হারুন উর রশীদ স্বপন
“আগে যে আইন ছিল তা মানুষকে হয়রানির জন্য ব্যবহার করা হতো। ওই আইন ছিল ক্ষমতাবানদের দমন-পীড়নের হাতিয়ার। এবার সেটা না হয়ে যদি সত্যিকারের সুরক্ষার আইন হয় তাহলে আমরা খুশি হবো,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “আগের আইনের যারা শিকার হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপুরণ ও যারা এর অপব্যবহার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি আমাদের।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)-র আরেক শিকার দিদারুল ভুঁইয়া। তিনি ২০২০ সালে গ্রেপ্তার হয়ে পাঁচ মাস জেলে ছিলেন। চৌধুরী নাফিজ শারাফাতের নানা অপকর্ম এবং করোনা সংস্ক্রান্ত সঠিক তথ্য প্রকাশের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকায় তাকে ওই আইনের মামলায় আটক করা হয়েছিল বলে অভিযোগ।
তিনি বলেন, “ডিএসএ ভিক্টিম নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে আমাদের সুনির্দিষ্ট চারটি দাবি আছে। ডিএসএসহ নিবর্তনমূলক আইনে যারা এখনো আটক আছেন, তাদের মুক্তি দিতে হবে। যারা মিথ্যা মামলা করেছে, তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিচার ও শাস্তি (হতে হবে)৷ নতুন আইন যাতে সরকার একতরফাভাবে করতে না পারে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে (তা নিশ্চিত) করতে হবে। আর এই ধরনের আইন করতে গণভোটের ব্যবস্থা করতে হবে।”
” নতুন যে ডিজিটাল সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে, তাতে অবশ্যই মিথ্যা ও হয়রানিমূললক মামলার ব্যাপারে শাস্তির বিধান রাখতে হবে,”বলেন তিনি।
তিনি জানান, তাদের জানা মতে এখন ডিএসএ অ্যাক্টে গ্রেপ্তার হয়ে কেউ আর কারাগারে নেই।
কেমন আইন চাই
ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সাইবার সিকিউরিটি আইনের বড় সমালোচনা হলো, এই আইন মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও কন্ঠরোধ করতে ব্যবহার করা হয়েছে। আর সাংবাদিকরা সঠিক খবর পরিবেশন করলেও মানহানির অভিযোগে ক্ষমতাসীন ও ক্ষতাবানরা মামলা করে হয়রানি করেছেন। সাধারণ মানুষসহ পেশাজীবীরাও এর শিকার হয়েছেন। এই আইনে অনুভূতি, ধর্মীয় অনুভূতি, মানহানির সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় এর যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে। একজন সাব ইন্সপেক্টর মামলা করতে পারেন, ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারেন। ফলে অপব্যবহার সহজ হয়েছে। অধিকাংশ ধারাই জামিন-অযোগ্য। ফলে আটক হলেই দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়। এছাড়া আইনটিতে সুরক্ষার কোনো বিধান নেই। ফলে হয়রানির প্রতিকার পাওয়া যায় না। ফলে যারা আসলেই সাইবার অপরাধের শিকার, তারা এই আইন থেকে কোনো প্রতিকার পাননি।প্রতিপক্ষকে দমনে ক্ষমতাবানদের হাতিয়ার হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, “নতুন আইনের উদ্দেশ্য হতে হবে যারা সাইবার বিশ্বে অপরাধের শিকার হন, তারা যেন ন্যায় বিচার পান। আর সাইবার বা ইন্টারনেট জগতে যারা কাজ করেন, যারা গ্রাহক, তারা যেন সুরক্ষা পান।”
“সরকারের সমালোচনা করলে হয়রানি করা, সাংবাদিকরা অনুন্ধানী প্রতিবেদন করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা- নতুন আইনে সেই সুযোগ যেন না থাকে।”
তিনি বলেন, “আমাদের সাইবার ট্রাইব্যুনাল মাত্র ছয়টি। ওইসব আদালতে কনভিকশন রেট খুবই কম। অনেক নারী সাইবার অপরাধের শিকার হন। পুরুষরাও (শিকার) হন। তারা যাতে বিচার পান, নতুন আইনে সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে।”
মানবাধিকার কর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, “এই আইনে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করা যায়। জামিন নেই। আর মিথ্যা মামলা হলে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। নতুন আইনে এই বিষয়গুলো দেখতে হবে।”
“আর মানহানি, অনুভূতি এগুলোর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে। তা না হলে অপব্যবহার বন্ধ করা যাবে না,” বলেন তিনি।
তার কথা, ” বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যেন কোনোভাকেই খর্ব না হয় নতুন আইনে। তবে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যেন অন্যের স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব না হয়।”
বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ডিএসএ-র বড় শিকার। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ” নতুন আইনটি নিয়ে আইন উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে বসেছিলেন। আমরা কিছু পরামর্শ দিয়েছি। আমাদের কথা হলো, নতুন আইনে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তারা যেন এই আইনের কারণে হয়রানির শিকার না হন। বাকস্বাধীনতা যেন খর্ব না হয়।” সাংবাদিকের সুরক্ষার পাশাপাশি হলুদ সাংবাদিকতা ও তথ্য সন্ত্রাসের ব্যাপারেও ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, “এই আইনগুলোর মাধ্যমে অনেকে অনেক হয়রানির শিকার হয়েছেন, এটা সত্যি। কিন্তু পাশাপাশি অনলাইনে ছেলে বা মেয়ে যদি হেনস্থার শিকার হন, তাহলে আইন না থাকলে কোথায় যাবেন?”
তার কথা, “প্রথমে জেলায় জেলায় ট্রাইব্যুনাল করতে হবে। এখন বিভাগে আছে। ফলে বাদী ও বিবাদী দুইজনকেই বিভাগে যেতে হয়। এটা বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। কোন বিষয়গুলো মানহানি, তা স্পষ্ট করতে হবে। কোনো সত্য তথ্যকে মানহানির আওতায় রাখা যাবে না। আর এই ধরনের মামলায় হয়রানির প্রতিকার থাকতে হবে। মিথ্যা ও হয়রানিমুলক মামলা হলে কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে তা পরিস্কার থাকতে হবে।”
ডিডাব্লিউ ডটকম
Leave a Reply