শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৩ পূর্বাহ্ন

প্লাস্টিক ব্যবহারের অভ্যাস এখন নেশায় পরিণত হয়েছে প্লাস্টিক

  • Update Time : সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৪, ১১.৪৬ পিএম

সারাক্ষণ ডেস্ক 

প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে একদিকে যেমন আইনের প্রয়োগ জরুরি, অন্যদিকে নিজেদেরকে সচেতন করে তোলাটাও গুরুত্বপূর্ণ। প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে বিকল্প গড়ে উঠবে এবং বেসরকারি খাত সেই বিকল্প পণ্য ব্যবহারে বাধ্য হবে। প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে ২০০২ সালে যে আইন প্রণয়ন হয়েছিল, গত ২২ বছরে তার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত হয়নি। সরকার সেই কাজে হাত দিয়েছে কিন্তু নানাবিধ কারণে সমাজে প্লাস্টিক ব্যবহারের অভ্যাসটি এখন নেশায় পরিণত হয়েছে।

‘ওয়ার্ল্ড সিটিস ডে’ উপলক্ষ্যে ব্র্যাক আয়োজিত “প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস, জাতীয় নীতি ও টেকসই পদক্ষেপ” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেছেন। সোমবার, ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, “আজ আমরা যে প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে ফেলে দিচ্ছি, সেটি আগামী ৪০০ বছরেও ধ্বংস হবে না। ২২ বছর আগে প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এতোদিন পর এসে যখন বলা হয় বিকল্প নেই, সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে সরকার সব রকমের সহায়তা দেবে কিন্তু সাজিয়ে-গুছিয়ে বিকল্প তৈরি করে দেবে না। আমরা সকলেই আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষক।

প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে আমরা সকলের প্রতি আহ্বান জানাই।”

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ বলেন, “সস্তা হওয়ায় প্লাস্টিকপণ্য অনেক বেশি পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে। কেনাকাটার সময় সচেতনতার অভাবে অনেকে সস্তা ব্যাগ হিসেবে প্লাস্টিককেই প্রাধান্য দেয়। পরিবেশ সচেতন হতে হলে যে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে, সেটি তারা করতে চান না। এ ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বিরূপ প্রভাব বিষয়ে গণসচেতনতা সেভাবে তৈরি হয়নি।”

তিনি আরও বলেন, “প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধে শুধু বিকল্প পণ্যই যথেষ্ট নয়, সেই বিকল্পটি হতে হবে ব্যয় সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য যেন এটি ব্যবহারের ফলে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বেড়ে না যায়। মূল্য বেশি হলে মানুষ সেটি গ্রহণ করবে না। ফলে এ জায়গাতে আরও বেশি উদ্ভাবনী হতে হবে এবং প্রয়োজনে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে।”

অনুষ্ঠান মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ব্র্যাকের ক্লাইমেট চেঞ্জ, আরবান ডেভেলপমেন্ট ও ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট-এর পরিচালক ড. মোঃ লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, “টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে আমাদের লক্ষ্য হল ২০২৫ সালের মধ্যে পাঞ্চাশভাগ পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা অর্জন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য উত্পাদন ৩০ শতাংশ হ্রাস করা। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, ক্রেতা-ভোক্তাদের আচরণ এবং সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাই এ দেশে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্যের মূল কারণ। এই প্লাস্টিক সংকট মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি খাত, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি।”

ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেসের ঊর্ধ্বতন পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, “হার্ড প্লাস্টিক বা শক্ত প্লাস্টিক প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই পুন:ব্যবহার হয় কারণ এর একটা বাজারমূল্য রয়েছে। অন্যদিকে নরম প্লাস্টিক বা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের পুন: ব্যবহারের বাণিজ্যিক মূল্য নেই বলে পথে-ঘাটে সবখানে এটি পরে থাকতে দেখা যায়। তাইওয়ানের মতো দেশে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে।”

নেসলে বাংলাদেশ-এর কোম্পানি সেক্রেটারি এবং হেড অফ লিগ্যাল অ্যান্ড ট্যাক্সেশন, দেবব্রত রায় চৌধুরী বলেন, “২০৩০ সালের মধ্যে নেসলের শতভাগ পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্যাকেজিং এর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ৩০ শতাংশ আনুষ্ঠানিক খাত থেকে আসে এবং বাকিটা অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে উৎপন্ন হয়।”

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)-এর ইকোলজিস্ট অ্যান্ড সোশ্যাল জাস্টিজ অ্যাডভোকেট ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশই বিশ্বে প্রথম প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করে কিন্তু আমরা এখনও তা কার্যকর করতে পারিনি। ২২ বছরেও আইনের প্রয়োগ না হওয়ায় প্লাস্টিকের বিকল্প গড়ে উঠেনি। আমরা প্লাস্টিকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছি। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই প্লাস্টিকের বিকল্প গড়ে উঠবে।”

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও স্যানিটেশন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ড. তারিক বিন ইউসুফ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেইনিং নেটওয়ার্ক সেন্টার (আইটিএন)-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ। বাংলাদেশ সাসটেইনেবিলিটি অ্যালায়েন্স ( বিএসএ) সেক্রেটারিয়েটের প্রধান সমন্বয়ক সংকলিতা সোমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন ব্র্যাকের আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউডিপি) কর্মসূচি প্রধান ইমামুল আজম শাহী। কক্সবাজার পৌরসভার কনজারভেন্সি ইন্সপেক্টর কবির হোসেন ও সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অফিসার শামীম আক্তার, বিডি ক্লিন-এর পক্ষ থেকে তামিম হোসেন এবং আমরা নতুন নেটওয়ার্ক (খুলনা)-এর কো-ফ্যাসিলিটেটর আরলিন করিম মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন। অনুষ্ঠানে প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এনগ্রিন, পিসেস এবং প্রোপ্যাড-এর পক্ষ থেকে পরিবেশবান্ধব নানা পণ্য প্রদর্শন করা হয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বছরে ৮ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয় (বিশ্বব্যাংক, ২০২১) যার মধ্যে ৮৭ হাজার টন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক (ইএসডিও, ২০২১)। শুধু কক্সবাজারেই প্রতিদিন সাড়ে ৩৪ টন প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্র ফেলা হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে, সাগরে মাছের চেয়ে বেশি প্লাস্টিক থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে (দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ২০১৬)। প্লাস্টিকের কণা ইতিমধ্যেই মায়ের দুধে (দ্য গার্ডিয়ান), সামুদ্রিক প্রাণী (এফএও, ২০১৭) এমনকি মেঘের মধ্যেও সনাক্ত করা হয়েছে (সায়েন্স ডেইলি, ২০২৩)।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024