আবু ইসহাক
জাহিদ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে বাড়ি এসে কাঁপতে কাঁপতে উঠানে পড়ে বেহুঁশ হয়ে যায়। রাত তখন সাড়ে দশটা। তাকে ঘিরে বাড়ির সবাই এবং প্রতিবেশীদের অনেকে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ তার হুঁশ ফিরিয়ে আনার জন্য চোখে-মুখে পানির ছিটা দেয়, কেউ তার মাথায় হাত বুলায়। কেউ কেউ তার গা-হাত-পা টিপে দেয়। ঘণ্টাখানেক পর তার হুঁশ ফিরে আসে। সে গা মোড়ামুড়ি দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে তাকায়।
-কি রে, কী হয়েছে? এভাবে বেহুঁশ হয়ে পড়লি কেন? তার এক চাচা জিজ্ঞেস করে।
-ভূত। এই একটা কথাই তখন তার মুখ দিয়ে বেরোয়।
তাকে গোসল করিয়ে কাঁজির পানির ছিটা দিয়ে ঘরে তোলা হয়।
পরের দিন সে বলে, রাত দশটার দিকে নে বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল।
ইলিয়াসদের পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের রাস্তা দিয়ে আসার সময় সে দেখে সাদা কাপড়পরা একটা ভূত ঐ পুকুরের দক্ষিণ-পুব কোণার গোলাপাজাম গাছটায় বসে আছে। ভূতটার মুখ আগুনের মতো লাল।
জাহিদ ইলিয়াসের জ্ঞাতি ভাই। বয়সে সে ইলিয়াসের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। বাড়ি থেকে এক মাইল দূরের ভোজেশ্বর বাজারে তার ছোট একটা চা-এর দোকান আছে।
-জাহিদ-ভাই, তুমি কি সত্যি সত্যি ভূত দেখেছিলে? ইলিয়াস জিজ্ঞেস করে।
-আরে হ্যাঁ, তুই তো ভূতে বিশ্বাস করিস না। তুই দেখলে ঠিক বিশ্বাস করতিস।
-আমি এখনো বিশ্বাস করি না। ইলিয়াস বলে।
-তুই তো প্রায়ই পুকুরের দক্ষিণ-পুব কোণায় হেলে-থাকা নারকেল গাছটায় হেলান দিয়ে বসে থাকিস। ওখানে আর যাস নে। ওখানেই ভূত থাকে।
-আমি তো গরম পড়লে রাত দশটার পরও ঐ কোণায় গিয়ে বসে থাকি, হাওয়া খাই। কই, আমি তো এমন কিছু দেখিনি! তারপর মজা করার জন্য বলে, আসলে ভূত আমাকে ভয় পায়। তাই আমার ধারে কাছে আসতে সাহস করে না।
-তোর কাছে এখনো আসেনি। তবে যেদিন আসবে সেদিন বুঝবি মজা। তোর ঘাড় মটকে রক্ত খেয়ে নেবে, মনে রাখিস।
-আমি তো চাই ভূত আমার কাছে আসুক। এক ঘুষিতে ওকে কুপোকাত করে ফেলব। ইলিয়াস হাসে। এবার বলো-দেখি কী করে ভূত দেখলে?
-রাত দশটার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি আসছিলাম। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। পক্ষীর মা’র ভিটা দিয়ে আসার সময় ভয়ে গাটা কেমন ছমছম করছিল। পক্ষীর মা’র ভিটায়ও ভূত থাকে, জানিস তো? আমি বারবার জোরে জোরে ‘আউজুবিল্লাহ হি মিনাশ শাইতুয়ানির রাজিম’ বলতে বলতে পক্ষীর মা’র ভিটা ভালোয় ভালোয় পার হলাম। তারপর খাল পেরিয়ে রাস্তায় উঠলাম। তোদের পুকুরের দক্ষিণের রাস্তা দিয়ে কিছু দূর এগিয়েছি, দেখি পুকুরের দক্ষিণ-পুব কোণার গোলাপজাম গাছটার ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে সাদা কাপড় পরা একটা মেয়েলোক। ওর মুখটা আগুনের মতো লা-ল। ভয়ে আমার আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে যাওয়ার যোগাড়। আমি ঘুমে দৌড় দিয়ে পুকুরের পশ্চিম পাড় দিয়ে কোনো রকমে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির উঠানে আসি। তারপর কী হয়েছে আর মনে নেই।
চা-এর দোকানে সন্ধ্যার দিকেই সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয়। কিন্তু ভূত দেখার পর থেকে জাহিদ সন্ধ্যার আগেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে আসে। ইলিয়াস তাকে অনেক করে বোঝায় যে ভূত বলে কিছু নেই। কিন্তু তার মনে এমন ভয় ঢুকেছে যে সে সন্ধ্যার পর আর ঘর থেকে বেরোয় না।
১৯৪২ সাল। ইলিয়াসের ম্যাট্রিক পরীক্ষা হয়ে গেছে মার্চ মাসে। পরীক্ষার ফল আগস্ট মাসের আগে জানা যাবে না। তার এখন অফুরন্ত অবসর। রাতে সে হারিকেনের আলোয় এর-ওর কাছ থেকে চেয়ে আনা বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস বা গ্রন্থাবলি পড়ে সময় কাটায়। খুব গরম পড়লে যখন ঘরে থাকা যায় না তখন সে তাদের পুকুরের দক্ষিণ-পুব কোণের তার প্রিয় নারকেল গাছটায় হেলান দিয়ে বসে হাওয়া খায়। তার ভূতের ভয় না থাকলেও সাপের ভয় আছে। তাই সে একটা টর্চলাইটও রাখে সাথে।
ভোর হওয়ার পর নাশতা খেয়ে কোনো দিন সে ছিপ নিয়ে বসে পুকুরে। কখনো গাছ থেকে আম-জাম-জামরুল-ডাব পেড়ে খায় সমবয়সীদের সাথে। কখনো জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে লাথালাথি করে। দল বেঁধে পুকুরে নেমে সাঁতার কাটে, ঝাঁপাঝাঁপি- গোতলাগুতলি করে। দুপুরের খাওয়ার পর যায় ফুটবল খেলতে। কখনো বা কোনো গ্রামের হা-ডু-ডু দল তাকে নিয়ে যায় দূরের কোনো গ্রামে হা-ডু-ডু খেলতে। বাড়ি ফিরতে কখনো রাত নয়টা-দশটাও বেজে যায়। ভূতে বিশ্বাস করে না বলে রাতে সে নির্ভয়ে একা চলাফেরা করতে পারে।
কিছুদিন আগে বাজারের একটা খালি পাটের গুদামকে অস্থায়ী বায়স্কোপ হল বানানো হয়েছে। কলকাতা থেকে টকি বায়স্কোপ এনে সেখানে দেখানো হচ্ছে। সে সময়ে সিনেমাকে টকি বায়স্কোপ বলা হতো। ইলিয়াস ও তার সঙ্গী-সাথীদের অনেক সময় কেটে যায় এখন টকি বায়স্কোপের আলোচনায়।
আজ সন্ধ্যায় দেখানো হবে শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’। উপন্যাসটা সে আগেই পড়েছে। পড়েছে বলেই সে বায়স্কোপটা দেখার জন্য বিশেষভাবে ব্যাকুল হয়। মা’র কাছ থেকে টিকেটের পয়সা নিয়ে পাঁচটার পরেই সে বাজারের দিকে রওনা হয়। টর্চলাইটটার ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। ব্যাটারি কেনার পয়সাও নেই তার কাছে। তাই টর্চলাইটটা খামোখা বয়ে বেড়ানো অর্থহীন।
বাজারে পৌঁছে সে দেখে, জাহিদ দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছে। তাকে দেখে জাহিদ ডাকে, এই ইলিয়াস, কোথায় যাচ্ছিস?
-যাচ্ছি বায়স্কোপ দেখতে। আজ ‘দেবদাস’, খুব ভালো একটা বায়স্কোপ।
-খুব ভালো?
-হ্যাঁ, যাবে নাকি জাহিদ-ভাই?
-যেতে তো ইচ্ছে করে। কিন্তু-
-ভূতের ভয়? আরে আমি আছি না সাথে?
-তুই আমাকে ফেলে চলে যাবি না তো?
-আরে না-না।
-তবে চল বায়স্কোপ দেখার অনেক ইচ্ছা। ছবিতে নাকি কথা বলে। এ পর্যন্ত একটা বায়স্কোপও দেখিনি।
গ্রামাঞ্চলের বাজার। তাই সাড়ে ছ’টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সিনেমা শুরু হয় সাড়ে সাতটায়। দু’জনে বায়স্কোপ দেখে বেরিয়ে আসে রাত সোয়া দশটায় পর। কী রকম দেখলে জাহিদ-ভাই?
-ও রে মাবুদ রে। মানুষের মাথায় এমন বুদ্ধি দিছে আল্লায়। চিন্তা করা যায় না। আর ছবি দেখে কতবার যে আমার চোখে পানি আসছিল, কী বলব তোকে। আহা রে দেবদাস, তুই এমন করে মরে গেলি!
অন্ধকার রাত। জাহিদ ইলিয়াসের হাত ধরে পথ চলছে। কিছুদূর যাওয়ার পর জাহিদ বলে,-চল ইলিয়াস, বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে ঘুরে যাই।
-কেন?
-পক্ষীর মা’র ভিটা দিয়ে যেতে ভয় লাগে। বাঁয়ের রাস্তা ঘুরে তোদের পুকুরের পশ্চিম পাড় দিয়ে যাব।
-আরে এসো তো আমার সাথে।
জাহিদ ইলিয়াসের হাত ছাড়ে না। তারা কুমোর পাড়া দিয়ে পক্ষীর মা’র ভিটার কাছে এসে গেছে।
জাহিদ সুর করে উচ্চকণ্ঠে শুরু করে, আউজুবিল্লাহ্ হিমিনাশ শাইতুয়ানির রাজিম। আউজুবিল্লাহ্ হিমিনাশ শাইতুয়ানির রাজিম। আউজু বিল্লাহ্ হিমিনাশ শাইতুয়ানির রাজিম। এই ইলিয়াস তুইও আউজুবিল্লাহ পড়। আউজুবিল্লাহ হির রহমানির রাহিম। আউজ-
-ও জাহিদ-ভাই, ‘হিররহমানির রাহিম’ বলছো কেন? ‘হিমিনাশ শাইতুয়ানির রাজিম’ বলো। ভয়ে জাহিদ আউজুবিল্লাহ্-এর পরের অংশ বিছমিল্লাহ্-র ‘হির রহমানির রাহিম’-এর সাথে গুলিয়ে ফেলেছে।
সে আবার নতুন করে শুরু করে, আউজুবিল্লাহিমিনাশ শাইতুয়ানির রাজিম।…
পক্ষীর মা’র ভিটা পার হতে যে সময় লাগে সে সময়ে তার অন্তত পনেরো বার ‘আউজুবিল্লাহ’ পড়া হয়ে যায়।
তারা খাল পার হয়ে রাস্তায় ওঠে। কিছুদূর যাওয়ার পর জাহিদ তাকে পুকুরের পশ্চিম পাড় দিয়ে যাওয়ার জন্য দুই হাত দিয়ে টানে। কিন্তু ইলিয়াস তার হাত ছাড়িয়ে সোজা দক্ষিণ পাড়ের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। জাহিদ আবার তার হাত ধরে তার পেছনে যেতে বাধ্য হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর ইলিয়াস দেখে, সত্যি সত্যি গোলাপজাম গাছটার নিচের মোটা ডালের ওপর বসে আছে আগুনমুখো এক মেয়েলোক। তার মুখের আলোয় পরিধানের সাদা কাপড় দেখা যাচ্ছে এই ঘুটঘুটে অন্ধকারেও। তার মাথায় আধ- ঘোমটা। পা দুটো ঝুলে আছে।
ভয়ে জাহিদ ইলিয়াসের কোমর জড়িয়ে ধরেছে। ইলিয়াস নিঃশব্দে রাস্তার পাশ থেকে একটা আটকিরা গাছ উপড়ে তুলে কোমর থেকে জাহিদের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে যায় গোলাপজাম গাছটার দিকে।
-দাঁড়া শয়তান ভূত! তোকে আজ শেষ করে ফেলব। ইলিয়াস দৌড়াতে দৌড়াতে বলে।
ভূত গাছ থেকে নেমে পুব দিকে দৌড় দিয়েছে। ইলিয়াস ছুটছে তার পিছুপিছু। এতক্ষণে জাহিদের ভয় কেটে গেছে। সেও দৌড়াচ্ছে ভূত ধরার জন্য। কিছু দূর গিয়েই রাস্তা শেষ হয়েছে। এর পর চষা খেত। ভূত চষা খেতে নেমে দৌড়াচ্ছে। ইলিয়াস ও জাহিদ তার পিছু নিয়ে দৌড়াচ্ছে আর ঢিল মারছে। ভূতের গায়ে গোটা দুই ঢিল পড়তেই সে আত্মসমর্পণ করে, ‘ইলিয়াস-ভাই, আমি হাবুল।’
ইলিয়াস তার গালে কয়েকটা থাপ্পড় মেরে বলে, এমন কাজ করবি আর?
-না, আর কোনো দিন এমন কাজ করব না। আমাকে আর মেরো না ইলিয়াস- ভাই।
হাবুলের পরনে ধুতি (সে সময়ে মুসলমানদের মধ্যেও ধুতি পরার প্রচলন ছিল) আর হাতে একটা এক-ব্যাটারি টর্চলাইট। ইলিয়াস সেটা তার হাত থেকে কেড়ে নেয়। সে তার ধুতির কোঁচা খুলে তা দিয়ে ঘোমটা দেয় আর টর্চ লাইটটা জ্বালিয়ে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।
-কেমন জাহিদ-ভাই, আমিই এখন আগুনমুখো ভূত। আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছ নাকি?
Leave a Reply