রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:২৬ পূর্বাহ্ন

“মাই লাই” ও বাংলাদেশের গণহত্যা এবং আমেরিকা ও পাকিস্তানের মিডিয়ার চরিত্র

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৮.০৯ এএম

স্বদেশ রায় 

১৯ নভেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রিন্ট এডিশনের লীড নিউজ ছিলো ভিয়েতনামের “মাই লাই” হত্যাকান্ডের ওপর। ১৯৬৮ সালে ১৬ মার্চ আমেরিকান সেনাবাহিনী সেখানে যে গণহত্যা ঘটায়- তার ৫৬ বছর পরে আমেরিকার সাংবাদিক সেখানে গিয়ে বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে ও অতীতের সেই স্মৃতি এবং যে দুই একজন সে স্মৃতি এখনও ধারণ করে আছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে এই চমৎকার স্পট রিপোর্ট করেন।

রিপোর্টটি থেকে ভালো লাগে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মিডিয়ার এই বিউটিকে। সত্য হলো, এখন শুধু পশ্চিমা বিশ্বে নয়, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্ডিয়ার মিডিয়াও অনেক সময় তাদের নিজেদের এই অপরাধগুলোর ওপর নিজেরাই সত্য ও নির্মোহ রিপোর্ট করে। মিডিয়ার দায়িত্বের বিশালত্ম নিয়ে লিখতে গেলে সত্যি অর্থে ছোট খাট একটা মহাভারত লিখতে হয়। তবে এই রিপোর্টগুলোর উদ্দেশ্য’র অনেক সুন্দর ডাইমেনশানের মধ্যে সংক্ষেপে যে বিষয়টি- সে দেশের নতুন প্রজম্মের জন্যে সামনে আসে তাহলো, তারা বুঝতে পারে অতীতে তার রাষ্ট্র এমন একটি অন্যায় করেছিলো। নিজের অপরাধ ও অন্যায়কে সামনে আনার অর্থ হলো, ভবিষ্যতে সেটা কমানো এবং নতুন প্রজম্মের মধ্যে মানবাধিকার ও নৈতিকতা জাগানো। মিডিয়া কখনও রাষ্ট্র নয়, রাজনৈতিক দলও নয়- তার অনেক কাজের মধ্যে একটি,বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এমনিভাবে মানুষের মনকে তৈরি করা।

ভিয়েতনামের “ মাই লাই”  হত্যাকান্ড পৃথিবীতে পরিচিত। এবং এই পরিচিত করার পেছনে আমেরিকার মিডিয়ার ভূমিকাও কম নয়। আবার ৫৬ বছর পরে তারা যখন এই গণহত্যার কথা স্মরণ করছে- সে সময়ে ভিয়েতনাম আমেরিকার বন্ধু রাষ্ট্রও। আসলে কোন একটি রাষ্ট্র’র সঙ্গে কোন একটি ঘটনা চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব ও চিরস্থায়ী শক্রতার কারণ হতে পারে না। রাষ্ট্রও মানুষের জীবনের মতো চলমান; জীবনের বাঁকে বাঁকে যেমন প্রতিদিনের সূর্যটি নতুন থাকে এবং আগামী দিনের সূর্যের আলোর চরিত্র অনিশ্চিত ও অস্বচ্ছ থাকে- একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেকটি রাষ্ট্র’র সম্পর্কও ঠিক তেমনি ভাবে প্রবাহিত হয়। তারপরেও রাষ্ট্রকে তার নাগরিকের কাঁছে সব সময় স্বচ্ছ থাকতে হয়। যখন কোন রাষ্ট্র তার নিজের নাগরিকের কাছে স্বচ্ছ না হয়- তখন কিছুটা হলেও সে রাষ্ট্র পরিপূর্ণ রাষ্ট্র নয়; ব্যর্থ রাষ্ট্র না হলেও কিছুটা ঘাটতিপূর্ণ রাষ্ট্র।

ভিয়েতনামের মাই লাই তে আমেরিকান অকুপেশান আর্মি নারী শিশু সহ হত্যা করেছিলো ৫’শ মানুষকে। ১৯৬৮ সালের ১৬ মার্চ। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের পরে এ ধরনের অসংখ্য হত্যাকান্ড ঘটে পাকিস্তানি অকুপেশান আর্মির হাতে। ১৯৭৩ সালে যখন যুদ্ধের ক্ষত অনেকটা বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠেছে সে সময়ে খুলনার চুকনগর এর থেকে মাইল দশেক দূরে নদীর ধারে এক রাতে আমাদের লঞ্চ নষ্ট হয়ে যায়। তরুণ বয়স, তাই কয়েক বন্ধু মিলে ওই রাতেই লঞ্চ থেকে নৌকার সাহায্যে নদীর পাশের একটা গ্রামে নেমে পড়ি। সেখানে নেমে প্রথমেই আশ্চর্য হই,  অনেক দূরে একটি বাড়িতে গাছের ভেতর একটা কেরোসিনের কূপি বাতি জ্বলছে। প্রথমে মনে করেছিলাম গ্রাম- তাই সন্ধ্যার একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাছাড়া তখন কেরোসিনের সরবরাহও কম ছিলো। কিন্তু টর্স লাইটের আলোতে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধু কয়েক অনেক দূরই যাই। দেখি অধিকাংশ গাছ পালা ঘেরা যেগুলোকে বাড়ি মনে হচ্ছে, সেখানে গাছ পালার ভেতর কোন ঘর বাড়ি নেই। পোড়ো ভিটের মতো। হেমন্তের ওই রাতে তরুণ ক’জন ঘুরতে ঘুরতে এক বয়স্ক মানুষকে পেয়ে যাই। তার কাছে কথায় কথায় জানতে পারি, এ সব বাড়ির মানুষ হয় চুকনগর গণহত্যায় মারা গেছে- না হয় এরা আর ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে আসেনি।

আমাদের বন্ধুদের ভেতর একজন মৃত’র ভূত হয়ে যাওয়া নিয়ে বিশ্বাস করতো। তার শরীর ওই ঘটনা শোনার পরে ঠান্ডা হয়ে যায়। সে মনে করতে থাকে এই সব পোড়ো বাড়িতে মৃতরা ভূত হয়ে ঘুরছে। ওই সব পোড়ো বাড়ির একটিকে ওই ভদ্রলোক শম্ভূনাথের বাড়ি বলে চিহ্নিত করেছিলেন। রাতে দেখা ওই শম্ভূনাথের বাড়িকে দিনের আলোয় কল্পনায় এনে “ শম্ভূর ভিটে” নামক একটা কবিতাও লিখেছিলাম। কোন একটা পত্রিকায় কবিতাটি ছাপা হয়েছিলো। কবি বন্ধু ত্রিদিব দস্তিদার তার দরাজ গলায় কয়েক দিন বাসায় ও আড্ডায় কবিতাটা আবৃতি করেছিলো তাও মনে পড়ে। কোন লেখা একবার লেখা হয়ে গেলে বুঝতে পারি,এটা আসলে কিছু হয়নি। তাই অন্য লেখাও যেমন সংরক্ষণ করিনা তেমনি সেটাও আর সংরক্ষণ করা হয়নি। তবে তার পরে বরিশালে, যশোরে, কুষ্টিয়ায়, এমন ফাঁকা ভিটের অনেক  গ্রাম দেখেছি। আর সে ভিটেগুলো দেখলেই মনে হতো “শম্ভূর ভিটে” ।

এরপরে যখন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া শরনার্থীদের ওপর পড়াশুনা করি তখন জানতে পারি, ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৬শত’র মতো শরনার্থী ভারত থেকে ফিরে এসেছিলো। যারা মিসিং ছিলো তার অধিকাংশই শরণার্থী শিবিরে মারা যায়। আর্ন্তজাতিক একটি সংস্থার রিপোর্টে, এপ্রিল থেকে জুলাই অবধি ভারতের শরনার্থী শিবিরে মারা যায় প্রায় ৮ লাখ শিশু। নিজে যেহেতু শরনার্থী ছিলাম, ভালোভাবেই জানি সেবার প্রচুর পরিমানে বৃষ্টি হয় অক্টোবর মাস অবধি। ওই বৃষ্টির জলে ও কাদায় মানুষের বসবাস অযোগ্য ওই শরনার্থী শিবিরে আগষ্ট থেকে ডিসেম্বর অবধি প্রতিদিনই শুধু শিশু ও বৃদ্ধকে ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা ও অপুষ্টিতে মারা যেতে দেখতাম। পরে সাংবাদিক হিসেবে মধ্য প্রদেশ, আন্দামান যে সব জায়গায় শরনার্থীরা ছিলো সেখানে বহুবার গিয়েছি। সাংবাদিক হিসেবে যতটুকু শিক্ষা আছে তার সমর্থ নিয়ে জানতে পেরেছি, আমাশয় ও পক্সে সেখানে প্রতিদিন শিশু এবং বৃদ্ধ ছাড়াও প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ মারা যেতো। আর ১৯৭১ এ কেনেডি যেসময় ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের শরনার্থী শিবির সফর করেন- তখন এ এফ পি রিপোর্ট করেছিলো, যদি দ্রুত বিশ্ববাসী এই শরনার্থী শিবির ও শিশু মৃত্যু নিয়ে সচেতন না হয়- তাহলে এখানে মৃত্যুর ভয়াবহতা হিরোশিমা ও নাগাসাকির থেকেও ভয়ংকর হবে।

চুকনগর বা তার আশে পাশের গ্রাম, শরণার্থী শিবিরের লাখ লাখ মৃত্যু- এগুলো অধিকাংশ সেদিন ঘটে বিশ্ব মিডিয়ার অন্তরালে। কারণ তখন মিডিয়ার ব্যপ্তি ছিলো অনেক কম। তবে রাজারবাগের পুলিশ হত্যা,  পিলখানার ইপি আর হত্যা, বিভিন্ন সেনাসদনে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য হত্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ মার্চ এর কালো রাত্রিতে চালানো হয় নির্বিচারে গণহত্যা।  ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবি হতা  সব মিলে -যে গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা প্রথম প্রকাশ করে সে সময়ের সোভিয়েতে ইউনিয়নের পত্রিকা প্রাভদায়। তারা বলে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি হবে।

পৃথিবীর এই অন্যতম গণহত্যাকে বুকে নিয়েও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়তে তিন বছরও সময় নেননি। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকিস্তান হানাদার মুক্ত হয় এবং  ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে আজও অবধি কখনো পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতকি সম্পর্ক একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি।

কিন্তু আমেরিকার থেকে পাকিস্তানের পার্থক্য হলো, ১৯৭২ থেকে আজো অবধি পাকিস্তানের কোন মিডিয়ায় বাংলাদেশে তারা যে গনহত্যা করেছিলো- তা  নিয়ে কোন সত্য রিপোর্ট করেনি। এমনকি তাদের দেশের সাধারণ নাগরিক শুধু নয়, নতুন প্রজম্মের সাংবাদিকদেরও তারা তাদের এ অপরাধের কথা জানতে দেয় না। বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানের পত্র পত্রিকায় লেখা ও বর্তমানের এই তথ্য প্রযুক্তির কারণে পাকিস্তানে যেমন অনেক বন্ধু স্থানীয় সম্পাদক আছেন- তেমনি তরুণ প্রজম্মের সাংবাদিক, অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ অনেকের সঙ্গেই একটা যোগাযোগ সব সময়ই হয়। বন্ধুত্বের প্রতি, স্নেহভাজনদের প্রতি সম্মান রেখেই বলতে হয়, তাদের মধ্যেও কোন তাগিদ দেখি না- তাদের একটি  প্রজম্মের কিছু মানুষ ১৯৭১ এ বাংলাদেশে গণহত্যার মত একটি মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছিলো -এটা তাদের বর্তমান প্রজম্মকে জানিয়ে তাদের ভেতর মানবতাকে পুষ্ট হতে সহায়তা করে। ৫৬ বছর পরে নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক তাদের দেশের আর্মির করা যুদ্ধাপরাধকে যেমন আবারও তাদের দেশের নাগরিকের সামনে নিয়ে এসেছেন, এই তাগিদ ৫৪ বছরে পাকিস্তানের কোন সাংবাদিককে বাংলাদেশে অন্য বিষয়ে রিপোর্ট করতে আসার পরেও দেখিনি।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World .         

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024