আর্কাদি গাইদার
সপ্তম পরিচ্ছেদ
বাবার দিকে তাকালুম। তিনি আমাকে কাছে টেনে নিলেন। কী যেন বলতেও গেলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত বললেন না। খালি আরও ঘন হয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলেন।
আমি মা-র বিছানায় শুলুম। বাবা-মা রইলেন খাবার ঘরে, দোর বন্ধ করে। অনেকক্ষণ ঘুম এল না আমার। বারবার এপাশ-ওপাশ করতে লাগলুম। গুনতে চেষ্টা করলুম পঞ্চাশ পর্যন্ত। তারপর এক শো পর্যন্ত। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।
মাথার মধ্যে তখন সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। সেদিন যা যা ঘটেছে যে- মুহূর্তে আমি তা ভাবতে চেষ্টা করলুম অমনি নানান চিন্তা এলোমেলোভাবে মাথার মধ্যে ভিড় করে এলো। এটা-না-ওটা, আর প্রতিটি অনুমানই ছিল অপরটার চেয়ে বেশি অবাস্তব। অনেকক্ষণ ধরে নাগরদোলায় চাপলে মাথার মধ্যে যেমনধারা রগ দুটো টিপটিপ করে আমারও সেইরকম করতে লাগল।
অনেক রাত্তিরে কখন ঘুমিয়ে পড়লুম। হঠাৎ একটা অস্পষ্ট মচমচ শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখলুম জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে বাবা ঘরে ঢুকলেন।
আধ-খোলা চোখে দেখলুম শুধু মোজা পায়ে দিয়ে পা-টিপেটিপে ঘরে ঢুকে বাবা তানিয়ার খাটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে মোমবাতিটা নিচু করে ধরলেন।
প্রায় মিনিট তিনেক ওইভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি ঘুমন্ত তানিয়ার সোনালী কোঁকড়া চুল আর গোলাপী মুখখানার দিকে তাকিয়ে। তারপর ওর দিকে একটু নিচু হলেন। বোধহয় দুই মনোভাবের লড়াই চলল ওঁর মনে এক, মেয়েকে একটু আদর করার ইচ্ছে, আর দুই, ও পাছে জেগে ওঠে এই ভয়। শেষপর্যন্ত অবিশ্যি দ্বিতীয় মনোভাবই জয়ী হল। হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে উনি ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
দরজাটা আবার একবার ক্যাঁচ করে উঠল। অন্ধকার হয়ে গেল ঘর।
যখন চোখ খুললুম তখন ঘড়িতে সাতটা বাজছে। জানলার বাইরে বার্চ গাছটার হলুদ পাতার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক ঝলমলে রোদ্দুর এসে পড়েছে ঘরে। তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নিয়ে পাশের ঘরে উ’কি দিয়ে দেখলুম। মা-বাবা তখনও ঘুমুচ্ছেন। দরজাটা ভেজিয়ে রেখে আমি বোনকে ডেকে তুললুম।
চোখ মুছতে মুছতে পাশের খালি বিছানাটার দিকে তাকিয়ে তানিয়া বললে, ‘মা-মণি কই, বরিস?’
‘মা-মণিকে হাসপাতালে ডেকে নিয়ে গেছে। যাবার সময় মা আমায় বলে গেছে তোকে দিদিমার বাড়ি নিয়ে যেতে।’
‘আঃ, তুই ভারি মিথ্যুক, বরিস!’ আমার দিকে একটা আঙুল নেড়ে হাসল তানিয়া। ‘এই তো কালই দিদিমা আমায় তাঁর কাছে থাকতে বললেন, কিন্তু মা-মণি তো আমায় থাকতে দিল না।’
Leave a Reply