হারুন উর রশীদ স্বপন
মৃত হৃদয় রবিদাসের শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন চিকিৎসক দেখেছেন, পরিবারের সদস্যরাও দেখেছেন ৷ কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য এবং সেনাক্যাম্পের অধিনায়ক বলছেন হৃদয়কে তারা স্পর্শই করেননি৷
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে হৃদয় রবি দাস নামের এক তরুণকে প্রথমে আটক করে পেটানো হয় বলে অভিযোগ৷ তারপর নিয়ে যাওয়া হয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে৷ সেখান থেকে শুক্রবার দিবাগত গভীর রাতে হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়৷ সোমবার বিকাল পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি৷
২১ বছর বয়সি হৃদয় করিমগঞ্জ উপজেলার নোয়াবাদ ভূঁইয়া বাজার এলাকায় একটি সেলুনে নরসুন্দরের কাজ করতেন৷ একই এলাকার এক মুসলিম এতিম কিশোরীর সঙ্গে প্রেম করেন এই অভিযোগে শুক্রবার সন্ধ্যায় তাকে ও তার চাচাতো ভাই শাকিল রবি দাসকে ওই সেলুন থেকে বাজারের ক্লাব ঘরে ডেকে নেয়া হয় ৷ সেখানে নোয়াবাদ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, মেম্বার জাহাঙ্গীর আলম বাজার কমিটির সভাপতি মঞ্জিল মিয়াসহ ১০-১৫জন উপস্থিত ছিলেন৷ স্থানীয় কয়েকটি মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার কিছু লোকও সেখানে ছিলেন৷দাবি করা হয়, ‘স্থানীয় লোকজনের অসন্তোষের’ কারণে হৃদয় এবং শাকিল রবিদাসকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখান থেকে রাতে ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বার ও তিনজন গ্রাম পুলিশের সহায়তায় হৃদয় ও শাকিলকে কয়েক কিলোমিটার দূরে সেনা ক্যাম্পে পাঠান৷ গভীর রাতে ক্যাম্প থেকে হৃদয়কে আহত অবস্থায় কিশোরগঞ্জের আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখানে হৃদয় মারা যান৷
হৃদয়ের বড় ভাই বিজয় রবি দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হৃদয়ের সঙ্গে চাচাতো ভাই শাকিল রবি দাসও ছিল৷ আমি ঘটনার সময় ছিলাম না৷ সে-ই সব কিছু জানে৷ আমি তার কাছ থেকে শুনেছি, তাদের প্রথমে সেলুনে ঢুকে কয়েকজন হুজুর মারধর করে৷ তারপর বাজারের ক্লাবঘরে নিয়ে যায়৷ সেখানেও মারধর করা হয়৷ ওই সময় সেখানে চেয়ারম্যান মোস্তফা ও মেম্বার জাহাঙ্গীর ছিলেন৷ পরে তারাই সেনা ক্যাম্পে খবর দেয়৷ তবে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আসেননি৷ চৌকিদারদের সহায়তায় চেয়ারম্যান ও মেম্বার তাকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়৷”
‘‘ক্যাম্পে নেয়ার পর আমার ভাইয়ের অবস্থা গুরুতর হয়৷ তারা আমার ভাইকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠায়৷ শনিবার ভোরে আমাদের মৃত্যুর খবর জানানো হয়,” জানান তিনি৷
শাকিল রবিদাসও আহত হয়েছেন৷ তবে তাকে হাসাপাতালে পাঠানো হয়নি৷তিনি এখন বাসায় অবস্থান করছে৷তবে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি৷ হৃদয়ের মৃত্যুর পর একাধিক সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেছেন, “শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টায় দুজন মিলে একসঙ্গে বাড়ি থেকে নোয়াবাদ এলাকার ভূঁইয়া বাজারে যাই৷ সেখান থেকে বাজারের ক্লাবে আমাদের দু-তিনজন ধরে নিয়ে যায়৷ নোয়াবাদ ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর মিয়া, বাজার কমিটির সভাপতি মঞ্জিল মিয়া এবং মুসলিম কিশোরীর দুই-তিনজন স্বজন উপস্থিত থেকে আমাদের মুঠোফোন কেড়ে নেয় এবং নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে মারপিট করে৷ ঘণ্টাখানেক পর তিনজন চৌকিদার, একজন স্থানীয় লোকসহ আমাদের অটোরিকশায় করে সেনাক্যাম্পে পাঠায়৷ অটোরিকশায় করে নিয়ে যাওয়ার সময়ও মারধর করা হয় আমাদের৷ সেনাক্যাম্পে গেলে হৃদয়কে এক কক্ষে ও আমাকে আরেক কক্ষে রাখা হয়৷ হৃদয়ের কক্ষে কী ঘটনা ঘটেছে আমি জানতে পারিনি৷ পরে রাত দুইটার দিকে দেখি হৃদয়কে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাচ্ছে৷ সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে হৃদয় মারা যায়৷”
নোয়াবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. জাহাঙ্গীর আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওই দুইজনকে কিছু লোক যখন আটক করে, তখন আমি সেখানে ছিলাম না৷ আমি শুনে সেখানে যাই৷ গিয়ে দেখি তাদের বাজারের ক্লাব ঘরে রাখা হয়েছে৷ সেখানে মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার লোকসহ বেশ কয়েকজন তাকে একটি মুসলিম এতিম মেয়ের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে জ্ঞিাসাবাদ করছে৷ সম্পর্কের কথা সে স্বীকার করে৷ তার মোবাইল ফোন থেকে কিছু রোকর্ডও পাওয়া যায়৷ সে ওই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ারও পরিকল্পনা করেছিল৷ এজন্য একটি সংগঠন তাকে সহায়তা করবে৷ তাদের কাছে সে পাঁচ হাজার টাকাও চায়৷ পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনজন গ্রাম পুলিশ এনে তাদের একটি অটো রিকশায় করে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাই৷ আমি চেয়ারম্যানের মোটরসাইকেলে সেখানে যাই৷ রাত আটটার দিকে আমরা ওই দুইজনকে ক্যাম্পে হস্তান্তর করি৷”
‘‘আমরা ক্যাম্পের বাইরেই অবস্থান করি৷ রাত দুইটার দিকে শাকিলকে বাইরে নিয়ে আসে৷ তখন সে হাঁটতে পারছিল না৷ মারধর করেছে মনে হয়৷ এরমধ্যে তাদের বাবা-মাও আসে৷ শাকিলকে তারা ছেড়ে দেয়ার কথা বলে৷ হৃদয় তখনো ভিতরে ছিল৷ এরপর থানা থেকে পুলিশ এলো৷ পুলিশকে একটি কাগজে সই করতে বললে পুলিশ সই করেনি৷ এটা নিয়ে সেনা সদস্যদের সাথে পুলিশের কথা কাটাকাটি হয়৷ পুলিশ তখন হৃদয়কে না নিয়েই চলে যায়৷ এরপর সেনা বাহিনী তাদের একটি গাড়িতে পাজাকোলা করে হৃদয়কে তোলে৷ তাকে প্রথমে করিমগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে নেয়া হয়৷ গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় ওই হাসপাতাল তাকে না রাখায় পরে কিশোরগঞ্জ আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়৷ পরের দিন শুনলাম হৃদয় মারা গেছে৷”
শাকিল রবিদাস কয়েকদফা মারধরের কথা বললেও মো. জাহাঙ্গীর আলমের দাবি, ‘‘না আমাদের সামনে ক্লাবঘরে যখন ছিল, তখন ওই দুইজনকে কোনো মারপিট করা হয়নি৷ তাদের কোনো ধরনের টাচ করা হয়নি তখন৷ আমরা যখন তাদের সেনা ক্যাম্পে দিয়ে আসি, তখন তারা সুস্থ এবং স্বাভাবিক ছিল৷”
নোয়াবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাকে মেম্বার ফোন করে সেখানে ডেকে নিয়ে যায়৷ শুরুতে আমি ছিলাম না৷ আমি গিয়ে দেখি ওই মেয়েটিকেও সেখানে আনা হয়েছে৷ সে-ও হৃদয়ের সঙ্গে প্রেমের কথা স্বীকার করে৷”
‘‘জিজ্ঞাসাবাদে আমাদের মনে হয় হৃদয় পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে৷ ওই রাতেই মেয়েটিকে নিয়ে তার চলে যাওয়ার কথা ছিল৷ ফলে আমি নিজেই সেনা ক্যাম্পে খবর দিই৷ তারা আমদের নিয়ে যেতে বললে গ্রাম পুলিশের সহায়তায় দুইজনকে ক্যাম্পে নিয়ে যাই৷ আমরা ক্যাম্পের বাইরেই ছিলাম৷ একবার ভিতরে যাই হৃদয়ের মোবাইল ফোনটি ভিতরে সেনা সদস্যদের দিয়ে আসার জন্য৷ রাত দুইটার দিকে পুলিশ আসে৷ কিন্তু পুলিশ হৃদয়কে নেয়নি৷ পরে সেনাবাহিনী তাকে হাসপাতালে পাঠায়৷ আমি বাসায় চলে যাই৷ বাসায় যাওয়ার পরই ক্যাম্প থেকে ফোন দিয়ে আমাকে কিশোরগঞ্জ আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলা হয়৷ ভোর রাত চারটার দিকে গেলে আমাকে জানানো হয় হৃদয় মারা গেছে৷ সেখানে তখন কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন৷”
হৃদয় ও শাকিলকে আটকের সময় এবং ক্লাব ঘরে তাদের মারপিট করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘কেউ তাদের গায়ে একটা টাচও করেনি৷ আমি এসে অক্ষত অবস্থায় তাদের ক্লাব ঘরে পেয়েছি৷ তারা তখন কথা বলছিল৷ অক্ষত অবস্থায়ই সেনা ক্যম্পে হস্তান্তর করি৷”
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যের দাবি তাদের উপস্থিতিতে হৃদয়কে ‘কেউ টাচ করেনি’, তারা এ-ও জানিয়েছেন পুলিশ তাকে নেয়নি, তাই এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্যও জানার চেষ্টা করেছে ডয়চে ভেলে৷
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ সেনাক্যাম্পের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজুল করিমেরও দাবি, সেনাক্যাম্পেও হৃদয়কে শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বাইরে তাদের কী করা হয়েছে তা আমরা জানি না৷ তবে তাকে আমরা সাধারণভাবেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছি৷ সে ওই মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের কথা স্বীকারও করেছে৷ মেয়েটিকে নিয়ে গিয়ে তার অন্য ধরনের একটা প্ল্যান ছিল৷ এটা বড় কেস, তাই আমরা পুলিশকে খবর দিলাম৷ তাদের আসতে বেশ রাত হয়৷ পুলিশের গাড়িতে তোলার সময় সে পড়ে যায়৷ তখন পুলিশ জানায়, তার শরীর খুব খারাপ, তারা নেবে না৷ আমরা তখন আমাদের গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাই৷ হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান তার হার্ট ফেইলিউর হয়েছে৷ সে ড্রাগ-ট্রাগ খায় সে কারণেও এটা হতে পারে৷ মুখে গন্ধ ছিল৷ সাদা ফেনা ছিল৷ রিপোর্টে সেরকমই বলা হয়েছে৷ হতে পারে সে ক্যাম্পে আসার পর পুলিশের হাতে তুলে দেয়া দেখে ভয় পেয়ে পড়ে যায়৷ তবে ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে৷”
সেনা কর্মকর্তা রিয়াজুল করিমের আরো দাবি,‘‘ক্যাম্পে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি৷ সে জিজ্ঞাসাবাদের জবাব স্বাভাবিকভাবেই দিয়েছে৷ তাকে পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভারের প্রস্তুতির সময়ও সে কাগজে সই করে বলেছে, ‘আমি সুস্থ, স্বাভাকি আছি৷’ তারপরে কী হলো বুঝতে পারছি না৷ তবে এটাই এখন বিষয় যে, সে আমাদের হেফাজতে ছিল৷”
এই ঘটনায় মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে করিমগঞ্জ থানার ওসি শাহাব উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখনো মামলা হয়নি৷ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে৷ তবে আমরা একটা জিডি করেছি৷”
তিনি জানান, ‘‘ময়না তদন্ত হয়েছে৷ এখনো প্রতিবেদন পাইনি৷ সুরতহালও হয়েছে৷ ততে কী আছে আমি বলতে পারবো না৷”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,” ওই দিন রাতে হৃদয়কে সেনা কাম্প থেকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে চেয়েছিল৷ তবে সে অসুস্থ থাকায় আমরা তাকে নেইনি৷”
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, এমনকি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজুল করিমও হৃদয়কে কোনো মারধর করা হয়নি বলে দাবি করলেও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের করিমগঞ্জ উপজেলা সভাপতি প্রাণতোষ সরকার টিংকু বলেন,” আমি হাসপাতালে গিয়ে হৃদয়ের লাশ দেখি৷ তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছিল৷”
তিনি মনে করেন,” একটি মুসলিম মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে৷”
হৃদয়ের বড় ভাই বিজয় রবি দাস বলেন,” ওই সম্পর্কের কথা আমাদেরও বলা হয়েছে৷ তবে আগে আমরা কিছু জানতাম না৷”
“আমরা এখনো মামলা করিনি৷ সবার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করবো৷ আমাদের বলা হয়েছে ময়না তদন্ত প্রতিবেদন আসুক তারপর দেখা যাবে.” বলেন তিনি৷
ঘটনার রাতে আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, “রাত সোয়া দুইটার দিকে সেনাসদস্যরা হৃদয়কে নিয়ে হাসপাতালে আসেন৷এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘণ্টাখানেক পর মারা যান৷ হৃদয়ের শরীরে মারধরের চিহ্ন ছিল৷”
মানবাধিকার কর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন,” এটা পরিস্কার যে হৃদয় সেনা হেফাজতে মারা গেছে৷যাদের হেফাজতে মারা গেছে তাদের দায়-দায়িত্ব৷ আর শুক্রবার গভীর রাতের ঘটনায় এখনো মামলা না হওয়া দুঃখজনক৷ কিছুই ঠিক হচ্ছে না৷ আগের মতোই চলছে৷”
“আমি দ্রুত মামলা ও তদন্ত করে দায়ীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি৷”
ডিডাব্লিউ ডটকম
Leave a Reply