বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:০৬ অপরাহ্ন

“ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাতো ঝড়,”

  • Update Time : রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৪, ১১.৩০ এএম

স্বদেশ রায়

ছোটবেলা, কৈশোর কাল কেন জীবনের এ প্রান্তে এসে মাঝে মাঝে উঁকি দেয়। যৌথ পরিবারের জোড়া তখনও ভাঙ্গেনি। ওই পরিবেশে বাবা ফরোয়ার্ড ব্লক এর সদস্য। যদিও তার দলের অস্তিত্ব পাকিস্তানে নেই। অন্যদিকে জ্যাঠামহাশয় বড় মাপের কংগ্রেসী। তার দলও তখনও পাকিস্তানে আছে। তবে পাকিস্তানে গান্ধীর থেকে তখনও বাবার নেতা সুভাষ বোস অনেক বেশি জনপ্রিয়। আবার দুজনেরই তরুণ বেলায় সোভিয়েত বিপ্লব হয়েছে। দিকে দিকে তখন কমিউনিস্টদের একটা বড় উচ্চারণ।

তাই জ্যাঠামহাশয় আর বাবার লাইব্রেরিতে যেমন ব্রিটিশ বিরোধী অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কাহিনী। তেমনি সোভিয়েত বিপ্লবের কাহিনী নিয়েও নানান বই। তার সঙ্গে চে গুয়েভারা।

বলা যেতে পারে পড়া শেখার পরেই প্রথমে পড়া শুরু করেছিলেম জেমস বন্ড সিরিজের একটা বই। দ্বিতীয়টা পড়ার আগেই জ্যাঠামহাশয় হাতে তুলেদিলেন বাংলায় লেখা চে গুয়েভারার একটা জীবনী। সবে মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছি। তারপরেও বইটির প্রতিটি পাতা জেমস বন্ড সিরিজের কাহিনী’র থেকে রোমাঞ্চকর হিসেবে ধরা দেয়। বিশেষ করে ওই বয়সেই চে গুয়েভারার কাছ থেকে শিখতে পারি, অসুস্থতা কোন ভালো কাজের জন্যে বা নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে কোন বাধা নয়। কাজ ও নিজের লক্ষ্যকেই সবার আগে রেখে গুরুত্ব দিতে হবে।

তবে চেগুয়েভারার থেকেও দ্রুত যে বইগুলো টানতে শুরু করে সেগুলো ছিলো বাবা ও জ্যাঠামহাশয়ের লাইব্রেরির অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কাহিনী। যার ভেতর দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ এবং বিশেষ করে গোটা বাংলাদেশের মধ্যে চট্টগ্রাম কেমন যেন নিজের কাছে পূণ্যভূমি বলে মনে হতে থাকে। মাস্টার দা সূর্যসেনকে তখন শুধু বীর নয়, এক বিষ্ময়কর নায়ক মনে হতে থাকে। বইটা পড়তে পড়তে দেয়ালে টাঙ্গানো হালকা চামড়ার ওপরে আঁকা বৃটিশ ভারতের ম্যাপের দিকে তাকিয়ে বিষ্মিত শুধু নয়- কেমন যেন এক অজানা যুগে চলে যেতাম।

এই বিশাল ব্রিটিশ শাসিত ভারতে মাস্টারদা তিন দিন চট্টগ্রামকে স্বাধীন রেখেছিলেন। নিজের আঙুলের কর গুনে হিসেব করি মাস্টারদার যুদ্ধের সৈনিক টেগরা আমার থেকে মাত্র ক’টি বছরের বড়। অথচ পাহাড়ের যুদ্ধে কীভাবে লাফিয়ে উঠে ইংরেজ সৈন্যকে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে মারে। আর সঙ্গে সঙ্গে টেগরার বুক ঝাঝরা হয়ে যায়, কিন্তু তাতে কষ্ট হয় না টেগরার জন্যে। বরং কোথায় যেন একটা আনন্দ নাড়া দিয়ে ওঠে, টেগরা বুকে গুলি নেবার আগে ঠিকই ইংরেজ সৈন্য বোমার আঘাতে মারা গেছে। আরো রোমাঞ্চিত হই যখন মাস্টারদাকে ধরিয়ে দেয়া সেই ইংরেজের দালালকে এক কোপে গলা থেকে মাথা নামিয়ে দেয় বিপ্লবীদের একজন।

আবার ঢাকার মিড ফোর্ডে মেডিকেলের ছাত্র বিনয়ের রিভলবারের গুলি যখন ফসকে যায়- মারা যায় না ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট- তখন বিনয়ের জন্যে খুব খারাপ লাগে। তবে সেই খারাপ লাগার দ্বিগুন নয় শতগুন শ্বাসরুদ্ধকর সময় এনে দেয় বিনয়ের নেতৃত্বে- বিনয়, বাদল, দিনেশ এর  রাইটার্স বিল্ডিং এর বারান্দা ব্যাটেল।আর বাঘা যতীন, সে তো কৈশোরেই টেনে নিয়ে গেছে উড়িষ্যা উপকূলে। যেখানে তাঁর অস্ত্রের জাহাজ নামার কথা ছিলো।উড়িষ্য উপকূল যেমন টেনেছিলো, তেমনি টানে বিশাল নদী পদ্মা।

 ওই ছোট বেলাতে যখন পড়ি ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ইসমাইল হোসেন সিরাজির শেঁকল বাধা অবস্থায় ইস্টিমার থেকে ব্রিটিশ পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে উম্মত্ত পদ্মায় ঝাঁপ দেয়া। তারপরে শেকল নিয়ে সেই পদ্মা সাঁতরানো। তখনো পদ্মা দেখেনি। বাবা যেহেতু প্রতিবছর পদ্মায় এক থেকে দেড় মাস নৌকায় কাটাতেন।সেজ জ্যাঠামহাশয়ও যেতেন। তাই দুজনের কাছে পদ্মার গল্প শোনার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তাদের সে পদ্মা ছিলো শীতের পদ্মা। তার সঙ্গে আমার পড়া ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সেই উম্মত্ত পদ্মা মিলতো না। সে পদ্মাকে দেখতে আমাকে বেশ অপেক্ষা করতে হয়েছে।

ওই অগ্নিযুগের কাহিনী ছোট বেলা থেকে জীবনের অনেক কিছু বদলে দিয়েছিলো কিনা তা বলতে পারি না। তবে সুভাষ চন্দ্র বোসের শিক্ষক আচার্য বেনীমাধব কন্যা বীনা দাশ ও বীর চট্টলার কন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার খুব ছোট বেলাতেই শিখিয়ে দিয়েছিলো- নারী ও পুরুষের বীরত্ব নিয়ে, শক্তি নিয়ে যে ভাগ করা হয় তা আসলে মিথ্যে- প্রয়োজনে সকলি সমান বীরত্ব রাখে।এরপরে জীবনের চলার পথে অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা কতটা সঠিক ছিলো এ নিয়ে অনেক সারগর্ভ বই পড়েছি।রাষ্ট্র,স্বাধীনতা,জাতীয়তাবাদ এসব নিয়েও নিজের কিছু চিন্তাও সৃষ্টি হয়েছে। বার বার তা নিয়ে লিখতে বসে কেন যেন মনে হয়েছে, আরেকটু সময় নেই। সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষ কোনটাই ছেলে খেলা নয়। এর হাজার হাজার বছরের পথচলা আছে। এ বালকের হাতের মোয়া নয়। এ নিয়ে আরো ভাবার প্রয়োজন। আর চিরস্থায়ী হচ্ছে মানব সমাজ। তারপরে অন্য কিছু। এ সমাজের দিকে তাকালে নিজেকে শিশুই মনে হয় । রবীন্দ্রনাথ যেখানে নিজেকে বলেছেন, একটি ধুলি কনা মাত্র। তাই  তখন আর লেখার সাহস থাকে না।

তবুও ছেলে বেলার সেই অগ্নিযুগের কাহিনী পড়ার ও জানার অনুভূতিকে কখনও গুরুত্বহীন মনে হয় না। বরং ছোট বেলাতেও যেমন সুকান্ত’র কবিতার কয়েকটি লাইন বার বার আওড়াতাম- আজো মাঝে মাঝে মনে আসে- “ ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়,/ ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে/গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে/ আজো রোমাঞ্চকর”।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024