অমিতাভ ভট্টশালী
কলকাতা লাগোয়া দমদমের বাসিন্দা তুহিন ভট্টাচার্য আমাকে বছর কয়েক আগে নিয়ে গিয়েছিলেন তার বাড়ির কাছে সেই রেললাইনের ধারে, যেখানে তিনি ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলেন।
মি. ভট্টাচার্য তার আগে আরও দুবার চেষ্টা করেছেন নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার। পারেন নি। ফিরে এসেছেন প্রতিবারই।
“বৈবাহিক জীবনের সেই চরম অশান্ত সময়ে আমি পাশে পেয়েছিলাম দুজন নারীকে। একজন আমার মা, আরেকজন আমার দিদি। আর আরও পরে পেয়েছিলাম নন্দিনী দি-কে,” বলছিলেন মি. ভট্টাচার্য।
এই ‘নন্দিনী-দি’ হলেন নন্দিনী ভট্টাচার্য, অল বেঙ্গল মেনস্ ফোরামের প্রধান। একজন নারী হয়েও তিনি পুরুষদের অধিকারের লড়াই লড়ছেন অনেক বছর ধরে।
“নন্দিনীর মতো বিভিন্ন দেশের ১৪জন নারীকে বিশ্ব পুরুষ দিবসের ‘দূত’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জেরোম তিলকসিং।
অধ্যাপক তিলকসিংয়ের উদ্যোগেই সেই ১৯৯৯ সাল থেকে ১৯শে নভেম্বর দিনটি ‘বিশ্ব পুরুষ দিবস’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। তাকেই মনে করা হয়ে থাকে সারা বিশ্বে পুরুষদের অধিকার আন্দোলনের অভিভাবক।
তিনি বলছিলেন, “গত ২৫ বছর ধরে বিশ্ব পুরুষ দিবস চেষ্টা করে আসছে পুরুষরা যাতে বিভিন্ন ধরণের বাধা অতিক্রম করতে পারেন,মানসিক আঘাত সামলিয়ে উঠতে পারেন। যে সব পুরুষ একা বা প্রান্তিক বোধ করেন, তাদের পাশে আমরা নানা ভাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে থাকি।
“দু:খজনক হলেও এটা ঘটনা যে বিশ্ব পুরুষ দিবসটি কিন্তু জাতি সংঘের কোনও স্বীকৃতি পায় নি। আমরা একাধিকবার চেষ্টা করেছি। বিশ্ব নারী দিবস স্বীকৃতি পেলেও আমরা কোনও স্বীকৃতি পাই নি,” বলছিলেন অধ্যাপক তিলকসিং।
পুরুষ আন্দোলনের তিন নারী : বাঁদিক থেকে দীপিকা, নন্দিনী, রোজম্যারি
নারীরা যখন ‘পুরুষ-অধিকার’ আন্দোলনে
কিনিয়ার পুরুষ অধিকার আন্দোলনের অন্যতম মুখ রোজম্যারি মুথোনি কিনুথিয়া।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আফ্রিকান বয় চাইল্ড নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক তিনি।
নাইরোবি থেকে বিবিসি বাংলাকে মিজ. কিনুথিয়া বলছিলেন, “আমার ছোটবেলা কেটেছে বাবা আর দুই ভাইয়ের সান্নিধ্যে। মা অন্য জায়গায় থাকতেন। যে অঞ্চলে আমি বড় হয়েছি, সেটা নানা ধরণের অপরাধমূলক কাজের জন্য কুখ্যাত ছিল।
“আমারা বাবা মারা যান ২০১৬ সালে। কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পরে তাকে যে মানসিক অশান্তির মধ্যে দিয়ে হয়েছে, সেটা আমি দেখেছি কাছ থেকে। আফ্রিকায় পুরুষরা তো কখনও মুখ ফুটে বলে না তাদের মানসিক যন্ত্রণার কথা। তাই বাবা চলে যাওয়ার বছরেই আমি ঠিক করি যে পুরুষদের জন্য কিছু করতে হবে আমাকে। চাকরি ছেড়ে দিই আমি,” জানাচ্ছিলেন মিজ. কিনুথিয়া।
দিল্লির বাসিন্দা দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজ একজন সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা।
“পুরুষ অধিকার আন্দোলনে আমরা জড়িয়ে পড়া একটা ব্যক্তিগত ঘটনার মাধ্যমে। আমার এক কাজিনের বিয়েটা ভেঙ্গে যায় মাত্র মাস তিনেকের মধ্যে। তার সেই প্রাক্তন স্ত্রী আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে বধূ-নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন। এমন কি আমিও নাকি তাকে নিয়মিত মারধর করতাম, এরকম মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিজ. ভরদ্বাজ।
“আদালতের বাইরে অনেক অর্থ দিয়ে সেই বিষয়টি আমরা মিটিয়ে নিই। ওই মামলার ব্যাপারেই আমি যখন নানা জায়গায় যাতায়াত করি, তখনই বুঝতে পারি যে পুরুষরা যখন নির্যাতনের শিকার হবেন, তাদের জন্য সেরকম কোনও আইনি সুরক্ষাই নেই! সেই থেকেই আমার কাজের শুরু। ‘মার্টার্স অফ ম্যারেজ’ (বিবাহের শহীদ) নামে আমি একটি তথ্যচিত্র তৈরি করি। সেখানে বধূ-নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগে কীভাবে বহু পুরুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে, সেই কাহিনী তুলে ধরেছিলাম,” বলছিলেন দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজ।
“আমি অবশ্য কোনও ব্যক্তিগত ঘটনার কারণে এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি নি,” বলছিলেন অল বেঙ্গল মেনস্ ফোরামের প্রধান নন্দিনী ভট্টাচার্য।
তার কথায়, “আমার চারপাশে সব সময়ে নানা ঘটনা দেখতাম যা থেকে আমার মনে হত যে পুরুষদের অবস্থাটা বেশ সঙ্গিন। প্রথমে তারা তো মা এবং স্ত্রীর চাপে একটা খুব দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় থাকেন। এরপর তার যদি পুত্র সন্তান থাকে, তার বিয়ের পরে যখন সেই পুরুষটি শ্বশুর হন, তখন নিজের স্ত্রী এবং পুত্রবধূর চাপ পড়ে পরিবারের প্রধান পুরুষটির ওপরে।
“অনেক ক্ষেত্রেই যেন বিনা দোষে দোষী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় পুরুষদের। যেমন ভিড় বাসে যদি ঝাঁকুনির কারণেও কোনও নারীর গায়ে ছোঁয়া লাগে, তাহলে তিনি ভেবে নেবেন যে পুরুষটি তার শরীর ছুঁতে চাইছেন। অফিসে কোনও নারীকে যদি কিছু বলেন আমি এটাই দেখে এসেছি যে পুরুষটি জনরোষের শিকার হয়ে যান। ভীষণ একপেশে মনে হত ব্যাপারটা। সমাজে, চারপাশে এগুলো দেখতে দেখতেই আমার পুরুষ অধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া,”বলছিলেন নন্দিনী ভট্টাচার্য।
জাতি সংঘের স্বীকৃতি না পেলেও ২৫ বছর ধরে ১৯শে নভেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব পুরুষ দিবস
নারী হয়েও কেন পুরুষদের জন্য লড়াই?
তথ্যচিত্র নির্মাতা ও ভারতে পুরুষ অধিকার আন্দোলনের অন্যতম মুখ দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজ বলছিলেন, “আমি ২০১২ সালে প্রথম কাজ করতে শুরু করি পুরুষদের অধিকার নিয়ে, তখন অনেকেই আমাকে এই কথাটা জিজ্ঞাসা করতেন যে একজন নারী হয়ে আমি কেন পুরুষদের হয়ে লড়ছি। এখন অবস্থাটা অনেকটা বদলিয়েছে। কিন্তু এখনও আমার মতো কেউ পুরুষদের অধিকার নিয়ে কথা বলছে, এমন নারীর সংখ্যা আপনি হাতে গুনতে পারবেন।“
তবে তিনি এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে বহু পুরুষও কিন্তু দশকের পর দশক ধরে নারী-অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন, আন্দোলনে নেমেছেন, বলছিলেন মিজ. ভরদ্বাজ।
তার কথায়, “কোনও নারীর ওপরে নির্যাতন হলে যেমন বহু পুরুষ এগিয়ে এসেছেন, তেমনই কোনও পুরুষের ওপরে নির্যাতন হলে এগিয়ে আসা, প্রতিবাদ করা তো নারী হিসাবে আমাদেরও কর্তব্য।“
এই একই ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে অন্যান্য নারীদেরও, যারা পুরুষ অধিকার আন্দোলনে এগিয়ে এসেছেন।
কেনিয়ার রোজম্যারি কিনুথিয়া বলছিলেন, “এবছরের বিশ্ব পুরুষ দিবস উপলক্ষে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একটা ভাষণ আছে ১৯শে নভেম্বর। সেটার পোস্টার আমি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করতেই নারীবাদীরা আমাকে সাংঘাতিক ট্রল করতে শুরু করলেন। তারা প্রশ্ন তুললেন যে একজন নারী হয়ে আমি কীভাবে পুরুষদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারি! পুরুষদের ব্যাপারে আমি কীইবা বুঝি! অথচ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীরা নন, পুরুষরাই আমাকে ভাষণ দেওয়ার জন্য ডেকে নিয়েছিলেন।“
বিশ্ব পুরুষ আন্দোলনের প্রধান অভিভাবক অধ্যাপক জেরোম তিলকসিং বলছিলেন, “আমাদের সঙ্গে নারীদের তো কোনও বিরোধ নেই! নারী-পুরুষ মিলেই তো একটা পরিবার। ক্যান্সার আক্রান্ত কোনও পুরুষকে তো তার স্ত্রী বা বোনই কিমোথেরাপি দিতে নিয়ে যান! আবার তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটানো কোনও পুরুষকে তো একজন নারী – তিনি স্ত্রী অথবা বান্ধবী যে কেউ হতে পারেন, তিনিই তো সঙ্গ দেন!”
এই প্রতিবেদন যার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই তুহিন ভট্টাচার্যের পাশে তো তার মা আর দিদিই দাঁড়িয়েছিলেন!
“সারা বিশ্বে পুরুষদের বিপক্ষে, একপেশে যে ভাবনাটা, যে ব্যবস্থাটা তৈরি হয়েছে, প্রশাসনিক বলুন বা আইনি – আমরা সেটা বদলাতে চাইছি। নারী-পুরুষ উভয়ের লিঙ্গ-সমতার ভিত্তিতে যাতে একটা সমাজ গড়ে তোলা যায়, একটা সুস্থ পরিবার গড়ে তোলা যায়, আমরা সেটা চাইছি,” জানাচ্ছিলেন জেরোম তিলকসিং।
মিথ্যা বধূ-নির্যাতনের মামলায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের নিয়েই তথ্যচিত্র বানিয়েছেন দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজ
নানা দেশে যেভাবে ‘পুরুষ নির্যাতন’
“কত পুরুষ যে তার স্ত্রী বা প্রেমিকার হাতে খুন হন অথবা নারীরা তার ‘অবৈধ’ প্রেমিকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে স্বামী বা প্রেমিককে খুন করেন, বাড়িতে নিভৃতে মার খান স্ত্রীর কাছে, মানসিক নির্যাতনের শিকার হন, সেই হিসাবই পাবেন না আপনি ভারতে। এখানে লিঙ্গ-ভিত্তিক অপরাধের যে তথ্য রাখা হয়, সেখানে নারীদের ওপরে কী কী অপরাধ সংগঠিত হল, তার সংখ্যা পাবেন। কিন্তু পুরুষরা যখন কোনও অপরাধের শিকার হন, সেটার লিঙ্গ ভিত্তিক পরিসংখ্যান আর আলাদাভাবে রাখা হয় না,“ বলছিলেন দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজ।
ভারতে ধর্ষণের শিকার হওয়া এবং অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের সংখ্যা বিশাল। তবে একটা বড় সংখ্যার পুরুষের বিরুদ্ধেও ধর্ষণ এবং বধূ-নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হয়ে থাকে। তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারিভাবে পাওয়া যায় না, তবে নানা সময়ে এইসব মিথ্যা অভিযোগের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। মিজ. ভরদ্বাজ বা নন্দিনী ভট্টাচার্যদের মতো পুরুষ অধিকার কর্মীরা এমন একাধিক ঘটনা সামনে এনেছেন।
আবার কেনিয়ার পুরুষ অধিকার আন্দোলনের নেত্রী রোজম্যারি কিনুথিয়া বলছিলেন, “আফ্রিকার পুরুষদের সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে তারা চিরাচরিতভাবে নিজেদের শক্তিশালী হিসাবে মনে করে এসেছে। তাদেরই দায়িত্ব নারীদের রক্ষা করা – এমন একটা ভাবনা সবারই আছে। কিন্তু সেই পুরুষই যে স্ত্রী বা প্রেমিকার হাতে ঘরের ভেতরে মার খাচ্ছে, এটা লজ্জায় তারা বলতে পারে না।
“পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বহু পুরুষ এখন আর বিয়েই করতে চাইছেন না। কেনিয়াতে তাই একাকী-মায়ের সংখ্যাটা বিশাল। আবার কারাগারগুলো উপচিয়ে পড়ছে, বহু পুরুষ মানসিক অবসাদের কারণে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে – তাদের জেল হচ্ছে,” জানাচ্ছিলেন মি. কিনুথিয়া।
‘সমাজের সেরা পুরুষ’ পুরস্কার চালু করেছে নন্দিনী ভট্টাচার্যের অল বেঙ্গল মেনস্ ফোরাম
পৌরুষের অহংকার
এই প্রতিবেদনের জন্য পুরুষ-অধিকার আন্দোলনের যেসব নারী কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা, সবার ক্ষেত্রেই একটা বিষয় উঠে এসেছে যে নির্যাতনের কথা শিকার করতে পৌরুষে বাধে।
অল বেঙ্গল মেনস্ ফোরামের প্রধান নন্দিনী ভট্টাচার্য বলছিলেন, “কোনও একজন নারীকে যদি কোনও পুরুষ সহকর্মী আদিরসাত্মক মেসেজ পাঠান, তাহলে তা নিয়ে যেরকম শোরগোল পড়ে যায়, একজন নারী সহকর্মী যদি একই ধরনের মেসেজ পাঠান কোনও পুরুষ সহকর্মীকে, তাহলে কী সেই পুরুষটি অন্যদের বলতে যাবেন? কোথাও অভিযোগ জানাতে যাবেন? কখনই না।
“ব্যাপারটা জানাজানি হলে অন্য পুরুষ সহকর্মীরা হয়তো মস্করা করবেন। কিন্তু তিনি তো ব্যাপারটা উপভোগ নাই করতে পারেন! তাই বিষয়টা চেপে যান একজন পুরুষ। তার পৌরুষে হয়তো কোথাও লাগে। তবে পুরুষেরও যে সম্ভ্রম আছে, তারও যে সম্ভ্রমহানি হতে পারে, সেটা তো কেউ ভাবেনই না।,” বলছিলেন মিজ. ভট্টাচার্য।
দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজ উদাহরণ দিচ্ছিলেন ভারতের পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার প্রশ্নাবলীর।
ওই সমীক্ষায় পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য প্রশ্ন থাকে যে ‘আপনার স্বামী মারধর করেন কী না। আবার আপনি স্বামীকে মারধর করেন কী না, সেটাও জানতে চাওয়া হয়। তবে পুরুষদের জন্য কিন্তু প্রশ্নটা থাকে না যে আপনি স্ত্রীর হাতে মার খান কী না!
মিজ. ভরদ্বাজ বলছিলেন যে কোনও পুরুষ এই তথ্য দিতে চান না যে তিনি স্ত্রীর হাতে মার খেয়েছেন, তবে অনেক নারী কিন্তু ওই প্রশ্নের জবাবে বলেন যে তিনি তার স্বামীকে মারধর করেন।
কেনিয়ার মিজ. কিনুথিয়াও বলছিলেন যে আফ্রিকায় চিরাচরিতভাবে যে ধারণা রয়েছে যে পুরুষরাই নারীদের রক্ষাকর্তা, তারাই শক্তিমান, সেই জায়গাটা থেকে সরে এসে কী করে একজন পুরুষ স্বীকার করবেন যে তিনি স্ত্রী বা প্রেমিকার দ্বারা নির্যাতিত হন!
জেরোম তিলকসিংকে মনে করা হয় বিশ্ব পুরুষ আন্দোনের অভিভাবক
পুরুষ-নারী অধিকার আন্দোলন কি সাংঘর্ষিক?
আফ্রিকার পুরুষ অধিকার আন্দোলনের রোজম্যারি কিনুথিয়া বলছিলেন যে নারীবাদী এবং নারী আন্দোলনের কর্মীরা তাকে রীতিমতো ‘ঘৃণা’ করেন।
বিশ্ব পুরুষ দিবসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক জেরেমি তিলকসিং-ও বলছিলেন যে তাদের আন্দোলন নিয়ে নারীবাদীদের প্রবল সমালোচনা শুনতেই হয়।
তার কথায়, “নারীবাদীরা মনে করেন যে আমাদের দাবিগুলোর সঙ্গে তাদের চিন্তাধারার সংঘর্ষ আছে। কিন্তু ব্যাপারটা তো তা নয়। আমরা তো নারীদের বিরোধিতা করছি না। আমরা চাইছি লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতে সমাজ গড়ে উঠুক, একটা সুস্থ পরিবার গড়ে উঠুক।“
তবে ভারতের নারী আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে পুরুষ অধিকার আন্দোলনের সম্পর্কটা অতটা সাংঘর্ষিক নয় বলেই দাবি করছিলেন নন্দিনী ভট্টাচার্য।
“অন্তত এখানে যারা নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সঙ্গে আমার ভীষণ সুসম্পর্ক আছে। আমরা একসঙ্গে বহু অনুষ্ঠানে, সেমিনারে বক্তব্য রাখি। নারীদের জন্য ভারতে তো বটেই, সারা বিশ্বেই এখনও অনেক কিছু করা বাকি আছে। তবে পুরুষদের জন্য তো কিছুই নেই, তাদের জন্য তো কাজ একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। তাই নারী আন্দোলন কর্মীদের সঙ্গে আমাদের কোথাও কোনও বিরোধ নেই। তাদেরটা তাদের আন্দোলন, আমাদের লড়াইটা আমাদের,” বলছিলেন নন্দিনী ভট্টাচার্য।
তিনি এও বলছিলেন যে নারী আন্দোলনের কর্মীরাও এখন ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেছেন লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতেই আইনি ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।
তবে কী বলছেন নারী আন্দোলনের কর্মীরা? তারা কি চোখে দেখেন পুরুষ অধিকার আন্দোলনকে?
পশ্চিমবঙ্গের নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী শাশ্বতী ঘোষের কথায়, “নারী হোন বা পুরুষ, যে কোনও অধিকার আন্দোলনকেই আমি সমর্থন করি। যেকোনও গোষ্ঠীই বঞ্চিত বা নির্যাতিত হলে তাদের আন্দোলনকে স্বাগত। তবে যে বিষয়টা তারা তুলে ধরেন যে সব আইনগুলোই নারীদের দিকে, সে ব্যাপারে আমার কিছু বক্তব্য আছে।
“সেই আইনগুলোর প্রয়োগ যারা করছেন, তারা কিন্তু মনে করেন না যে নারীদের সব অধিকার দিয়ে দেওয়া উচিত। মানবাধিকার সচেতন বিচারপতি হিসাবে যিনি বিখ্যাত, সেই ভি আর কৃষ্ণ আয়ারের মতো মানুষও মন্তব্য করেছিলেন যে পরিবারের মধ্যে, বাড়ির ভেতরে সাংবিধানিক সমতা চলতে পারে না। তার মতো মানুষ যখন এধরনের মন্তব্য করেন, ঘটনাচক্রে যিনি একজন পুরুষ, তাহলে তো সাধারণ পুরুষরা ভেবেই নেবেন যে নারীদের বাড় বেড়েছে, তাদের অধিকার থাকা উচিত নয়,” বলছিলেন শাশ্বতী ঘোষ।
তবে পুরুষ অধিকার ও নারী অধিকার আন্দোলন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে বলে তিনি মনে করেন না।
তার কথায়, “এখানে কোনও সংঘর্ষ আছে বলে আমি মনে করি না। তাতে অকারণ শক্তি ক্ষয় হবে। আমরা যাতে সবাই সমান অধিকার পেতে পারি, সেটা তুলে ধরা দরকার। আবার অধিকারের সঙ্গেই দায়িত্বটাও চলে আসে। আমি যেমন অধিকার চাইব, তেমনই দায়িত্বও নিতে হবে। যদি অধিকার আর দায়িত্ব দুটোই সমান ভাবে ভাগ করে নিতে পারি আমরা, তাহলে নারী ও পুরুষ অধিকার আন্দোলনের মুখোমুখি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি না।দুটোই পরস্পরের পরিপূরক।“
বিশ্ব পুরুষ দিবসের প্রাক্কালে জেরোম তিলকসিংও বলছিলেন যে নারী-পুরুষ উভয় মিলেই লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতে আগামী দিনে একটা স্বাভাবিক সমাজ গড়ে উঠুক।
বিবিসি নিউজ বাংলা, কলকাতা
Leave a Reply