বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
মানভূমের টাড় ও জঙ্গল জায়গা। একটু দূরে বড় পাহাড়শ্রেণী, অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বসন্তকালের শেষ, পলাশ ফুল বনে আগুন লাগিয়ে দিয়েচে, নাকটিটাড়েয় উঁচু ডাঙা জমি থেকে যতদূর দেখা যায়, শুধু রক্তপলাশের বন দূরে নীল শৈলমালার কোল ছুঁয়েচে।
জঙ্গল দেখতে এসেচি এদিকে, কাছেই রাস্তার ধারে পলাশবনের প্রান্তে ডাকবাংলোতে থাকি, জঙ্গলের কাঠে কেমন আয় হবে তাই দেখে বেড়াই। একদিন সন্ধ্যের আগে নাকটিটাড়ের বন দেখে ফিরচি, পথের ধারে একটা হরিতকী গাছের তলায় একটি লোক ও একটি ছোট মেয়ে বসে পুটুলি খুলে কি খাচ্ছে। জনহীন পথিপার্শ্ব, কেউ কোনদিকে নেই-সন্ধ্যেরও আর অল্পই বিলম্ব, সামনে বাঘমুণ্ডীর বনময় পথ, এমন সময়ে লোকটা কি করে জানবার আগ্রহে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। লোকটার চেহারা দেখে বয়স অনুমান করা শক্ত। মাথার চুল কিছু পাকা, কিছু কাঁচা। পুঁটুলির মধ্যে খানদুই ছেঁড়া নেকড়া, একখানা কাঁথা আর কিছু মকাই-সের দুই হবে, একটা খালি চায়ের কিংবা বিস্কুটের টিন। বোধ হয় সেটাই তৈজসপত্রের অভাব পূর্ণ করচে সব দিক দিয়ে। সঙ্গের মেয়েটির বয়েস চার কি পাঁচ। পরনে ছোট্ট একটু ময়লা নেকড়া মেয়েটার, কোমরে ঘুন্সি। আমি বললাম, “কোথায় যাবে হে, বাড়ি কোথায়?”
লোকটি মানভূমি বাংলায় বললে, “তোড়াং হে-টুকু আগুন আছে?”
” দেশলাই? আছে, দিচ্ছি। তোড়াং কতদূর এখান থেকে?”
টুকু দূর আছে বটে। পাঁচ কোশ হবেক।”
কোথা থেকে আসা হচ্ছে এমন সন্ধ্যেবেলা?”
“হেই সেই পুরুলিয়া থিকে। আগুন দাও বাবু। শোরিল এক্কেবারে কাবু হয়ে গিয়েছে। হেই মেয়েটার মা মরে গেল ওর দু’বছর বয়সে। ওকে রেখে জঙ্গলে কাঠের নাম করতে যাইতে পারি নাই-তাই পুরুলিয়া গেইছিলি। ভিক্ষা মাঙি দু’বছর রইয়েছিলি।”
লোকটির কথাবার্তার ধরন আমাকে আকৃষ্ট করলে। ডাক-বাংলোতে সন্ধ্যার সময়ে ফিরেই বা কি হবে এখন? সেখানেও সঙ্গিহীন ঘর-দোর। তার চেয়ে একটু গল্প করা যাক এর সঙ্গে। শছে একটা বড় পাথর পড়েছিল, সেটার ওপর বসে ওকে একটা বিড়ি দিলাম। নিজেও একটা ধরালাম। লোকটার বাড়ি নাকি পাঁচ-ছ’ ক্রোশ দূরবর্তী একটি ক্ষুদ্র বন্য গ্রামে, বাঘমুণ্ডী ও ঝালদা শৈলমালা ও অরণ্যের মধ্যবর্তী কোন নিভৃত ছায়াগহন উপত্যকাভূমিতে, পলাশ, মহুয়া, বট, কেঁদ গাছের তলায়। ওর আর দুটি সন্তান হয়ে মারা যাওয়ার পরে এই মেয়েটি হয় এবং মেয়েটির বয়স যখন দু’বছর, তখন ওর মাও হল মৃত্যুপথযাত্রী। লোকটা জঙ্গলের কাঠ ভেঙে এনে চন্দনকিয়ারীর হাটে বিক্রি করতো এদেশের অনেক গ্রাম্যলোকের মতো। কিন্তু ঘরে কেউ নেই দু’ছরের মেয়েকে দেখবার, তাকে সঙ্গে নিয়ে উচ্চ পাহাড়ে উঠে রৌদ্র ও বর্ষায় কি করে কাঠ ভাঙে? তাই ঘরে আগড় বন্ধ করে ও চলে গিয়েছিস অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় পুরুলিয়া শহরে।
আমি বললাম, “কাঠের কাজে আয় হত কেমন?”
লোকটা বিড়িতে টান দিয়ে বললে, “বোঝা পিছু তিন আনা, চার আনা। জঙ্গলে ছাড় লিত দু’পয়সা। চাল বস্তা ছিলি। হইয়ে যেতো পেটের ভাত দু’জনার। তারপর বাবু মেয়্যাটা হোলেক্, ওর মা মর্যা গেলেক্। তখন কচি মেয়্যাটারে ফেলে জঙ্গলে যেতে মন নাই সরলেক্। বলি যাই পুরুলিয়া, ভারি শহর, পেটের ভাত দু’জনার হইয়ে যাবেক।”
পুরুলিয়া বড় জায়গা?” ” “ওঃ বাবু, ইধার থিকে উধার যাওয়ার কূল-কিনারা দু’বছরে নাই পাইলেক্। ভারি শহর বাবু..” আমি ওকে আর একটা বিড়ি দিলাম। গল্প জমে উঠেচে। বললাম, “তারপর..?”
তারপর পুরুলিয়া শহরে কিভাবে গেল, তার গল্প করলে। ওদের পাশের গাঁয়ের একজন লোক পুরুলিয়া শহরে কি একটা কাজ করে, তার ঠিকানা খুঁজে বার করতে দিন কেটে গেল। সন্ধ্যা হয়েছে, তখন এক বড়লোকের বাড়ির ফটকে মেয়ের হাত ধরে ভিক্ষে করতে দাঁড়ালো। তারা দুটি পয়সা দিলে, দু’পয়সার ছোলা কিনে বাপ-মেয়েতে রাত কাটিয়ে দিলে গাছতলায় শুয়ে। পুলিশে আবার শুঁতে দেয় না; অর্ধেক রাত্রে এসে লণ্ঠনের আলো ফেলে বলে, “হিয়াসে হঠ যাও।” তার পরদিন আলাপী লোকের সন্ধান মিললো। গিয়ে দেখে দেশে সে লোকটা যত বড়াই করে, আসলে সে তত বড় নয়। সামান্য একটা দু-কামরা ঘরে সে আর তার স্ত্রী থাকে-তামাক মেখে বিক্রি করে মাথায় নিয়ে, কখনও জলের কুঁজো পাইকেরি দরে কিনে ফিরি করে খুচরো বেচে-এই সব উচ্ছৃবৃত্তি। অথচ দেশে বলেছিল সে বড় সাহেবের আরদালি।
যাহোক, অনেক বলা-কওয়াতে সে জায়গা একটু দিলে ঘরের বাইরের দাওয়ার একপাশে শুয়ে থাকতে হবে, তবে নিজের এনে খাওয়া-দাওয়া, তার ভার সে নেবে না। বছর দুই সেখানেই থেকে চলেছিল যা হয় একরকম তারপর এই অকাল পড়লো, চালের দাম চড়লো-শহরে চালের দাম হল আঠারো টাকা। ভিক্ষে আর তেমন লোক দিতে চাঁয় না-তাও হয়তো চলতো যা হয় করে, কিন্তু যাদের বাড়িতে থাকা তারা গোলমাল করতে লাগলো। তারা আর জায়গা দিতে চায় না, বলে, “আমাদের লোক আসবে, বাড়ি ছেড়ে দাও।” রোজ গোলমাল করে, তাই আজ তিন দিন শহর থেকে বেরিয়ে জন্মভূমি তোড়াং গ্রামে চলেচে।
ছোট মেয়েটা এতক্ষণ খালি বিস্কুটের টিন হাতে করে বাজাচ্ছিল।
ওর দিকে সস্নেহদৃষ্টিতে চেয়ে লোকটা বললে, “এর নাম রেখেছে থুপী।” আমি বাপের মনে আনন্দ দেবার জন্যে বললাম, “থুপী? বেশ নাম।”
বাপ সগর্বে বললে, “হাঁ, খুপী?” তারপর আমায় বললে, “বাবু, তামাক কিনবার পয়স দিবেন দুটি?”
আমি পয়সা সামান্যই নিয়ে বেড়াতে বার হয়েচি, জঙ্গলের পথে পয়সা কি করবো। ওকে দুটি মাত্র পয়সা দিতে পারলাম। থুপী কি একটা বললে ওর বাবাকে, বাবা তাকে কাঁধে নিয়ে চললো। আমি চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম-
রাস্তা যেখানে উঁচু হয়ে ওদিকের সব দৃশ্য ঢেকে দিয়েচে, সেখানে ওর পাঁচ বছরের মেয়েটিকে কাঁধে নিয়ে পুঁটলি বগলে ও চলেচে-সেদিকেই অন্তদিগন্ত ও সূর্যাস্ত, রঙীন আকাশের পটে ওর মূর্তি দেখাচ্ছে ছবির মতো, কারণ আগেই বলেছি রাস্তা উঁচু হওয়ার দরুন সেখানে আর কিছু দেখা যায় না, রাস্তাই সেখানে চক্রবালরেখার সৃষ্টি করেচে।
মনে মনে ভাবলাম, ওর কোথাও অন্ন নেই, গৃহ নেই-পাঁচ বছরের মেয়েকে কত স্নেহে কাঁধে তুলে ও যে চললো গ্রামের দিকে, সেখানে অন্ন কি জুটবে এ দুর্দিনে যদি পুরুলিয়া শহরে না জুটে থাকে? কোন্ বৃথা আশার আকর্ষণ ওকে নিয়ে চলেচে গ্রামের মুখে? তার পরেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এ হল গত মাসের কথা। তখনও চাল ছিল ষোল টাকা আঠারো টাকা মণ, ক্রমে তাই দাঁড়ালো বত্রিশ টাকা, চল্লিশ টাকা। এই সময় একবার কার্য উপলক্ষে বিহার থেকে আমায় যেতে হল বাংলাদেশে, পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা জেলায়। মানুষের এমন কষ্ট কখনও চোখে দেখি নি-চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত হবে।
যে আত্মীয়ের বাড়ি ছিলাম তাদের বাড়িতে সন্ধ্যা থেকে কত রাত পর্যন্ত শীর্ণ, বুভুক্ষু, কঙ্কালসার বালকবালিকা, বৃদ্ধ, প্রৌঢ় কালো হাঁড়ি উঁচু করে তুলে দেখিয়ে বলচে,-“একটু ফেন দিন মা, একটু ফেন।” অনাহারে মৃত্যুর কত মর্মন্তুদ কাহিনী শুনে এলাম সারা পথ কুমিল্লা থেকে বেরিয়ে পর্যন্ত স্টীমারে, ট্রেনে।
বিহারে এসে দেখি এখানেও তাই। বহেরাগোড়া স্কুলের বোর্ডিঙে ড্রেন দিয়ে যে ভাতের ফেন গড়িয়ে পড়ে তাই ধরে খাবার জন্যে একপাল বুভুক্ষু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে হাঁড়ি হাতে দুবেলা বসে থাকে-তারই জন্যে কি কাড়াকাড়ি!
হেডমাস্টার বললেন, “এই গ্রামের ডোম আর কাহারদের ছেলেমেয়ে এখানেই পড়ে আছে ভাতের ফেনের জন্যে সকাল থেকে এসে জোটে আর সারাদিন থাকে, রাত ন’টা পর্যন্ত। সামান্য দুটো ভাতের জন্যে কুকুরের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে।”
পুরুলিয়া থেকে আদ্রা যাচ্ছি, প্ল্যাটফর্মের খাবারের দোকানে খাবার খেয়ে পাতা ফেলে দিয়েচে লোকে তাই চেটে চেটে খাচ্ছে উলঙ্গ, কঙ্কালসার ছোট ছোট ছেলেরা-অথচ সে পাতায় কিছুই নেই। কি চাটছে তারাই জানে।
এই অবস্থার মধ্যে ভাদ্রমাসের শেষে আমি এলাম এমন একটা জায়গায়, যেখানে অনেক লোক খাটচে একজন বড় কন্ট্রাক্টারের অধীনে ডিনামাইট দিয়ে পাথর ফাটানো কাজে। জঙ্গলের মধ্যে পাথর ফাটিয়ে এরা টাটায় চালান দিচ্ছে, স্থানীয় জমিদারের কাছে থেকে নতুন ইজারা নেওয়া পাথর খাদান।
একদিন সেখানকার ছোট্ট ডাক্তারখানাটার সামনে ভিড় দেখে এগিয়ে গেলাম।
ডাক্তারখানাটার সংকীর্ণ বারান্দাতে একজন কুলি শুয়ে আছে। পিঠে ব্যান্ডেজ বাঁধা-ব্যান্ডেজ ভিজে রক্ত দরদরিয়ে পড়ে সিমেন্টের রোয়াক ভিজিয়ে দিয়েচে। জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েচে?”
ডাক্তারবাবু বললেন, “এমন মাঝে মাঝে এক আধটা হচ্ছেই। ব্লাস্টিং করতে গিয়ে পাথর ছুটে লেগে মেরুদণ্ড একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েচে। সেলাই করে দিয়েচি, এখন টাটানগর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স আসচে।” ভিড় একটু সরিয়ে কাছে গিয়ে দেখি একটা পাঁচ-ছ’ বছরের মেয়ে ওর কাছে একটু দূরে বসে-কিন্তু সে কাঁদেও না, কিছুই না-নির্বিকার ভাবে বসে একটা খড় তুলে মুখে দিয়ে চিবুচ্ছে।
আমি তাকে দেখেই চিনলাম–আটমাস পূর্বে মানভূমের বন্য অঞ্চলে দৃষ্ট সেই ক্ষুদ্র। বালিকা থুপী।
“এর আহত কুলির মুখ ভাল করে দেখে চিনলাম-এ সেই থুপীর বাবা, যে সগর্বে বলেছিল, নাম রেখেচি থুপী।”
আশপাশের দু একজনকে জিগ্যেস করলাম, “এ কোথা থেকে এসেছিল জানো?” একজন বললে, “মানভূম জিলা থেকে আজ্ঞে।”
“কি গাঁ?”
“তোড়াং।”
“ওর কোনো আপনার লোক এখানে নেই।”
“কে থাকবেক্ আজ্ঞে ওর ওই বিটি ছানাটা আছে। কত কত ধুর থিক্যা এখেনে কাজ করতে এসেচে, চাল দেয় সেই জন্যে আজ্ঞে।”
“কোম্পানি কত করে চাল দেয়?”
সুতরাং থুপীর বাপের ইতিহাস আমি অনেকটা অনুমান করে নিলাম। গ্রামে গিয়ে দেখলে বাড়ি ভেঙে চুরে গিয়েচে, চাল মেলে না, মিললেও ওর সামর্থ্যের বাইরের জিনিস তা “হপ্তায় পাঁচ সের মাথাপিছু।”
কেনা। মকাই ও বিরি কলাই, তারপরে বুনো কচু ও ভূঁই-কুমড়োর মূল খেয়ে যতদিন চলবার চললো-কারণ ঠিক এই ইতিহাস আমি বিভিন্ন অঞ্চলগুলি থেকে আগত প্রত্যেক কুলির মুখেই শুনেচি-শেষে এখানে ও এসে পড়লো মজুরি, বিশেষ করে চাল পাওয়ার লোভে। পয়সা দিলেও গ্রামে আজকাল চাল মিলচে না, আমি সেদিন বহেরাগোড়া অঞ্চলে দেখে এসেচি।
অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি এল। ধরাধরি করে থুপীর বাবাকে গাড়িতে ওঠানো হল-সে কেবলমাত্র একবার যন্ত্রণাসূচক ‘আঃ’ শব্দ উচ্চারণ করা ছাড়া অত আদরের অত গর্বের বস্তু থুপীর নামও করলে না, তার দিকে ফিরেও চাইলে, না।
ডাক্তার বললেন, “টাটা এখান থেকে সাতাশ মাইল রাস্তা। ঝাঁকুনিতেই বোধ হয় মারা যাবে-বিশেষ করে রক্তবদ্ধ হল না যখন এখনও।”
দুধারে শালবনের মধ্যবর্তী রাঙা মরুম মাটির সোজা রাস্তা বেয়ে অ্যাম্বুলেন্সের মোটর ছুটলো থুপীর বাবাকে নিয়ে-পুনরায় অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে, পুনরায় পশ্চিমের আকাশ লক্ষ্য করে জন্ম থেকে মৃত্যুর দিকে। অত সাধের অনাথা থুপীকে কার কাছে রেখে চললো সে হিসেব নেবার অবসর তখন তার নেই।
Leave a Reply