গত প্রায় আট দশকে এই উপমহাদেশের সব থেকে ভয়াবহ ঘটনা দেশভাগ। ভারত উপমহাদেশ ভাগ হয়ে ১৯৪৭ সালে দুটি দেশ হবার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সব থেকে বেশি নরহত্যা হয় এই দেশভাগের ঘটনার ভেতর দিয়ে।
সে নরহত্যা কোন যুদ্ধের নামে নয়, সে নরহত্যা কিছু রাজনীতিকের ক্ষমতায় যাবার কূট কৌশলের কারণে সাধারণ মানুষকে দিয়ে মানুষ হত্যা করা। তাও পরিচিত জন, প্রতিবেশী। শুধু নরহত্যা নয় এর সঙ্গে ঘটে নারীর শ্লীলতাহানী এবং নারী চালান। আরো ঘটে গত কয়েক শতকের ভেতর সব থেকে বেশি ফ্রোর্স মাইগ্রেশান।
সত্য অর্থে সাদাত হোসেন মান্টো ছাড়া ওইভাবে দেশ ভাগের যন্ত্রনা ভারতীয় অন্য কোন সাহিত্যিক তুলে আনতে পারেনি। অথচ সত্যি অর্থে ভারত উপমহাদেশের এই ঘটনাই কেবল বিংশ শতাব্দীতে একটি সার্থক মহাকাব্য’র প্লট।
যদিও বলা হয় ভারত ভাগ হয়েছে। একটু বাস্তবতায় দাড়িয়ে হিসেব করলে আসলে ভারত ভাগ হয়নি। ভাগ হয় মূলত বেঙ্গল আর পাঞ্জাব। বেঙ্গল ভাগের খেলাটা ধর্মের নামে ১৯০৫ সালেই শুরু হয়েছিলো। আজো এই খেলার অনেক সমর্থক পাওয়া। এই সব সমর্থকরা হ্যামিলনের বংশী বাদকের পেছনের সেই সেই অন্ধ অথবা মুগ্ধ ইঁদুরের মতো । তারা এখনও এর ভেতর নানান সম্প্রদায় বা ধর্মের মানুষের লাভ খোঁজে। কেউ এর আসল খেলাটা আজো বোঝেননি।
একমাত্র যিনি বুঝেছিলেন, তিনি নীরবে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ। ওই ঘটনায় রাজনীতিকদের কাছাকাছি এসে রাজনীতিকদের কূটিল ও নীচ রূপ পরিপূর্ণভাবে প্রত্যক্ষ ও উপলব্দি করেন রবীন্দ্রনাথ। এর পর থেকে তিনি রাজনীতিকদের মাঝে ভুলক্রমে যাওয়া বা জড়িয়ে পড়া দু একজন দেশপ্রেমিককে ভালোবেসেছেন কিন্তু রাজনীতি থেকে ছিলেন শতহাত দূরে। এমনকি তিনি মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী যে নিজের নামে আগে মহাত্মা লিখতেন এ নিয়েও তাঁকে সরাসরি বলতে দ্বিধা করেননি। তিনি তাঁর কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি কি আসলে মহাত্মা? কেন তিনি নিজেকে মহাত্মা বলে লেখেন। এই থেকে বোঝা যায় রাজনীতিকদের কীভাবে চিনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
যাহোক রবীন্দ্রনাথ দেশভাগের আগেই মারা যান। রবীন্দ্রনাথের পরে জীবন ও সত্য প্রকাশের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে আর যে বড় প্রতিভা জম্মান তিনি সত্যজিত রায়।
কোলকাতার নগর জীবন, উনবিংশ শতাব্দীর গ্রামীন জীবন, ব্রিটিশের আগমনে শেষ রাজ্যে’র পতন এমনকি রবীন্দ্রনাথের গল্পকে শত বছর পিছিয়ে নিয়ে – বাঙালি’র শুধু নয় আধুনিক ভারতের প্রথম উদার চিন্তক রামমোহনকেও তাঁর চলচ্চিত্রে নিয়ে এসেছেন।
এরপরেও আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করতে হয়, বাংলা ভাগ বা দেশভাগ নিয়ে সত্যজিতের কোন চলচ্চিত্র নেই। দেশভাগ নিয়ে সত্যি অর্থে ঋত্তিক ঘটক ও রাজেন তরফদারই মানুষের মর্মমূলকে নাড়া দেবার মতো কিছু চলচ্চিত্র করেছেন।
ঋত্তিক ঘটক ও রাজেন তরফদার দুজনই পূর্ববঙ্গের মানুষ। দেশভাগের স্থুল আনন্দের উম্মাদদের তাড়া খেয়ে তাঁদের দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিলো। তাই খুব যদি মোটা দাগে হিসেব করা যায় তাহলে বলতে হয়, এ দুজনকে ভিটে মাটি ছাড়তে হয়েছিলো বলে, উদ্বাস্তু হতে হয়েছিলো বলে তাদের বুকের যন্ত্রনাই তাদেরকে এই চলচ্চিত্র করার দিকে ঠেলে দিয়েছিলো।
কিন্তু প্রকৃত কবিকে কি মহাভারত লেখার জন্যে কুরুক্ষেত্রে থাকতে হয়। প্রত্যক্ষ করতে হয়। কবির মনোভূমিই কি রামের জম্মস্থান থেকে আরো বড় নয়। তাছাড়া কোলকাতাতে জম্ম হলেও সত্যজিত তো দেখেছেন সে সব দিশেহারা মানুষ ১৯৫০ ও ৬০ এর দশকে কোলকাতার এদো গলি আর বস্তি ছেয়ে গিয়েছিলো যারা। সেই দেশহারাদের তো তিনি দেখেছেন। নিরাপদ শান্ত বাড়ির আঙিনা ফেলে যারা আশ্রয় নিয়েছিলো দরমার ঘরে, ফুটপাতে বা রেল ষ্টেশনে। সেই কোলকাতার বাসে ট্রামে চড়ে বেড়ানো সত্যজিত রায় কেন একটিও ছায়াছবি তৈরি করলেন না দেশভাগ নিয়ে?
বাস্তবে ছায়াছবিকে যারা শুধু বিনোদনের বাইরে গিয়ে দেখেন, আর যেখানে বাংলা ফ্লিমকে সত্যজিত নিজেই সব থেকে বেশিভাবে নিয়ে গেছেন, তার এ নীরবতা শুধু প্রশ্ন নয়, গবেষণারও কি দাবী রাখে না?
– কালান্তর
Leave a Reply