একুশ বছর বয়সে, নোয়াহ সুলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। তিনি লম্বা, চিকন এবং আমেরিকান ধাঁচে ইংরেজি বলেন। তিনি বলছেন, বাল্যকালে তিনি কিছু দিন নিউ ইয়র্কে কাটিয়েছেন। তিনি এখন সিরিয়াতে বন্দী।
সুলের বয়স যখন ১২, তার বাবা তাকে এবং তার মাকে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবেগো থেকে এখানে নিয়ে আসে, ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠীতে যোগ দেয়ার জন্য। তাদের ক্ষমতা যখন তুঙ্গে, তখন এই জঙ্গি গোষ্ঠী সিরিয়া এবং ইরাকে যে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো তা ছিল যুক্তরাজ্যের সমান।
আইএস-এর জমি দখল এবং বিশ্বের উপর তারা যে ত্রাসের রাজত্ব চাপিয়ে দিয়েছিল, তা এখন ইতিহাসের এক উদ্ভট চ্যাপ্টারে ম্লান হয়ে গেছে। কিন্তু কয়েক ডজন দেশ থেকে আসা তাদের হাজার হাজার প্রাক্তন সদস্য উত্তরপূর্ব সিরিয়ায় বন্দী অবস্থায় রয়ে গেছে।
তাদের ৩০,০০০ শিশু সন্তানও তাদের সাথে কারাবন্দী, যাদের অনেকে কখনও একদিনের জন্যও মুক্ত জীবন উপভোগ করেনি।
“কোন কোন সময় আমার মনে হয় যেন, কোন আশা-ভরসা নেই,” বলেন সুলে। “আমরা কোন কারণ ছাড়াই বেঁচে আছি। আমার জীবনের কোন অর্থ নেই।”
সুলে ১৬ বছর বয়সে আটক হয়, যখন সে দৃশ্যত অভিজ্ঞ বিদেশি জঙ্গিদের সাথে একটি একে-৪৭ রাইফেল হাতে ধরা পড়ে। সে সময় থেকে তিনি বন্দী।
প্রথম দিকে, কুর্দিশ আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ তাকে প্রাপ্তবয়স্কদের কারাগারে রাখে। কিন্তু কিছুদিন পর তাকে স্থানান্তর করা হয় আল-হুরি পুনর্বাসন কেন্দ্রে, যেখানে আইএস পরিবারের ছেলেদের রাখা হয়, যাদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধের অভিযোগ নেই।
আল-হুরির চারপাশে উঁচু কংক্রিট দেয়াল, যার উপরে কাটা-তাঁরের বেড়া এবং সশস্ত্র পাহারাদার। এর ভেতরে একটি স্কুলও আছে যেখানে বিজ্ঞান, সঙ্গীত, ইংরেজি এবং আরবি পড়ানো হয়।
পুনর্বাসন কেন্দ্র এই অঞ্চলের প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কারাগারের চেয়ে ভাল। কারাগারে মানুষ ছোট, নোংরা রুমে ঠাসা-ঠাসি করে থাকে, যেখানে বিশুদ্ধ বাতাস নেই, পরিষ্কার বাথরুম নেই, পর্যাপ্ত খাবার বা ওষুধ নেই। কিন্তু এই কেন্দ্রও একটা বন্দীশালা।
“আমরা যদি তাদের প্রাপ্তবয়স্কদের কারাগারে রাখি, তাহলে তারা জঙ্গি হয়ে যাবে,” নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন একজন ক্যাম্প ম্যানেজার। দু’বছর আগে আল-হুরি ক্যাম্পের এক ম্যানেজারকে যারা হত্যা করেছিল, তাদের ভয়ে তিনি নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
“আমাদের জন্য এটা বড় সমস্যা,” তিনি জানান।
তবে আল-হুরিতে প্রায়ই তার ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক আসে, এবং তখন অনেক ছেলেকে ১৮ বছর হওয়া মাত্রই প্রাপ্তবয়স্কদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তখন ঝুঁকি বা অবিচারের প্রশ্ন বিবেচনা করা হয় না।
তবে বিদেশীদের অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে রাখা হয়।
উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার আল-হল ক্যাম্পে তিনজন ইরাকি নারী। ফটোঃ ১২ অক্টোবর, ২০২৪
বর্তমানে যিনি ক্যাম্প ম্যানেজার আছেন, এবং অন্যান্যরা যারা এই দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা স্বীকার করেন যে, যেসব শিশুর বিরুদ্ধে কখনো অপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি, তাদের বন্দী করে রাখা অন্যায়।
তবে তারা মনে করেন, যেসব দেশ থেকে এই ছেলেরা এসেছে, তাদের উচিত ছেলেদের নিয়ে যাওয়া। ক্যাম্প ম্যানেজাররা জানেন না, এদের নিয়ে তারা কী করতে পারেন।
ছেলেরা বলছে, তারা গভীরভাবে বিষণ্ণ এবং নিঃসঙ্গ। তারা কখনোই আইএস-এর সাথে জড়িয়ে পড়তে চায়নি।
“আমি জানিনা আমার কী হচ্ছে,” সুলে বলেন। “আমি শুধু প্রতি সকালে ঘুম থেকে উঠি এই আশায় যে, কোন এক দিন, কেউ এসে আমাকে বলবেঃ এখন বাড়ি যাওয়ার সময়।”
আল-হুরি পুনর্বাসন কেন্দ্রে আরও অল্প বয়সের ছেলেদের যখন আইএস এর কাছে নিয়ে আসা হয়, তখন তারা বাচ্চা ছিল। এদের অনেকের আইএস-এর আগে কোন স্মৃতি নেই।
আইএস যখন ২০১৯ সালে ভেঙ্গে পড়ে, তখন অন্তত ৭০,০০০ মানুষ সিরিয়ার বাগহুজে শেষ, রক্তক্ষয়ী লড়াই থেকে পালিয়েছিল, যাদের মধ্যে ৩০,০০০ শিশু ছিল।
আমার মনে আছে সামরিক ট্রাক থেকে বাচ্চাদের নামতে দেখছিলাম, যে ট্রাকগুলো তাদের এমন এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিয়ে এসেছে যাকে যুদ্ধ-অভিজ্ঞ জঙ্গিরা আমাদের কাছে “বিশ্বের বুকে নড়ক” বলে বর্ণনা করতো।
একজন ছেলে ঘোরের মধ্যে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলে যে তার বাবা “উপস্থিত” ছিলেন। যখন জিজ্ঞেস করা হয় তার বাবা কি এই ময়দানে উপস্থিত নাকি এই পৃথিবীতে উপস্থিত, ছেলেটি তখন শুধু তাকিয়ে থাকে।
আল-হুরি পুনর্বাসন কেন্দ্রে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবেগো থেকে আসা এক তরুণ। তার বাবা ২০১৪ সালে তাকে সিরিয়ায় নিয়ে আসে। ফটোঃ ৯ অক্টোবর, ২০২৪।
শিশুদের এবং তাদের মা’দের জড়ো করে ট্রাকে তুলে ক্যাম্পে আনা হয়। পুরুষদের লাইন ধরে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
তার পরের বছরগুলোতে, বিদেশী নারী ও শিশুদের মধ্যে অনেককে তাদের দেশ ফেরত নিয়েছে, এবং অনেক সিরিয় পরিবার তাদের বাসায় চলে গেছে। কিন্তু তাদের বেশির ভাগ এখনো আল-হুরি এবং আল-রোজ ক্যাম্পে আছে, যেখানে তাঁবুগুলো শীতকালে ঠাণ্ডা, ভেজা এবং কর্দমাক্ত এবং গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম।
কোন কোন সময় ত্রাণ কর্মীরা বাচ্চাদের জন্য স্কুল পরিচালনা করে। কিন্তু মাঝে মধ্যে ঐ স্কুলগুলো ক্যাম্পের নারীরা জ্বালিয়ে দেয়, কারণ তারা স্কুলের পাঠ্যক্রমের বিরোধিতা করে।
“আমরা কোন ধর্মহীন স্কুলে যাবোনা,” তাজিকিস্তান থেকে আসা ১১-বছর বয়স্ক মোহাম্মাদ ২০২০ সালে আমাদের আল-হল ক্যাম্পে বলেছিল। সে পরে স্বীকার করে যে, সে গণিত এবং ইংরেজি শেখার জন্য স্কুলে যেতে ইচ্ছুক। কিন্তু সে চায়না যে কেউ তাকে চালাকি করে নাস্তিক বানিয়ে দিক।
নিরাপত্তা রক্ষীরা ক্যাম্পকে একটি “টাইম বোমা” হিসেবে বর্ণনা করে বলে বোমার ঘড়ি টিক-টিক করছে। কারণ, ক্যাম্পের অনেক বাসিন্দা এখনো আইএস-এর আদর্শ ধারণ করে। তাদের মতে, যাদের তারা “বিধর্মী” মনে করে তাদের হত্যা করা উচিত। গত পাঁচ বছরে অন্তত ১৩০ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
জঙ্গি হওয়ার ভয়
আমি আমার ক্যামেরা বের করতেই মোহাম্মাদ আমাদের অনুবাদক হালান আকইয়ের পেছনে লুকায়। পরে মোহাম্মাদ বলে যে, তার বয়স, ১১, এখন জেলে নিয়ে যাবার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সে চায়না যে কারাগারের পরিচালকরা তার ছবি দেখুক এবং তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসুক।
“তারা আমাদের বাচ্চাদের জেলে নিয়ে যাচ্ছে কেন?” চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন আসমা, একজন মা যিনি কাছের এক বাজারে কেনা-কাটা করছিলেন। উজবেকিস্তান থেকে আসা নারী কথা-বার্তা শুনে ফেলেছে। “তারা কী করেছে?”
স্থানীয় কর্মকর্তাদের যখন জিজ্ঞেস করা হয় তারা কেন এত অল্প বয়সী, এমনকি ১২ বছর বয়সী ছেলেদের তাদের পরিবারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়, জবাবে তারা খোলা-মেলা উত্তর দেয়। কর্মকর্তাদের মতে, বাইরের সাহায্য ছাড়া তাদের সামনে আর কোন উপায় নেই। অন্যথায়, তারা বলে, এই ছেলেরা জঙ্গিতে পরিণত হবে।
আমরা মোহাম্মাদকে জিজ্ঞেস করি, এখানকার বাচ্চারা কি বড় হয়ে আইএস-এর যোদ্ধা হতে চায়।
“কিছু বাচ্চা তা হতে চায় না,” সে বললো। “কিন্তু আমাদের ৯৯ শতাংশ সেটাই চায়।”
ছেলেদের তাদের মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া থামানোর কোন পরিকল্পনা নেই, এবং ক্যাম্প রক্ষীরা বলছে আটক ব্যবস্থার আরও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। মেয়েদের ক্যাম্পেই রেখা দেয়া হচ্ছে, তাদের পুরো জীবনও ঝুঁকি আর অবক্ষয়ের মধ্যে কাটবে।
অ্যামনেসটির উদ্বেগ
অ্যামনেসটি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, মায়ের কাছ থেকে বাচ্চাকে সরিয়ে নেয়া বেআইনি এবং ক্যাম্প আর কারাগারে পরিবেশ অমানবিক ও ভয়ঙ্কর। এখানে বেশিরভাগ নারী ও পুরুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়নি বা আদালতে বিচারও হয়নি।
অ্যামনেসটি ইন্টারন্যাশনাল স্থানীয় কুর্দিশ কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করে – উত্তর এবং পূর্ব সিরিয়া অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসিত কর্তৃপক্ষ, যেটায় আছে বেসামরিক নেতৃত্ব, সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সামরিক গ্রুপ। তারা যুক্তরাষ্ট্রকেও দোষারোপ করে, যারা এসডিএফ-কে সমর্থন করে।
“যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এই ব্যবস্থা নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে মূল ভূমিকা পালন করেছে,” এ’বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত অ্যামনেসটির এক রিপোর্টে বলা হয়।
কুর্দিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনলে তারা অপমানবোধ করেন। তারা আইএস বন্দীদের সাথে অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে অনেকবার প্রতিবাদ করেছে। তারা বলেছে এই আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে তাদের আন্তর্জাতিক সাহায্য দরকার।
সিরিয়ায় আইএসকে পরাজিত করার জন্য এক ডজন রাষ্ট্র কৃতিত্ব দাবী করে, কিন্তু ফেলে রাখা সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব একা কুর্দিদের উপর পড়েছে। এখানে ৭০ এর বেশি দেশ থেকে আসা বন্দী আছে। কিছু বন্দী নিজ দেশে ফিরে গেলেও, বেশির ভাগ সিরিয়াতেই রয়ে গেছে।
ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা
Leave a Reply