কলকাতা
কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের যোগদান ঘিরে অনিশ্চয়তা। প্রায় তিন দশক পর এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বইমেলার আয়োজনকারী গিল্ড এ ব্যাপারে তাকিয়ে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে।
শীতের ক্যালেন্ডারে সবচেয়ে এই শহরের সবচেয়ে বড় পার্বণ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। কলকাতার মেলার অন্যতম অংশ বাংলাদেশের প্রকাশকরা। তাদের জন্য মেলার মাঠে থাকে পৃথক বাংলাদেশ মণ্ডপ। এবার সেটি থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
গিল্ডের ঘোষণা
বইমেলার বয়স ৪৮ বছর। আগামী ২৮ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি এবারের বইমেলা চলবে বলে ঘোষণা করেছে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড।
শুক্রবার গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এবারের মেলায় প্রতি বছরের মতো অংশ নেবে গ্রেট ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পেরু, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া এবং লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশ।
কিন্তু এই তালিকায় নাম নেই প্রতিবেশী বাংলাদেশের। দুই বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি এক। উভয় বাংলায় দুই দেশের সাহিত্যিকদের গুণমুগ্ধ পাঠকরা রয়েছেন। তাই প্রতি বছর বাংলাদেশ মণ্ডপে হাজির হওয়া প্রকাশকদের স্টলে ঝাঁপিয়ে পড়েন পশ্চিমবঙ্গের বইপোকারা। এবার সম্ভবত তাদের হতাশ হতে হবে।
এই বিষয়ে বিশদে কিছু বলতে চাননি গিল্ডের সভাপতি। তার বক্তব্য, “উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে আমরা সরকারের মুখাপেক্ষী। তারা যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাই মেনে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশের প্রকাশকরা বইমেলায় আসেন। কলকাতা বইমেলায় প্যাভিলিয়ন করার জন্য আবেদন করতেন। তার পর কেন্দ্রীয় অনুমতি সাপেক্ষে সেই ছাড়পত্র দিতেন বইমেলা কর্তৃপক্ষ।
পরিবর্তিত পরিস্থিতি
এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। শেখ হাসিনা পদচ্যুত হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে প্রতিবেশী দেশে।
ড. মুহাম্মদের ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নিপীড়ন বেড়েছে বলে অভিযোগ। বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃংখলা পরিস্থিতি এখনো যথেষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাই জামাত-বিনএপির মতো দলগুলি এ নিয়ে সমালোচনা শুরু করেছে। ভারতবিরোধী প্রচার ক্রমশ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ওপার বাংলার প্রকাশকরা এদেশে কীভাবে আসবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এটাও ষ্পষ্ট নয় যে, বইমেলায় অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রকাশকরা আবেদন করেছেন কি না।
গিল্ডের সদস্য প্রকাশক অপু দে বলেন, “প্রতিবেশী দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে শুধুমাত্র কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার পারে এই ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে। আমরা কোন বাংলাদেশি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। দেখা যাক আগামী দিনে কি পরিস্থিতি তৈরি হয়।”
এপারের আক্ষেপ
বাংলাদেশের উপস্থিতি ঘিরে অনিশ্চয়তার ফলে একটু মন খারাপ এপারের সাহিত্যপ্রেমীদের। বইমেলায় ছাপার অক্ষরে দেখা মিলবে না হুমায়ুন আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নির্মলেন্দু গুণ, সেলিনা হোসেনের।
শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক পবিত্র সরকার বলেন, “এটা আমার খুব দুর্ভাগ্যজনক মনে হয়। শুধু ভাষার জন্য নয়, সাহিত্যেরও মিল আছে দুই বাংলার। হাজার বছরের পুরোনো সে ঐতিহ্য। বাংলাদেশের বইয়ের চাহিদা আছে পশ্চিমবঙ্গে। বৎসরান্তে মানুষ কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশ ষ্টলের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করত। সেসব এবার হবে না ভেবে মন খারাপ হচ্ছে।”
প্রখ্যাত সাহিত্যিক অমর মিত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, “আমি বাংলাদেশ স্টলে যেতাম। বাংলাদেশের অনুবাদ বইগুলো খুবই ভালো লাগে। সেগুলো সংগ্রহও করতাম। এতে পাঠকদের ক্ষতি হল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। আপনি কষ্ট পেতে পারেন, দুঃখ পেতে পারেন, কিন্তু করার তো কিছু নেই। বইমেলা দিয়ে দুই বাংলার যদি মিলনের একটা জায়গা থাকতো তাহলে খুব ভালো হতো!”
ভিসার ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা আছে বলে মনে করছেন অনেকে। জনপ্রিয় সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, “ভিসার ব্যাপারে এখন কড়াকড়ি চলছে। মেলার সময় বইয়ের স্টলের জন্য অনেক লোকজন আসেন বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন হয় একটা। প্রায় ৬০-৭০ প্রকাশক আসেন। প্রত্যেক প্রকাশকের সঙ্গে ছয়-সাতজন করে কর্মী, আধিকারিক আসেন। ফলে ভিসা না দেওয়া অন্যতম একটা বড় কারণ।”
বাংলাদেশের প্রকাশকদের স্টল না থাকলেও সেদেশের বই অবশ্য মিলবে মেলায়। কলকাতার একাধিক প্রকাশক ও পরিবেশক ওপারের বই ভারতে বিক্রি করেন সারা বছর।
অপু বলেন, “জনপ্রিয় বাংলাদেশি লেখকদের সাহিত্যকর্ম পাঠকদের কাছে পৌঁছবে ভারতীয় প্রকাশনা সংস্থার হাত ধরে। তাদের স্টল মেলায় থাকবে।”
ডিডাব্লিউ ডটকম
Leave a Reply