বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৫ অপরাহ্ন

বাস্তবতা প্রমান করছে সামরিক শাসনই একমাত্র সমাধান

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৮.০০ এএম

স্বদেশ রায়

একটি দেশ, তার মানুষের চরিত্র এবং দেশটি দীর্ঘদিন কীভাবে শাসিত হচ্ছে, যার ভেতর দিয়ে তাদের দেশের মানুষের মনোজগত ও রাষ্ট্রের সঙ্গে কোন ধরনের সম্পর্ক হয়েছে- এর ওপরই নির্ভর করে ওই দেশে কোন ধরনের শাসন পদ্ধতি থাকবে।

ওপরের বিষয়গুলোই মাথায় রেখে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার বিষয়টি চিন্তা করা প্রয়োজন। মিয়ানমার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্টির শাসনের বাইরে এসে প্রকৃত অর্থে একক একটি আধুনিক কাঠামোর রাষ্ট্র হয়েছিলো ব্রিটিশ শাসনের অধীনে। ব্রিটিশের প্রতিটি উপনিবেশের মত বর্তমানের মিয়ানমার সে সময়ের বার্মাও ছিলো মূলত একটি পুলিশি রাষ্ট্র বা অস্ত্র শাসিত রাষ্ট্র। যার বর্ণনা জর্জ অরওয়েল ইন বার্মা বইয়ে খুব সুন্দর ভাবে পাওয়া যায়। বইটির লেখক সাংবাদিক- তাই কল্পনা সম্পূর্ণ দূরে রেখে বাস্তবতাগুলোকেই তিনি প্রতি মুহূর্তে মাটি খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করেছেন। তিনি যেমন প্রমান করেছেন, এনিমাল ফার্ম মোটেই সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য করে লেখা কোন বই নয়; এটা মূলত বার্মার সমাজকে নিয়ে লেখা- তেমনি তার গবেষণা ও সাংবাদিক দৃষ্টিতে খোঁজার ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে ওই সময়ের বার্মার সমাজ ও পরিবেশ। জর্জ অরওয়েল এর গ্রান্ড ফাদারও ছিলেন বার্মার একজন পুলিশ অফিসার। জর্জও পুলিশ অফিসার হিসেবে বার্মায় পোস্টিং পেলে, তার গ্রান্ডমাদার বলেন, সত্যি তুমি সেখানে একটা অত্যন্ত সুন্দর জীবন পাবে। যদিও ম্যালেরিয়া সহ বেশ কিছু সমস্যা আছে। তার পরেও তুমি দেখবে সব সময়ই খালি পায়ে তোমাকে সেবা করার জন্যে বিশ থেকে বাইশ জন নেটিভ চাকর মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে- তোমার নির্দেশের অপেক্ষায়। যে কোন অটোক্রেটিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এমনই একটি  নির্বাক দরিদ্র কর্মী শ্রেণী গড়ে তোলে। আর এই নির্বাক মানুষগুলো দ্বায়িত্ববান সবাক হতে দীর্ঘ সময় নেয়। কারণ, সবাক ও দ্বায়িত্ববান সবাকের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তাছাড়া এনিম্যাল ফার্মের “ মোর ইকুয়াল”  শ্রেণী বা এলিট বা শিক্ষিত শ্রেনীটি সেখানে স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছিলো- বিভিন্ন নৃতাত্তিক গ্রুপে যারা বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জড়িত ছিলো- তাদের পরিবার গুলোকে ঘিরে। আর ব্যবসায়ী পরিবারগুলোও নিরাপত্তা সহ নানান কারণে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো ও সেইভাবে বেড়ে উঠতো। তারা এতই শক্তিশালী ছিলো যে মিয়ানমার বা ওই সময়ের বার্মাকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আগেই সে দেশের এখনও জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃত আউং সাং তার কমিউনিস্ট  রাষ্ট্র  তৈরির স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। এমনকি তিনি যে সে দেশের ১৩৯টি এথনিক গ্রুপকে সাতটি ভাগে ভাগ করে একটি ছাতার নীচে আনতে চেয়েছিলেন -তার সে স্বপ্নও পূরণ হয়নি। বরং দেশটি সামরিক শাসনের অধীনে চলে যায়।

সামরিক শাসনের অধীনে দেশটির ইতিহাস দীর্ঘ। সেখানে দেশটিকে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব গণতান্ত্রিক দেশ তৈরির জন্যে নানান ধরনের চাপ প্রয়োগ করেছে। কিন্তু দেশটি সামরিক শাসনের অধীনেই অখন্ডতা ও অনেকখানি স্থিতিশীলতা নিয়ে তার নিজস্ব সম্পদের ওপর ভর করে এগিয়ে চলে। এ ক্ষেত্রে সে সময়ের বার্মার সামরিক শাসকরা দুটো সুবিধা সব সময়ই পেয়েছে।  এক, তাদের নিজস্ব তেল, কৃষি ও সমুদ্র সম্পদ। দুই, প্রতিবেশী দুটি বড় দেশ চায়না ও ভারতের সমর্থন। এমনকি অন্য প্রতিবেশী থাইল্যান্ডে সে দেশের কিছু এনথিক বিদ্রোহী আশ্রয় নিলেও দেশটি সব সময়ই মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে সমর্থণ করেছে।

প্রথম দিকে সে দেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কিছু কমিউনিস্ট বিদ্রোহী থাকলেও সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে সেটা কমে যায়। তাছাড়া সব থেকে বড় বিষয় হলো চায়না সেখানে কখনও সমাজতন্ত্র বা মাওবাদ এক্সপোর্ট করতে চায়নি।

যাহোক, সত্তর দশকের শেষ দিকে সে দেশের জাতির পিতার কন্যা সূচি ফিরে এসে গণতান্ত্রিক জোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করেন।পশ্চিমারা তাকে সব ধরনের সাপোর্ট দিতে থাকে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতা সে দেশের সামরিক শাসনের বন্ধু হলেও তাদের মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটির একটি অংশ সূচিকে সমর্থন দেয়। পশ্চিমারা সূচিকে আরো গ্রহনযোগ্য করে তোলার জন্যে তাকে শান্তিতে নোবেলও জোগাড় করে দেন। সব মিলে পশ্চিমা ও ভারতীয় মিডিয়ায় এবং সে দেশের ছাত্র সমাজের কাছে আশির দশকের শেষে সূচি একজন গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এবং সামরিক শাসকরাও তাকে অনেক বেশি জনপ্রিয় করে তোলেন গৃহবন্দী রেখে। যার ফলে দেখা যায় সূচী ও মিয়ানমারের গণতন্ত্রের সমর্থনে রেঙ্গুন ইউনিভারসিটিতে ও অনান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক বেশ বড় আকারের ছাত্র আন্দোলন হয় নব্বইয়ের দশকে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানান দেশের ছাত্র নেতারা সে আন্দোলনকে সমর্থন জানায়।

বার্মার সামরিক শাসক রক্তাত পথে সে আন্দোলন বন্ধ করে। এর পরে সেখানকার সামরিক শাসক দুটো পথ নেয়। তারা চায়না থেকে অধিক পরিমানে ও ভারত থেকে যথেষ্ট পরিমানে সামরিক সরঞ্জাম কেনে। এছাড়া তারা রেঙ্গুন থেকে রাজধানী নেপিয়েডোতে সরিয়ে নেন ও সেখানে দীর্ঘ সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনীর পরিবার ও তাদের সমর্থকদের যে এলিট শ্রেনী তৈরি হয়েছিলো- তাদের জন্যে উন্নত মানের শিক্ষায়তন তৈরি করে। তারপরেও নিউ মিলিনিয়ামে এসে সে দেশের সামরিক সরকারকে বড় ধরনের গণবিদ্রোহের মুখে পড়তে হয়। তবে নব্বই দশকে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক যে গণ-আন্দোলন হয়েছিলো তার থেকে এই গণ -আন্দোলনের চরিত্র ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই আন্দোলনে সামনে ছাত্ররা থাকলেও আন্দোলনের মূল শক্তি ছিলো বৌদ্ধ ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা। ওই আন্দোলের ফলে সে দেশের সামরিক সরকারের এক ধরনের পরাজয় হয়, সূচি মুক্ত হন। তার ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স বিজয়ী হয়। এবং সেদেশের সংবিধান অনুয়ায়ী সামরিক বাহিনীর কোটা সহ তিনি পার্লামেন্ট গঠন করে দেশের সরকার প্রধান হন।

কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় অনঅভিজ্ঞ সূচি সে দেশের সামরিক সরকাররা যেমন ১৩৯টি এথনিক গ্রুপকে অন্তত ৭০ থেকে ৮০ ভাগ সমঝোতার মাধ্যমে ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মোটামুটি শান্ত রাখতেন – যার ফলে সেখানে ধর্মগত ও নৃ-গোষ্টি গত বিচ্ছিন্নতাবাদ কিছুটা থাকলেও তা খুব প্রকট আকারে ছিলো না।কিন্তু সূচির আন্দোলনের বিজয়ের মূল শক্তি যেহেতু বৌদ্ধ উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্টি ছিলো তাই তাদেরকে সূচিকে অনেক বেশি ছাড় দিতে হয়। যা প্রকট হয়ে দেখা দেয় আরকানে। আরাকানে আর্ন্তজাতিক অর্থনীতির নানান খেলা থাকলেও সামরিক শাসনের আমলে সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের এত বড় মাপে কখনও তাড়ানো হয়নি এর আগে। ১০ লাখের ওপর আরকান মুসলিম বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে চলে আসতে বাধ্য হয়। এবং বাংলাদেশও তাদেরকে নেয়ার আগে কেন মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কোনরূপ বড় ধরনের আলোচনায় যায়নি- এ প্রশ্নের উত্তরও স্পষ্ট নয়।

যাহোক এভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের পরেও পরবর্তী নির্বাচনে সূচির দল আবার বিজয়ী হয়। কিন্তু তারা স্থায়ী সরকার গঠন করার আগেই সেখানে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে। যা বর্তমানের সামরিক সরকার।

বর্তমানের এই সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করার পরে পশ্চিমা বিশ্ব যেমন ওই সরকারের ওপর অর্থনৈতিক স্যাংশন দিয়েছে তেমনি সেখানে বেশ কিছু অদৃশ্য শক্তি নৃতাত্ত্বিক গোষ্টি গুলোকে নানা ভাবে সহায়তা দিয়ে দেশটিকে এক ধরনের গৃহযুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে দেশটি এই গৃহযুদ্ধের মধ্যে আছে। যা তাদের কৃষি উৎপাদনকে বাধাগ্রস্থ করে দেশকে খাদ্যাভাবে নিয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে যে রিপোর্টারগন নিয়মতি মিয়ানমারের ঢুকছেন ও তাদের বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তাদের রিপোর্ট পড়ে ও তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় এটা বোঝা যাচ্ছে যে- এই বিদ্রোহী গ্রুপগুলো কখনও মিয়ানমারের কেন্দ্রিয় বা আঞ্চলিক ক্ষমতা নিতে পারবে না। বরং মিয়ানমারকে এই এলাকার একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত হিসেবে তৈরি করতে সাহায্য করবে।

যাহোক আমেরিকার নির্বাচনের এক মাস আগেই যখন বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছিলো, সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হবেন। আর তিনি বিজয়ী হলে আমেরিকা বিশেষ করে বাইডেন- হিলারী পররাষ্ট্রনীতি’র ওই ছোট দেশ নিয়ে গণতান্ত্রিক গিনিপিগ তৈরির নীতিটি থাকবে না- সেটা বুঝেই চায়না মিয়ানমার সম্পর্কে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার প্রধানকে সরকারি ভাবে না হলেও সে দেশে আমন্ত্রন জানিয়েছে। এবং তারা তার সঙ্গে প্রকাশ্যে কথা বলছেন। এবং এই আমন্ত্রনের কয়েক দিন আগেই চায়নার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারে সে দেশের সামরিক সরকার প্রধানের সঙ্গে দেখা করেন ও মিয়ানমার সফর করেন। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীও ইতোমধ্যে কথা বলেছেন মিয়ানমারের সামরিক সরকার প্রধানের সঙ্গে। ভারতও তাদের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে সে দেশের সামরিক সরকার প্রধানের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করছে বলে আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায় সংবাদ এসেছে। অন্যদিকে আশিয়ান সদস্যভূক্ত অনান্য দেশও মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে যেভাবে কিছুদিন আগে দেখছিলো সেখান থেকে বেশ আগেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করছে।

এই পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে, সূচির সমর্থক হিসেবে রয়েছে মিয়ানমারের উগ্র ধর্মীয় গোষ্টি,  তাছাড়া এথনিক বিচ্ছিন্নতার বিজয় পৃথিবীর অনান্য দেশের জন্যেও খারাপ- কারণ সব দেশই অনেকগুলো এথনিক গ্রুপ মিলেই তাদের একটি কমন নাগরিক গোষ্টি গড়ে তুলেছে। তাই ধর্মীয় উগ্রতার মতো এথনিক উগ্রতারও এক্সপোর্ট হতে পারে।

এসব মিলেই মিয়ানমারের প্রতিবেশি দেশগুলো মনে করছে, মূলত একটি স্থিতিশীল মিয়ানমার কেবল সামরিক শাসকরাই নিশ্চিত করতে পারেন। তাছাড়া সব জাতি সব সময়ে গণতন্ত্রের জন্যে উপযুক্ত থাকে না। আর মিয়ানমারের ইতিহাসই প্রমান করছে এই জনগোষ্টির স্থিতিশীলতা যতটুকু হোক তা সামরিক শাসনই নিশ্চিত করেছে। এ কারণে এ মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত হবে সে দেশের সামরিক শাসনকে নিশ্চিত ও শক্তিশালী করে দেশকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে মুক্ত করা। সামরিক শাসনই এখন সমাধানের পথ।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.      

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024