে স্কুলের প্রাঙ্গণে। সেজন্যে আমরা বলি ‘ভূততলার স্কুল।’

গাছ দুজন মাস্টার আমাদের স্কুলে। একজন হলেন হীরালাল চক্রবর্তী। স্কুলের পাশেই এর একটা হাঁড়ির দোকান আছে, তাই এঁর নাম ‘হাঁডি-বেচা-মাস্টার’।

মাস্টার তো নয়, সাক্ষাৎ যম। বেতের বহর দেখলে, পিলে চমকে যায় আমাদের। টিফিনের সময় মাস্টার মশায়েরা সব ঘুমুতেন। আমরা নিজের ইচ্ছেমতো মাঠে-বাগানে বেড়িয়ে ঘণ্টাখানেক পরেও এসে হয়তো দেখি তখনও মাস্টার মশায়দের ঘুম ভাঙে নি। সুতরাং তখন আমাদের টিফিন শেষ হোল না-টিফিনের মানে হচ্ছে ছুটি মাস্টার মশায়দের, ঘুমুবার ছুটি।

সেদিনও এমনি হোল।

রেল লাইন আমাদের স্কুল থেকে অনেক দূরে। আমরা মাৎলার পুল বেড়িয়ে এলাম, রেল লাইন বেড়িয়ে এলাম-ঘণ্টাখানেক পরে এসেও দেখি এখনও হাঁড়ি-বেচা-মাস্টারের নাক ডাকচে।

নারাণ বললে-ওরে চুপ চুপ, চেঁচাস নি, চল ততক্ষণ পরামানিকদের বাগানে বাদাম খেয়ে আসি-

আমাদের দলে সবাই মত দিলে।

আমি বললাম-বাদাম পাড়া সোজা কথা?

তলায় কত পড়ে থাকে এ সময়- –

-চল তো দেয়ি-

এইবার সবাই আমরা মিলে পরামানিকদের বাগানে ঢুকলাম পুলের তলার রাস্তা দিয়ে। দুপুর দুটো, রোদ ঝম ঝম করচে। শরৎকাল, রোদের তেজও খুব বেশি।

গত বর্ষায় আগাছার জঙ্গল ও কাঁটা ঝোপের বেজায় বৃদ্ধি হয়েচে বাগানের মধ্যে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সুড়িপথ। এখানে-ওখানে মোটা লতা গাছের ডাল থেকে নেমে নিচেকার ঝোপের মাথায় দুলচে। আমরা এ বাগানের সব অংশে যাই নি, মস্ত বড় বাগানটা। পাকা রাস্তা থেকে গিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত লম্বা।

পেয়ারাও ছিল কোনও কোনও গাছে। কিন্তু অসময়ের পেয়ারা তেমন বড় হয় নি। ফল আরও যদি কোনও রকম কিছু থাকে, খুঁজতে খুঁজতে নদীর ধারের দিকে চলে গেলাম। বাদাম তো মিললোই না। যা বা পাওয়া গেল, ইট দিয়ে ছেঁচে তার শাঁস বের করবার ধৈর্য আমার ছিল না। সুতরাং দলের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। নদীর দিকে বন বেজায় ঘন। এদিকে বড় একটা কেউ আসে না।

খস্ খস্ শব্দে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে শেয়াল চলে যাচ্ছে। কুল্লো পাখি ডাকচে উঁচু তেঁতুল গাছের মাথায়। আমার যেন কেমন ভয় ভয় করচে। আমাদের স্কুলের ছেলেরা কানে হাত দিয়ে গায়-

ঠিক দুক্ষুর বেলা-

ভূতে মারে ঢ্যালা-

ভূতের নাম রসি হাঁটু গেড়ে বসি-

সঙ্গে সঙ্গে তারা অমনি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। এসব করলে নাকি ভূতের ভয় চলে যায়।

আমার সঙ্গে কেউ নেই-ঠিক দুপুর বেলাও বটে। মন্তরটা মুখে আউড়ে হাঁটু গেড়ে বসবো? কিন্তু ভুতের নাম রসি হোল কেন, শ্যামও হতে পারতো, কালো হতে পারতো, নিবারণ হতেই বা আপত্তি কি ছিল? একটা বাঁক ঘুরে বড় একটা বাঁশবন আর নিবিড় ঝোপ তার তলায়।

সেখানটায় গিয়ে আমার বুকের ঢিপঢিপ শব্দ যেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। একটা আমড়া গাছের তলায় ঘন ঝোপের মধ্যে আমড়া গাছের গুঁড়ি ঠেস দিয়ে বসে আছে বরো বাগদিনীই। ভালো করে উঁকি মেরে দেখলাম। হ্যাঁ, ঠিক বরো বাগদিনীই বটে, সর্বনাশ!

সে যে মরে গিয়েছে।

বরো বাগদিনীর বাড়ি আমাদের গাঁয়ের গোঁসাই পাড়ায়। অশত্থতলার মাঠে একখানা দোচালা কুঁড়ে ঘরে সে থাকতো, কেউ ছিল না তার। পাল মশায়ের বাড়ি ঝি-গিরি করতো অনেক দিন থেকে। তারপর তার জ্বর হয় এই পর্যন্ত জানি। একদিন তাকে আর ঘরে দেখা যায় না। মাস দুই আগের কথা। একটা স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গেল বাঁওড়ের ধারে বাঁশবনে-শেয়াল কুকুরে তাকে খেয়ে ফেলেছে অনেকটা। সেই রকমই কালো রোগা-মতো দেহটা, বরো বাগদিনীর মতো। সকলে বললে, জ্বরের ঘোরে বাঁওড়ে জল তুলতে গিয়ে বরো গিয়েচে। সেই বরো বাগদিনী আমড়া গাছের গুঁড়ি ঠেস দিয়ে দিব্যি বসে।

আমি এক ছুটে বনবাগান ভেঙে দিলাম ছুট পাকা রাস্তার দিকে। যখন বাদামতলায় দলের মধ্যে এসে পৌঁছলাম তখন আমার গা ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে। ছেলেরা বললে-কি হয়েচে রে? অমন কচ্ছিস্ কেন?

আমি বললাম-ভূত।

-কোথায় রে? সে কি? দূর-

-বরো বাগদিনী বসে আছে ঝোপের মধ্যে আমড়াতলায় সেই নদীর ধারের দিকে।

স্পষ্ট বসে আছে দেখলাম।

-নিজের চোখে দেখলাম। এক্কেবারে স্পষ্ট বরো বাগদিনী- -দূর-চল তো যাই দেখি কেমন? তোর মিথ্যে কথা-

-সে কিরে? তা কখনও হয়?

সবাই মিলে যেতে উদ্যত হোল-কিন্তু সেই সময় দলের চাঁই নিমাই কলু বললে, না ভাই। ওর কথায় বিশ্বাস করে অতদূর গিয়ে স্কুলে ফিরতে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। এতক্ষণ মাস্টারদের ঘুম ভেঙেচে। হাঁড়ি-বেচা মাস্টারের বেতের বহর জানো তো। সে ঠ্যালা সামলাবে

কে? আমি ভাই যাবো না-তোমরা যাও-ওর সব মিথ্যে কথা- ছেলের দলের কৌতূহল মিটে গেল হাঁড়ি-বেচা-মাস্টারের বেতের বহর স্মরণ করে। একে একে সবাই স্কুলের দিকে চললো। আমিও চললাম।

আমরা গিয়ে দেখি মাস্টার মশায়দের ঘুম খানিক আগেই ভেঙেচে ওঁদের গতিক দেখে মনে হোল। হাঁড়ি-বেচা-মাস্টার আমাদের শূন্য ক্লাস রুমের সামনে অধীরভাবে পায়চারি করছিলেন-আমাদের আসতে দেখে বলে উঠলেন-এই যে। খেলা ভাঙলো?

আমরাও বলতে পারতাম, আপনার ঘুম ভাঙলো? কিন্তু সে কথা বলে কে? তাঁর ক্রুদ্ধ দৃষ্টির সামনে আমরা তখন সবাই এতটুকু হয়ে গিয়েছি।

ক্লাসে ঢুকেই তিনি হাঁকলেন-রত্না। অর্থাৎ আমি। এগিয়ে গেলুম। -কোথায় থাকা হয়েছিল?

আমি তখন নবমীর পাঁঠার মতো জড়সড় হয়ে কাঁপচি। এদিকে বরো বাগদিনী ওদিকে হাঁড়ি-বেচা-মাস্টার। আমার অবস্থা অতীব শোচনীয় হয়ে উঠেচে। কিন্তু শেষ অস্ত্র ছিল আমার হাতে, তা ত্যাগ করলাম। বললাম-পণ্ডিত মশাই, দেরি হয়ে গেল কেন ওরা জানে। এই সর্ব পরামানিকের বাগানে বাদাম কুড়ুতে গিয়ে ভুত দেখেছিলাম-তাই- হাঁড়ি-বেচা-মাস্টারের মুখে অবিশ্বাস ও আতঙ্ক যুগপৎ ফুটে উঠলো। বললেন-ভূত? ভূত কি রে?

-আজ্ঞে, ভূত-সেই যারা-

-বুঝলাম বাঁদর। কোথায় ভূত? কি রকম ভূত?

সবিস্তারে বললাম। আমার সঙ্গীরা আমায় সমর্থন করলে। আমায় কি রকম হাঁপাতে হাঁপাতে আসতে দেখেছিল, বললে সে কথা। হাঁড়ি-বেচা-মাস্টার ডেকে বললেন-শুনচেন দাদা? রাখাল মাস্টার তামাক খাওয়ার যোগাড করছিলেন, বললেন-কি?

-ওই কি বলে শুনুন। রত্না নাকি এখুনি ভূত দেখে এসেচে সর্ব পরামানিকের বাগানে।

-সর্ব পরামানিক কে?

-আরে, ওই শ্রীশ পরামানিকের বাবার নাম। ওদেরই বাগান।

আবার বর্ণনা করি সবিস্তারে।

রাখাল মাস্টার গোঁড়া ব্রাহ্মহ্মণ, হাঁচি, টিকটিকি, জল-পড়া, তেল-পড়া সব বিশ্বাস করতেন। গম্ভীরভাবে ঘাড় নেড়ে বলেন, তা হবে না? অপঘাত মৃত্যু-গতি হয় নি- হাঁড়ি-বেচা-মাস্টার একটু নাস্তিক প্রকৃতির লোক। অবিশ্বাসের সুর তখনও তাঁর কথার মধ্যে থেকে দূর হয় নি। তিনি বললেন-কিন্তু দাদা, এই দুপুর বেলা, ভূত থাকবে বাগানে বসে গাছের গুঁড়ি ঠেস দিয়ে।

-তাতে কি? তা থাকবে না ভূত এমন কিছু লেখাপড়া করে দিয়েচে নাকি? তোমাদের আবার যত সব ইয়ে-

-আচ্ছা চলুন গিয়ে দেখে আসি। ছেলেরা সবাই সমস্বরে চিৎকার করে সমর্থন করলে।

রাখাল মাস্টার বললেন, হ্যাঁ, যত সব ইয়ে-ভূত তোমাদের জন্যে সেখানে এখনও বসে আছে কি না? ওরা হোল কি বলে অশরীরী-মানে ওদের শরীর নেই-ওরা মানে বিশেষ অবস্থায়- হাঁড়ি-বেচা-মাস্টার বললেন-চলুন না দেখে আসি গিয়ে কি রকম কাণ্ডটা, যেতে দোষ কি?

আমরা সকলেই তো এই চাই। এঁরা গেলে এখুনি ইস্কুলের ছুটি হবে এখন। সেদিকেই আমাদের ঝোঁকটা বেশি।

যাওয়া হোল সবাই মিলে।

হুড়মুড় করে ছেলের পাল চললো মাস্টারদের সঙ্গে।

আমি আগে আগে, ওরা আমাদের পেছনে।

সেই নিবিড় ঝোপটাতে আমি নিয়ে গেলাম ওদের সকলকে। যে-দৃশ্য চোখে পড়লো, তা কখনও ভুলবো না-এত বৎসর পরেও সে দৃশ্য আবার যেন চোখের সামনে দেখতে পাই এখনও।

সবাই মিলে ঝোপ-ঝাপ ভেঙে সেই আমড়াতলায় গিয়ে পৌঁছলাম।

যা দেখলাম, তা অবিকল এই।

আমড়াগাছের তলায় একটা ছেঁড়া, অতি-মলিন, অতি-দুর্গন্ধ কাঁথা পাতা, পাশে একটা ভাঁড়ে আধ ভাঁড়টাক জল। একরাশ আমড়ার খোসা ও আঁটি জড়ো হয়েচে পাশে কতক টাটকা, কতক কিছু দিন আগে খাওয়া, একরাশ কাঁচা তেঁতুলের ছিবড়ে, পাকা চালতার ছিবড়ে শুকনো।

ছিন্ন কাঁথার ওপর জীর্ণ-শীর্ণ বৃদ্ধা বরো বাগদিনী মরে পড়ে আছে। খানিকটা আগে মারা গিয়েচে।

এ সমস্যার কোনও মীমাংসা হয় নি! আমরা হৈ হৈ করে বাইরে গিয়ে খবর দিলাম। গ্রাম্য চৌকিদার ও দফাদার দেখতে এল। কেন যে বরো বাগদিনী এই জঙ্গলে এসে লুকিয়ে ছিল নিজের ঘর ছেড়ে-এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে। কেউ বললে, ওর মাথা হঠাৎ খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কেউ বললে, ভূতে

পেয়েছিল। কিন্তু বরো বাগদিনী মরেছে অনাহারের শীর্ণতায় ও সম্ভবত আশ্বিন কার্তিক মাসের ম্যালেরিয়ায় ভুগে। কেউ একটু জলও দেয় নি তার মুখে।

কে-ই বা দেবে এ জঙ্গলে? জানতোই বা কে?

বরো বাগদিনীর এ আত্মগোপনের রহস্য তার সঙ্গেই পরপারে চলে গেল।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024