সারাক্ষণ ডেস্ক
যখন রাত দীর্ঘ হয় এবং বাতাসে শীতের আমেজ ভরে ওঠে, তখন আমরা আবার সেই ভৌতিক মৌসুমে প্রবেশ করি, যেখানে শীতের দীর্ঘ রাতগুলিতে ভূতের গল্প শোনানো হয়। কিন্তু ভূত আসলে কী? মৃতদের আত্মা? অতীতের এমন কিছু ঘটনা, যা এতটাই ভয়াবহ যে বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটে? নাকি এগুলো শুধুই কল্পকাহিনি?
আপনার অবাক লাগতে পারে, তবে ভূতের দেখা প্রাচীনকাল থেকেই নথিভুক্ত হয়েছে। ভৌতিক ঘটনা বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভিন্ন রূপে বিদ্যমান। এই নিবন্ধে আমরা মূলত পশ্চিমা প্রেক্ষাপটে ভূতের ইতিহাসের ওপর আলোকপাত করব।
প্রাচীন ভূতের বাড়ি
প্রাচীন যুগে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে মৃতদের আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস ছিল। প্রাচীন রোমে একজন লেখক প্লিনি দ্য ইয়ংগার তার একটি চিঠিতে একটি ভূতের কাহিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এথেন্সে একটি বড় বাড়ি ছিল, যেটি খারাপ নামে পরিচিত ছিল। রাতে সেখানে লোহার শিকল ঝাঁকানোর শব্দ শোনা যেত এবং একটি বৃদ্ধ মানুষের প্রেতাত্মা তার বাসিন্দাদের আতঙ্কিত করে তুলত। একবার দার্শনিক আথেনডোরাস বাড়িটি ভাড়া নেন এবং ভূতের উপস্থিতি অনুসরণ করে সেই জায়গায় খনন করেন। সেখানে এক ব্যক্তির কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়, এবং সঠিকভাবে কবর দেওয়ার পর থেকে বাড়িটি আর ভুতুড়ে থাকে না। প্লিনির এই গল্প আধুনিক ভূতের কাহিনির অনেক বৈশিষ্ট্য বহন করে—একটি ভুতুড়ে বাড়ি, শিকল ঝাঁকানোর শব্দ এবং প্রেতাত্মাকে শান্ত করার জন্য কবর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা।
মধ্যযুগে ভূত
মধ্যযুগে ভূতদের আত্মা হিসেবে বিশ্বাস করা হতো, যারা দুই পৃথিবীর মাঝে আটকে ছিল এবং শান্তি পেতে প্রার্থনা বা অন্যান্য আত্মিক সহায়তার প্রয়োজন হতো। যদিও তাদের সবার উদ্দেশ্য শান্তিপূর্ণ ছিল না, তবুও সেই যুগে রেভেনান্ট নামক কিছু আত্মা মৃতদেহে প্রবেশ করে পুনরায় জীবিত হতো। তাদের সম্পর্কে বলা হয়, তারা জীবিতের মতো আচরণ করত, কথা বলত, আবেগ প্রকাশ করত এবং কখনো কখনো গানও গাইত। কিন্তু অনেকেই মনে করত, তারা ছিল পাপাত্মা যারা জীবনে খারাপ কাজ করায় আবার ফিরে এসেছে।
এলিজাবেথীয় যুগের ভূত
এলিজাবেথীয় যুগে অতিপ্রাকৃতের প্রতি বিশ্বাস প্রবল ছিল। এই সময়ে স্যার জন ডি অতিপ্রাকৃতের প্রতি আগ্রহী হয়ে আত্মাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। উইলিয়াম শেকসপিয়ারের নাটকগুলোতে ভূতের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়, যেমন ম্যাকবেথ ও হ্যামলেট। ম্যাকবেথে ব্যাঙ্কো ভূতেরূপে ফিরে আসে, আর হ্যামলেটে যুবরাজ হ্যামলেট তার পিতার আত্মার কাছ থেকে প্রতারণার কথা জানতে পারে।
এজহিলের ভূত
১৭শ শতাব্দীতে ব্রিটেনের বিখ্যাত ভৌতিক ঘটনা এজহিলের যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটে, যেখানে মৃত সৈনিকদের আত্মা যুদ্ধরত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল। ১৬৪২ সালের অক্টোবরে এজহিলের যুদ্ধে প্রায় এক হাজার সৈন্য নিহত হয়। কিছুদিন পর স্থানীয় রাখালরা রাতে তাদের আর্তনাদ শুনতে পায় এবং আকাশে মৃত সৈন্যদের যুদ্ধরত দেখতে পায়। এই ঘটনাটি এতটাই বিখ্যাত হয়েছিল যে চার্লস প্রথম এটিকে তদন্তের জন্য একটি রাজকীয় কমিশন পাঠান।
ভিক্টোরিয়ান স্পিরিচুয়ালিজম
ভিক্টোরিয়ান যুগে অতিপ্রাকৃতের প্রতি বিশ্বাস নতুন মাত্রা পায় স্পিরিচুয়ালিজমের উত্থানের মাধ্যমে। ১৮৪৮ সালে ফক্স বোনরা একটি অদৃশ্য শক্তির সাথে যোগাযোগের দাবি করে, যা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই যুগে, অনেকেই ভূতদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এবং স্পিরিট ফটোগ্রাফি জনপ্রিয়তা পায়।
মানবতার ছায়া
আপনার বিশ্বাস অনুযায়ী, ভূতের কাহিনিগুলোর দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তা হয়তো আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ দেয় বা মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার মানবজাতির সক্ষমতার প্রতিফলন। ভূত আমাদের জীবনের এক অন্তর্নিহিত ছায়া, যা প্রতিটি যুগের চিন্তা ও আবেগকে প্রতিফলিত করে।
Leave a Reply