ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অবঃ)
বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, জাতিসংঘে যোগদান করে। এর মাত্র ৪ বছরের মাথায় ১৯৭৮ সালের ১০ নভেম্বর, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৩০তম অধিবেশনে, বাংলাদেশ জাপানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ধনী দেশকে ভোটে পরাজিত করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। কেউ ভাবেনি জাপানের মতো ধনীদেশকে দরিদ্র বাংলাদেশ হারাতে পারবে। জাপানের কূটনীতিকরা অবাক হয়েছিলেন। এর ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন পরিচিতি লাভ করে ও দেশের চমৎকার ভাবমূর্তি তৈরি হয়। এটি ছিলো বাংলাদেশের জন্য এক অসাধারণ সম্মান।
হেমন্তের ভোরে এলো আনন্দের যে সংবাদ
ডেটলাইন ময়মনসিংহ। ১১ নভেম্বর ১৯৭৮। ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজ। হেমন্ত ভোরের হিমেল বাতাসে একদল সাদা পাখি ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে উড়ে যায় শহরের দিকে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম ময়মনসিংহে এসেছেন ১০ নভেম্বর। প্রেসিডেন্টের আগমনে ময়মনসিংহের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আনন্দ উচ্ছ্বাস। এরই মধ্যে খুব ভোরে নিউইয়র্ক থেকে (ঢাকা হয়ে) এলো আরেকটি আনন্দ সংবাদ।
খুব ভোরে প্রেসিডেন্টের এডিসি ক্যাপ্টেন মাসুদুল হাসান ঢাকা থেকে ফোন পেলেন। উল্লেখ্য ক্যাপ্টেন মাসুদ বৃটেনের বিখ্যাত রয়েল মিলিটারি একাডেমী স্যান্ডহাস্ট থেকে ১৯৭৫ সালে কমিশন প্রাপ্ত হন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এডিসিকে জানালেন যে, চলমান (নিউিইয়কে তখন ১০ নভেম্বর, বিকেল) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভোটাভুটিতে জাপানকে পরাজিত করে বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের রুমে অবস্থানরত প্রেসিডেন্ট জিয়াকে এই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি জানালেন দীর্ঘদেহী স্মার্ট এডিসি। সংবাদটি শুনে প্রেসিডেন্ট খুব খুশী হলেন। অত্যন্ত আন্তরিকতা ও উচ্ছ্বাসের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট সাধারণত এভাবে স্নেহ বা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন না। প্রেসিডেন্ট বললেন- “মাসুদ, এটা আমাদের খুব বড় একটা এচিভমেন্ট। এই সংবাদের জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম”।
নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি আসনের পাঁচটিতে স্থায়ী সদস্য রয়েছে এবং বাকি ১০টি পূরণ হয় অস্থায়ী সদস্যদের দ্বারা। ১০টি অস্থায়ী আসন পাঁচটি আঞ্চলিক গ্রুপের মধ্যে নিয়মিত ভিত্তিতে আবর্তিত হয়।
বাংলাদেশ প্রথম রাউন্ডে ৮৪ ভোট, দ্বিতীয় রাউন্ডে ৮৭ ভোট এবং তৃতীয় রাউন্ডে ১২৫ ভোট পায়। অন্যপক্ষে, জাপান পায় প্রথম রাউন্ডে ৬৫ ভোট, দ্বিতীয় রাউন্ডে ৬১ ভোট এবং তৃতীয় রাউন্ডে দুই ভোট। তৃতীয় রাউন্ডের ভোটের আগমুহূর্তে, জাপান তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে। এতে বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়। নির্বাচনে বাংলাদেশ দলের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এর প্রধান ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সফল পররাষ ট্রমন্ত্রী হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক মুহাম্মদ শামসুল হক। ঐ দলে অন্যান্যর মধ্যে ছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি স্বনামধন্য ও সবচেয়ে জেষ্ঠ্য কূটনীতিক কেএম কায়সার ও বর্ন্যাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী পররাষ্ট্র সচিব শাহ এ,এম,এস, কিবরিয়া। (পরবর্তীতে এমপি ও অর্থমন্ত্রী) নির্বাচনে বাংলাদেশের জয় সম্পর্কে জাপানের ‘মাইনিচি শিমরন’ পত্রিকা ১১ নভেম্বর ১৯৭৮ লেখে: “বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সংহতি ছিল খুবই দৃঢ়। জোটমুক্ত যে ৪৯টি দেশের ভোটের ওপর জাপান নির্ভর করেছিল তাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশকে ভোট দিয়েছে এবং ক্ষুদ্র দেশগুলোর সমানাধিকারের পক্ষে বাংলাদেশের তত্ত্ব তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর খুবই জোরালো প্রভাব রাখে”।
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার মাত্র চার বছরের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সদস্য নির্বাচিত হওয়া ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং তা দেশের ভাবমূর্তিকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে এটা সম্ভব হয়েছিল।
বিশ্বে বাংলাদেশের নতুন পরিচিতি
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র নীতির অবকাঠামো গোড়া পত্তন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চীন ও সতৌদি আরব ছাড়া অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি লাভ ছিল গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। সত্তর দশকের শেষ প্রান্তে এসে বিভিন্ন প্রতিকুলতা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে নতুন মাত্রা ও গতি যুক্ত হয় এবং তা সারা বিশ্বে ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। তি নি চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত একটি পররাষ্ট্রনীতি। প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশের জন্য সকলের সঙ্গে সম্পর্কের (ইনক্লুসিভ) পররাষ্ট্র নীতিতে বিশ্বাস করতেন। জিয়া পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে প্রো-অ্যাকটিভ নীতি অনুসরন করেন। তার সময়েই জগৎসভায় বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে বাংলাদেশ নতুন এ মর্যাদা লাভ করে।
নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো (১৯৭৯-১৯৮০) নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ লাভ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ সে সময়ে বিশ্বে ঠান্ডা যুদ্ধকালীন অবস্থা বিরাজমান ছিল এবং বিভিন্ন সংকটকালীন এজেন্ডা যেমনঃ আরব-ইসরায়েল উত্তেজনা, কম্বোডিয়ায় ভিয়েতনামের আগ্রাসন, আফগানিস্থানে সোভিয়েত অনুপ্রবেশ, ইরানের হোস্টেজ ইস্যু, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, রোডেশিয়ার স্বাধীনতা আইন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নিরাপত্তা পরিষদের এ জেন্ডা হিসেবে উত্থাপিত হয়।
বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সমূহের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কম্বোডিয়া এবং আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সোভিয়েট ভেটো প্রদানে বিরত রাখতে ব্যর্থ হলেও অবরুদ্ধ আরব ভূমিতে ইহুদি বসতি স্থাপনে বাধা দেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে আফগানিস্থানের সোভিয়েট দখলদারিত্বের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল বাংলাদেশ। তেহরানে আমেরিকান কূটনীতিকদের হোস্টেজ ইস্যূতে আন্তর্জাতিক আইনের মূল নীতির স্বীকৃতির লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেজুলেশনে সমর্থন উত্থাপন করে। বিশ্বের পরবর্তিত কূটনৈতিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদে দ্বিতীয় মেয়াদে সদস্য পদ লাভের সময়েও (২০০০-২০০০) বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের ইরান-সংকট মোকাবেলা
৪ নভেম্বর, ১৯৭৯ এক দল তরুন ইসলামী বিপ্লবী তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালিয়ে ৬০ জনের বেশী মার্কিন নাগরিককে জিম্মি হিসেবে আটক করে। এটি ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকট। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ইরানের বিরুদ্ধে জাতিংঘের অবরোধ চেয়েছিলেন। তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, কোনো সদস্যদেশ অবরোধের পক্ষে ভোট দিতে ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র
তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিবে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য উভয় সংকটের সৃষ্টি করে কারণ প্রেসিডেন্ট জিয়া চাননি, বাংলাদেশ কোনো মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে নেয়া কোনো উদ্যোগে অংশ নিক। এমনকি প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ফোন করে কাটার অবরোধ প্রস্তাবের পক্ষে বাংলাদেশের সমর্থণ চান। এই অবস্থায় জিয়া সিদ্ধান্ত নেন যে, বাংলাদেশ এই ব্যাপারে একটি বিবৃতি দিবে এবং ভোট দানে বিরত থাকবে। উল্লেখ্য এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের উপর কোনো বিরুপ প্রভাব ফেলেনি।
চীন-ভারত বিরোধ নিষ্পত্তিতে জিয়ার কাছে দেং জিয়াং পিং এর আশ্চর্য্য প্রস্তাব
১৯৭৮ সালে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম ইল সুং সে দেশের ত্রিশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনষ্ঠানে জিয়াকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। পিয়ং ইয়ং এ জিয়া উদীয়মান চীনা নেতা দেং জিয়াং পিং এর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। এক ঘন্টার বৈঠকে দেং চীন-ভারত সম্পর্ক নিয়ে জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেন। দেং বলেন “চীন ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চায়। ১৯৬২ সালের যুদ্ধ সত্ত্বেও বর্তমান বিরোধ সীমান্ত নির্ধারন নি য়ে আমি মনে করি আমাদের প্রজন্মে এই সমস্যার সমাধান হবে না। ভারত যদি সমস্যাটাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সরিয়ে রেখে দেয়, তাহলে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারি”। দেং চেয়েছিলেন, জিয়া যেন তাঁর এই বার্তা ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে পৌছে দেন। তিনি বলেছিলেন, এটা জানাতে তাঁরা তাঁদের নিজেদের চ্যানেল ব্যবহার করতে পারছেন না। (প্রেসিডেন্ট জিয়া, রাজনৈতিক জীবনী, মাহফুজ উল্লাহ)।
ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধে প্রেসিডেন্ট জিয়ার দূতিয়ালী
ইরাক ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ আকস্মিকভাবে ইরানের উপর হামলা চালালে দুদেশের মধ্যে ৮ বছর ব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়। এই অপ্রত্যাশিত যুদ্ধ মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্চ হিসেবে উপস্থিত হয় এবং দুদেশের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে ওআইসি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ছয় রাষ্ট্র প্রধানের সমন্বয়ে একটি ইসলামিক শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এক পর্যায়ে কমিটি, যুদ্ধরত দুই দেশের সঙ্গে জিয়ার সুসম্পর্ক ও দুদেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কাছে তাঁর গ্রহণ যোগ্যতা বিবেচনায় নিয়ে কমিটি প্রেসিডেন্ট জিয়াকে এক সদস্যের শান্তি মিশনের দায়িত্ব দেয়।
জিয়াউর রহমান ১২ মে ১৯৮১ বাগদাদ যান। ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন তাঁকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানান। পরদিন তিনি যান তেহরানে। উভয় দেশের প্রেসিডেন্ট জিয়ার দেওয়া প্রস্তাব সমূহ মেনে নিতে সম্মত হন। বাগদাদ ও তেহরানে সফরকালে অর্জিত প্রাথমিক সাফল্য সত্ত্বেও, তাঁর হত্যাকান্ডের পর সেই শুভেচ্ছা মিশনের আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটে। বাস্তবতা হলো, সেই সময়ে মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশ একটি মযার্দাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়। জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ আল কুদস কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন সার্ক এর স্বপ্নদ্রষ্টা। যা পরে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় (১৯৮৫) বাস্তবায়িত হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ঐতিহাসিক অর্জন।
এই অবস্থায় আমরা কিভাবে এলাম?
স্বাধীনতার প্রথম দশকে ১৯৭১-১৯৮১ বাংলাদেশ অত্যান্ত দরিদ্র থাকলেও পররাষ্ট্র নীতির গতিশীলতায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশ পরিচিত পেয়েছিল। গত ৫৪ বছরে অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশের ভূকৌশলগত গুরুত্বও অনেক বেড়েছে। অবশ্য আন্তর্জাতির পরিস্থিতি অনেক জটিল হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পররাষ্ট্রনীতির গতিশীলতা, সক্রিয়তা এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ধরে রাখতে পারিনি। কোন কোন সময়, আন্তর্জাতিক এমনকি আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও ঢাকা তার অবস্থান ও কন্ঠস্বর হারিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। পরবর্তী সময়ে কুটনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য এলেও ঢাকা তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি।
দূতাবাসের কূটনীতিকদের দলীয়, রাজনৈতিক, পারিবারিক, ব্যাক্তিগত ও অপ্রয়োজনীয় “গুরুত্বপূর্ণ” কাজে দায়িত্ব না দিয়ে শুধুমাত্র পেশাগত কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দলীয় ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে যোগ্য কূটনীতিকরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। কোন কোন দূতাবাস ক্ষমতাশীন দলের কর্তা ব্যক্তিদের ট্রাভেল এজেন্সি ও টুরিষ্ট ডেসটিনেশ নে পরিনত হয়েছিল। এমন সমালোচনা ঢাকায় ছিল।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বর্তমানে করনীয়
পররাষ্ট্র নীতি ও পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে আত্ম-উপলব্ধি (সোল সার্চিং) ও আত্ম-সমীক্ষা দরকার। বৈদেশিক নীতির সংস্কার এখন জরুরী। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর মতো গ্লোবাল ব্যাক্তিত্ব এখন বাংলাদেশের সরকার প্রধান। তার ভাবমূর্তি কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশকে এখন বড় চিন্তা করতে হবে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট আন্দোলন একটি সক্রিয় বৈদেশিক নীতির প্রয়োজনীতা ও পররাষ্ট্রনীতিতে আমল পরিবর্তনের পক্ষে জোর দিয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র নীতি উদ্দেশ্য হওয়া উচিত- আমাদের সিদ্ধান্তে কৌশলগত স্বায়ত্বশাসন অর্জনের চেষ্টা করা।
উন্নয়নগামী দেশের প্রথম নিরাপত্তা বেষ্টনী হলো কূটনীতি। একটি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার সেটাই প্রথম রক্ষাকবচ। সেই কূটনীতি হবে গতিশীল, সক্রিয় এবং দূরদর্শী। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে রূপান্তরীত করতে হবে।
সুন্দরভাবে গড়ে উঠুক একটি গতিশীল, আধুনিক ও পেশাদার পররাষ্ট্র দপ্তর। অর্থনৈতিক কূটনীতির সঙ্গে সঙ্গে পানি-কুটনীতি (বিশেষশত ভারতের সঙ্গে), শ্রম কূটনীতি, জলবায়ু কূটনীতি ও সামরিক কূটনীতি গুরুত্ব দিতে হবে। কূটনীতিকদের অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশীদের সহায়তায় নিবেদিত-প্রান হতে হবে। অসহায় বাংলাদেশীদের পাশে তাদের দাঁড়াতে হবে।
পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করার দায়িত্ব জনপ্রতিনিধিদের। আর এর বাস্তবায়নে থাকেন পেশাদার কূটনীতিকগন। এটা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার অন্তত প্রথম দুই দশকে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের এক ঝাক মেধাবী ও সুদক্ষ বাঙালি কূটনীতিকদের সার্ভিস বাংলাদেশ পেয়েছিল। তাদের স্মার্টনেস, পেশাদারিত্ব, দক্ষতা, সাফল্য, প্রশিক্ষন ও গ্রুমিং এর বিষয়গুলো আমাদের তরুন কূটনীতিকদের কাছে প্রেরণা ও শিক্ষনীয় বিষয় হতে পারে।
আমাদের মেধাবী কূটনীতিকগন দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের ডানায় ভর করে বাংলাদেশকে দারুনভাবে প্রতিনিধিত্ব করুক বিশ্বের দরবারে। পররাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে শুরু হোক আমাদের নতুন পথচলা। এগিয়ে যাক আমাদের ঐক্যবদ্ধ ও ইনক্লুসিফ প্রাণের বাংলাদেশ।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক bayezidsarwar792@yahoo.com
Leave a Reply