কৃষি ও কৃষক
চতুর্থ অধ্যায়
১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে খুলনার মৌভোগে প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন কৃষকদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সম্মেলন থেকে আহ্বান জানানো হল – “প্রতিটি গ্রামে সমিতির মধ্যে সব কৃষক জোট বাঁধিয়া জমিদারের শোষণের বিরুদ্ধে শেষ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হও”। কৃষক সভার নেতা কৃষ্ণবিনোদ রায় খুলনা ২৪ পরগনার কৃষকদের অবস্থা সম্পর্কে কৃষক সভার কাছে রিপোর্টে মন্তব্য করেন- ‘খুলনা ও ২৪ পরগনা জেলার সুন্দরবন অঞ্চলে ভাগচাষি ও খেতমজুরের অবস্থা একেবারে ক্রীতদাসের পর্যায়ে দাঁড়াইয়াছে, জমি খাস করার প্রথা অন্যান্য জায়গা অপেক্ষা এখানে অনেক জঘন্য।
খুলনা জেলার কামারখোলা ইউনিয়নে বড় বড় চালাঘর দেখা যায়। কোন ঘরে ৫০ জন অন্য কোন জোতদারের চালাঘরে ১০০ জন লোককে পড়িয়া থাকিতে দেখা যায়। ইহাদের সব জমি বাড়িঘর পর্যন্ত জোতদারের পেটে গিয়াছে। জোতদারই তখন বলিয়াছে আপাতত আমার বাড়িতে আশ্রয় লও। তাহারা তেমনই থাকে। সপরিবারে জোতদারের বাড়িতে তাহারা খাটে, নিজেদের প্রাপ্য ধানে বা কল্প লইয়া গাছতলায় বা তালপাতার ঘর বাঁধিয়া সেখানে রাঁধিয়া খায়। তারপরের ইতিহাস খুব ছোট, পারিবারিক জীবনও ভাঙ্গিয়া যায় লক্ষ্মীশ্রী সম্পন্ন সুখী কৃষকের জীবন ভস্মলোচন জোতদারের চাহনিতে পুড়িয়া ছারখার হইয়া যায় চালাঘরে পড়িয়া থাকে ভস্মাবশেষ, ছন্নছাড়া মজুর’।
২৪ পরগনার সাগর কাকদ্বীপ ফলতা বজবজ প্রভৃতি এলাকায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্ব থেকে জমিদার মহাজনদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এসব এলাকার কৃষকদের বিক্ষোভ ছিল। ১৯৩৪-৩৫ এর দিকে কাকদ্বীপ সাগর এলাকার ১ নং থেকে ১৩ নং লাট বর্তমানের কাকদ্বীপের উত্তরাংশে একটা বড় এলাকা জুড়ে কৃষকদের বিক্ষোভ চলছিল এই আন্দোলন ছিল জমিদারের খাজনা বহির্ভূত নানারকম অতিরিক্ত আদায় সম্পর্কে কৃষকদের প্রতিবাদ। কৃষকরা দাবি করেছিল ‘বাজে আদায় দিব না, খামার ছিলনি দিব না, দারোয়ানি দিব না, ভাগ সেলামি দিব না।” জমিদারের নায়েব এসব আদায় ছাড়া আরও নানারকমভাবে প্রজাদের কাছে বিঘা প্রতি জমি হিসাবে টাকা আদায় করত। এর সঙ্গে নানাধরনের আর্থিক জরিমানা করত বিচারের নামে, কারণ নায়েবমশাইরা ছিল সে যুগে সমস্ত রকমের বিচারের কর্তা এবং সে যুগে এটাই ছিল রেওয়াজ।
অম্বুবাচীর দিনে হলকর্ষণ করতে নেই, পৃথিবী রজস্বলা হয়েছে, আগামী মরশুমের চাষের প্রস্তুতির দিন। অম্বুবাচীর দিনে কাকদ্বীপ এলাকার এক দুঃস্থ মহিলা জমি থেকে শাক তুলেছিল তার জন্য তাকে জরিমানা করা হল। এসব জরিমানার টাকা খামারে ধান উঠলে তার থেকে কেটে নেওয়া হত-এ ধরনের অত্যাচার সুন্দরবনের চাষির জীবনের সেদিনকার নিত্য অভিজ্ঞতা। এর সঙ্গে জোতদার নায়েবদের লাম্পট্যের অসংখ্য খতিয়ান এ এলাকা জুড়ে ছিল। সুন্দরবনের জনৈক জমিদার গর্ব করে বলেছিল- বিবাহের পূর্বে প্রতিটি কুমারীকে তার শয্যা-সঙ্গিনী হতে বাধ্য করা হত। বাংলার অন্যত্র জমিদাররা শোষণের পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে বদান্যতার ছবি রেখে গেছেন কিন্তু সুন্দরবনের জমিদাররা সম্পূর্ণ…পে আলাদা চরিত্রের মানুষ-দু পাঁচজন-এর ব্যতিক্রম থাকলেও সেটা ভীষণভাবে ব্যতিক্রম।
Leave a Reply