সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।
দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..
দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।
দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।
সাধনের জন্ত্য বাধ্য হয়ে আমাকে খেতে হয়, তাছাড়া ওতে আমার কোন ক্ষতিই হয় না, হেরম্ব। কারণ পান করলে তোমার নেশা হবে, আমার শুধু একাগ্রতার সাহায্য হয়। প্রক্রিয়া আছে মন্ত্রতন্ত্র আছে-সে সব তুমি বুঝবে না, হেরম্ব। বাবা বলেন, নেশার জন্য ওসব খাওয়া মহাপাপ। আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য খাও কোন দোষ নেই।’
আনন্দ মিনতি করে বলল, ‘আজ থাক মা।’
মালতী মাখা নেড়ে অস্বীকার করে চলে গেল।
ঘরের মাঝখানে লণ্ঠন জ্বলছিল। কাচ পরিষ্কার, পলতে ভাল করে কাটা, আলোটা বেশ উজ্জ্বল। পূর্ণিমার প্রাথমিক জ্যোৎস্নার চেয়ে ঢের বেশী উজ্জ্বল। হেরম্বের মনে হল, আনন্দের মুখ ম্লান দেখাচ্ছে।
আনন্দ বলল, মা’র দোষ নেই।’
‘দোষ ধরিনি, আনন্দ।’
‘দোষ না ধরলে কি হবে! মেয়েমানুষ মদ খায় একি সহজ দোষের
কথা।’
সুপ্রিয়াকে মনে করে হেরম্ব চুপ করে রইল।
একটা জলচৌকি সামনে টেনে আনন্দ তাতে বসল।
‘কিন্তু মা’র সত্যি দোষ নেই। মনে একটা ভয়ানক কষ্ট আছে। কষ্টের জন্য।’ এসব বাবার জন্য হয়েছে। জানেন মা’র একবার পাগল হয়ে যেতে বসেছিল এই
‘কিসের কষ্ট?’
আনন্দ বিষণ্ণ চিন্তিত মুখে গোলাকার আলোর শিখাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখ না ফিরিয়েই বলল, ‘মা, বাবাকে ভয়ানক ভালবাসে। বাবা যদি দুদিনের জন্যও কোথাও চলে যান, মা ভেবে ভেবে ঠিক পাগলের মতো হয়ে থাকে। বাবা কিন্তু মাকে দু’চোখে দেখতে পারেন না। আমার জ্ঞান হবার পর থেকে একদিন বাবাকে একটি মিষ্টি কথা বলতে শুনিনি।’ হেরম্ব অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু মাস্টারমশায় তো কড়া কথা বলবার লোক নন!’
‘রেগে চেঁচামেচি করে না বললে বুঝি কড়া কথা বলা হয় না? আপনার সামনে মাকে আজ কি রকম অপদস্থ করলেন, দেখলেন না। চব্বিশ ঘণ্টা এক বাড়িতে থাকি, মা’র অবস্থা আমার কি আর বুঝতে বাকী আছে! এমনি মা অনেকটা শান্ত হয়ে থাকে। মদ খেলে আর রক্ষা নেই। গিয়ে বাবার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দেবে। শুনতে পাবার ভয়ে আমি অবশ্য বাগানে পালিয়ে যাই, তবু দু’চারটে কথা কানে আসে তো। আমার মন এমন খারাপ হয়ে যায়।’ ক্ষণিকের অবসর নিয়ে আনন্দ আবার বলল, ‘বাবা এমন নিষ্ঠুর!’
কাত হয়ে আনন্দের বালিশে গাল রেখে হেরম্ব শুয়েছিল। বালিশে মৃগনাভির মৃদু গন্ধ আছে। মালতীর ছঃখের কাহিনী শুনতে শুনতেও সে স্মরণ করবার চেষ্টা করছিল কন্ডুরীগন্ধের সঙ্গে তার মনে কার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আনন্দের উচ্চারিত নিম্নর শব্দটা তার মনকে আনন্দের দিকে ফিরিয়ে দিল।
‘নিষ্ঠুর ?’
‘ভয়ানক নিঠুর। আজ বাবার কাছে একটু ভাল ব্যবহার পেলে মা মদ ছোঁয় না। জেনেও বাবা উদাসীন হয়ে আছেন। এক এক সময় আমার মনে হয়, এর চেয়ে বাবা যদি কোথাও চলে যেতেন তাও ভাল ছিল। মা বোধহয় তাহলে শান্তি পেত।’
বাবা যদি কোথাও চলে যেতেন। হলে নিষ্ঠুর চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে পারে? আনন্দও তাহলে প্রয়োজন উপস্থিত মালতীর দুঃখের চেয়ে আনন্দের এই নূতন পরিচয়টিই যেন হেরম্বের কাছে প্রধান হয়ে থাকে। তার নানা কথা মনে হয়। মালতীর অবাঞ্ছনীয় পরিবর্তনকে আনন্দ যথোচিতভাবে বিচার করতে অক্ষম নয় জেনে সে সুখী হয়। মালতীর অধঃপতন রহিত করতে অনাথকে পর্যন্ত সে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেবার ইচ্ছা পোষণ করে, মালতীর দোষগুলি তার কাছে এতদূর বর্জনীয়। মাতৃত্বের অধিকারে যা খুশী করবার সমর্থন আনন্দের কাছে মালতী পায়নি। শুধু তাই নয়। আনন্দের আরও একটি অপূর্ব পরিচয় তার মালতী সম্পর্কীয় মনোভাবের মধ্যে আবিষ্কার করা যায়। মালতীকে সে দোষী বলে জানে, কিন্তু সমালোচনা করে না, তাকে সংস্কৃত ও সংশোধিত করবার শতাধিক চেষ্টায় অশান্তির সৃষ্টি করে না। মালতীকে কিসে বদলে দিয়েছে আনন্দ তা জানে। কিন্তু জানার চেয়েও যা বড় কথা, মনোবেদনার এই বিকৃত অভিব্যক্তিকে সে বোঝে, অনুভব করে। জীবনের এই যুক্তিহীন অংশটিতে যে অখণ্ড যুক্তি আছে, আনন্দের তা অজানা নয়। ওর বিষণ্ণ মুখখানি হেরম্বের কাছে তার প্রমাণ দিচ্ছে।
আনন্দ চুপ করে বসে আছে। তার এই নীরবতার সুযোগ তাকে সে কত দিক দিয়ে কতভাবে বুঝেছে হেরম্বের মনে তার চুলচেরা হিসাব চলতে থাকে। কিন্তু এক সময় হঠাৎ সে অনুভব করে এই প্রক্রিয়া তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। আনন্দকে বুদ্ধি দিয়ে বুঝবার চেষ্টায় তার মধ্যে কেমন একটা অনুত্তেজিত অবসন্ন জ্বলা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সম্মুখে পথ অফুরন্ত জেনে যাত্রার গোড়াতেই অশ্রান্ত পথিকের যেমন স্তিমিত হতাশা জাগে, একটা ভারবোধ তাকে দমিয়ে রাখে, সেও তেমনি একটা ঝিমানো চেপে-ধরা কষ্টের অধীন হয়ে পড়েছে। আনন্দের অন্তরঙ্গ প্রশ্রয়ে তার যেন সুখ নেই।
Leave a Reply